গণতন্ত্র রক্ষায় সংলাপের জয়- এবার শান্তিতে নোবেল পেল চার তিউনিসীয় সংগঠন

এ বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছে উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিসিয়ায় গণতান্ত্রিক উত্তরণে সহায়তাকারী নাগরিক সমাজের চারটি সংগঠন। এর মধ্য দিয়ে ‘আরব বসন্তের’ সূচনাকারী দেশটির গণতন্ত্রকামীদের সংগ্রাম নোবেল কমিটির সম্মানজনক স্বীকৃতি পেল।
২০১১ সালে তিউনিসিয়ার স্বৈরশাসনবিরোধী গণবিপ্লবের পর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করার জন্য এই চার সংগঠনকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। শান্তির মুকুটজয়ী নাগরিক সমাজের এ সংগঠনগুলো একত্রে ‘ন্যাশনাল ডায়ালগ কোয়ার্টেট’ নামে পরিচিত। অস্থির ওই সময়ে তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা দেশটিকে সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধের হাত থেকে বাঁচায়।
পুরস্কৃত সংগঠন চারটি হচ্ছে তিউনিসিয়ান জেনারেল লেবার ইউনিয়ন (ইউজিটিটি), তিউনিসিয়ান এমপ্লয়ার্স ইউনিয়ন (ইউটিআইসিএ), তিউনিসিয়ান হিউম্যান রাইটস লিগ (এলটিডিএইচ) ও তিউনিসিয়ান অর্ডার অব লইয়ার্স।
‘আরব বসন্তের’ পর তিউনিসিয়া যখন চরম অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা ও হানাহানিতে গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও শান্তি প্রতিষ্ঠার আশা হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার মুখে, ঠিক তখন ২০১৩ সালে ওই চারটি সংগঠন জাতীয় সংলাপের উদ্যোগ নেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল গণতন্ত্র ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করা। কেননা সেটা হলেই কেবল গণমানুষের জন্য আরব বসন্তের সুফল পাওয়া সম্ভব ছিল। গতকাল শুক্রবার নরওয়ের নোবেল কমিটিও সেটাই বলেছে।
নোবেল কমিটির কথায়, চরম সামাজিক-রাজনৈতিক অসন্তোষের মুখে তিউনিসিয়ার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যখন ভেঙে পড়ার মুখে, তখন এই চার সংগঠন এক বিকল্প, শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সূচনা করে। এর ধারাবাহিকতায়ই দেশটিতে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন, অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং ইসলামপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়।
পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, সংকটে পড়া দেশগুলোতে স্বৈরশাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণে সংলাপ ও সমঝোতার ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সে বিষয়ে তিউনিসিয়া এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
তিউনিসিয়ার শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ের প্রতিক্রিয়ায় দেশটির প্রেসিডেন্ট বেজি কাইদ এসেবসি বলেন, ‘এটি আমাদের মধ্যস্থতাকারীদের জন্য যেমন এক সম্মান, তেমনি ঐকমত্যের ভিত্তিতে আমরা সংকট সমাধানের যে পথ বেছে নিয়েছি তারও স্বীকৃতি। ...আদর্শিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও সংকটের সমাধানে সংলাপ ছাড়া তিউনিসিয়ার সামনে আর পথ নেই।’
শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে চার সংগঠনের নাম ঘোষণার পর ইউজিটিটির প্রধান হুসেইন আব্বাসি বলেন, ‘এটা তিউনিসিয়ার জন্য অত্যন্ত আনন্দ ও গর্বের বিষয়। সংলাপ যে আমাদের সঠিক পথ দেখাতে পারে, এটা তারই একটি বার্তা। এই পুরস্কার আমাদের এই অঞ্চলের জন্য অস্ত্র সংবরণ করে সমঝোতার টেবিলে বসা ও আলোচনার এক বার্তা।’
নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় তিউনিসিয়াকে অভিনন্দন জানিয়েছে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান।
পুলিশি হয়রানি ও বেকারত্বের প্রতিবাদে এক তরুণের শরীরে আগুন লাগিয়ে আত্মাহুতির ঘটনার জের ধরে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে তিউনিসিয়ায় অস্থিরতা দেখা দেয়। শুরু হয় একনায়ক জাইন আল আবেদিন বেন আলীর বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ। গণতন্ত্রকামী মানুষের টানা আন্দোলনের ফলে ওই বছরই পদত্যাগে বাধ্য হন ১৯৮৭ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করা বেন আলী।
বেন আলীর পতনের পর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার জন্য উন্মুখ তিউনিসিয়ায় বড় ধাক্কা আসে ২০১৩ সালের জুলাইয়ে। বিরোধীদলীয় এক নেতা অস্ত্রধারীদের গুলিতে নিহত হন। ছয় মাসের মধ্যে সেটি ছিল দ্বিতীয় রাজনৈতিক হত্যা। এতে ২০১১-এর অক্টোবরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়ী ইসলামপন্থী দল এন্নাহদার নেতৃত্বাধীন জোটের পদত্যাগ দাবি করে বিরোধীরা। কিন্তু ওই দাবি প্রত্যাখ্যাত হয়। এরপর শুরু হয় ব্যাপক সহিংসতা ও বিক্ষোভ। এমন পরিস্থিতিতে বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা গড়ায় নেতৃত্ব দেয় নাগরিক নেতাদের ওই চার সংগঠন। সমঝোতায় বাধ্য হন রাজনীতিকেরা। মাত্র ছয় মাসেই খাদের কিনারায় চলে যাওয়া তিউনিসিয়া এতে অনেকটাই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
পরে সব পক্ষ একটি নতুন টেকনোক্র্যাট সরকার গঠন এবং নতুন নির্বাচনের আগ পর্যন্ত নির্বাচিত পার্লামেন্টকে কাজ করে যেতে দেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হয়। নতুন সংবিধান রচনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন শেষে ২০১৪-এর জানুয়ারিতে পদত্যাগ করে এন্নাহদা সরকার। এরপর সে বছরই অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন। তিউনিসিয়ার গণতন্ত্রে উত্তরণে ওই নির্বাচনকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক বলে বিবেচনা করা হয়।
তিউনিসিয়ায় স্বৈরশাসক হটানোর আন্দোলনের সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে অনেক আরব দেশের মানুষই সংস্কারের দাবিতে পথে নামে। দেশে দেশে শুরু হয় গণবিক্ষোভ, যা বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়ে ওঠে আরব বসন্ত আন্দোলন নামে। তবে এ বসন্তের ঢেউ লাগা মিসর, লিবিয়া, ইয়েমেন ও সিরিয়া এখনো ডুবে আছে সন্ত্রাস, অস্থিরতা বা গৃহযুদ্ধের মধ্যে।
আরব বিশ্বের সবচেয়ে পশ্চিমের ক্ষুদ্র দেশ তিউনিসিয়া। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আরবদেরকে স্বৈরতন্ত্রের অচলায়তন থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখিয়েছিল দেশটি। সফলভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে দেশটি স্বৈরশাসনের ধ্বংসস্তূপের ওপর গণতন্ত্রের ফুল ফুটিয়ে বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে।
এ বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের মনোনয়নে ২৭৩ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছিল। তাঁদের মধ্যে ছিল জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল ও বিশ্বের ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিসের নামও। আলোচিত নামগুলোর বাইরে থাকা এই চার সংগঠনের নোবেল জয়ে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন।
গত বছর শান্তিতে নোবেল পেয়েছিলেন পাকিস্তানের নারী শিক্ষা আন্দোলনের নবীন কর্মী মালালা ইউসুফজাই এবং ভারতের শিশু অধিকার কর্মী কৈলাস সত্যার্থী।
শান্তিসহ চিকিৎসা, পদার্থ, রসায়ন ও সাহিত্যে এ বছর নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করা হয়ে গেছে। ১২ অক্টোবর ঘোষণা করা হবে অর্থনীতির নোবেল। এর মধ্য দিয়ে যবনিকাপাত ঘটবে এ বছরের নোবেল পুরস্কার ঘোষণার।
তিউনিসে এক সংবাদ সম্মেলনে এ বছরের শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী তিউনিসিয়ার চার সংগঠনের চারজন প্রতিনিধি (বাঁ থেকে) তিউনিসিয়ান এমপ্লয়ার্স ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ওয়াইদেদ বুকামাওয়ি, তিউনিসিয়ান জেনারেল লেবার ইউনিয়নের সেক্রেটারি জেনারেল হুসেইন আব্বাসি, তিউনিসিয়ান হিউম্যান রাইটস লিগের প্রেসিডেন্ট আবদে সাত্তার বেন মুসা ও ন্যাশনাল বার অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ফাদহেল মাহমুদ। এটি ২০১৩ সালের একটি ফাইল ছবি l রয়টার্স
{তথ্যসূত্র: বিবিসি, এএফপি, রয়টার্স, দ্য গার্ডিয়ান}

No comments

Powered by Blogger.