প্রশ্নবিদ্ধ প্রক্রিয়ায় ব্যান্ডউইথ রপ্তানি by কাজী সোহাগ

কোনরকম টেন্ডার আহ্বান করা হয়নি। সুযোগ দেয়া হয়নি স্থানীয় কোম্পানিগুলোকে। বাজারের তুলনায় মূল্য ধরা হয়েছে অনেক কম। অথচ ব্যান্ডউইথের মতো জাতীয় সম্পদ রপ্তানির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়েছে। কেবল একটি কমিটির মতামত নিয়েই ইতালির কোম্পানি স্পার্কেলস এর কাছে ব্যান্ডউইথ রপ্তানি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিসিএল)। রপ্তানির কোন প্রক্রিয়া না মানায় বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা। ব্যান্ডউইথ বলতে একটি নেটওয়ার্ক বা মডেম কানেকশনের মাধ্যমে পাঠানো ডাটার পরিমাণ বোঝায়। এটি সাধারণত ‘বাইটস পার সেকেন্ড’ বা বিপিএস দিয়ে পরিমাপ করা হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে দুই শ’ জিবিপিএস ক্ষমতাসম্পন্ন সাবমেরিন ক্যাবল রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৩০ জিবিপিএস বাংলাদেশ ব্যবহার করে। বাকি ১৭০ জিবিপিএস অব্যবহৃত। বিএসসিসিএলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইতালিয়ান কোম্পানির কাছে ৫৭ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ রপ্তানি করা হবে। এ থেকে আগামী ১৫ বছরে বাংলাদেশের আয় হবে ৯ দশমিক ৭৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া ক্যাবল রক্ষণাবেক্ষণের পাওয়া যাবে প্রতি বছর ২৯ দশমিক ৩ লাখ টাকা। রপ্তানির এ মূল্য বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতি মাসে ১ এমবিপিএস ব্যান্ডউথের দাম হয় ৯ দশমিক ৫২ টাকা। যেখানে একই পরিমাণ ব্যান্ডউথের জন্য বাংলাদেশী গ্রাহকদের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে ৬২৫ টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশে ৬টি ইন্টারন্যাশনাল টিরেসট্রিয়াল ক্যাবল সার্ভিস (আইটিসি) কোম্পানিকে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। তারা কম দামে ব্যান্ডউইথ রপ্তানির বিপক্ষে। লাইসেন্স পাওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে, ফাইবার অ্যাট হোম, নভোকম, ম্যাংগো টেলিসার্ভিস, বিডিলিংক কমিউনিকেশন্স, ওয়ান এশিয়া ও সামিট কমিউনিকেশন। এ প্রসঙ্গে ফাইবার অ্যাট হোমের প্রধান স্ট্রাটেজি অফিসার সুমন আহমেদ সাবির মানবজমিনকে বলেন, ব্যান্ডউইথের মতো জাতীয় সম্পদ টেন্ডার প্রক্রিয়া ছাড়াই ইতালির কোম্পানির কাছে রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। এটা কিভাবে সম্ভব হলো তা আমার প্রশ্ন। সরকার আমাদের লাইসেন্স দিয়েছে। অথচ ব্যান্ডউইথ লিজ দেয়ার সময় আমাদের সুযোগ দেয়া হয়নি।
তিনি বলেন, যে দামে ইতালির কোম্পানিকে ব্যান্ডউইথ দেয়া হয়েছে সে দামে কিনতে আমরা প্রস্তুত। বরং এর থেকে বেশি দামেও আমরা কিনতে চাই। কিন্তু সে সুযোগ দেয়া হয়নি। তিনি আরও বলেন, বিএসসিসিএল এক্ষেত্রে মনোপলি নীতি গ্রহণ করেছে। পুরো রপ্তানি প্রক্রিয়াটি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে বিএসসিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের অব্যবহ্রত অনেক ব্যান্ডউইথ রয়েছে। ক্যাবলের লাইফটাইমও শেষ হচ্ছে। তাই ইতালির কোম্পানির অনুরোধের প্রেক্ষিতে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েই ব্যান্ডউইথ রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, একটি সাবমেরিন ক্যাবল স্থায়ী হয় ২০ থেকে ২৫ বছর। বাংলাদেশের এ ক্যাবলটির যাত্রা শুরু হয় ২০০৬ সাল থেকে। এ হিসেবে ইতালির প্রতিষ্ঠানটি সাবমেরিন ক্যাবলটি ব্যবহার করতে পারবে ১১ থেকে ১৬ বছর। বিএসসিসিএল আন্তর্জাতিক সাবমেরিন ক্যাবল কনসোর্টিয়াম সিমিউয়ি-৪ এর সদস্য। ক্যাবলটির সংযোগ ফ্রান্স থেকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত। এ কারণে যে কোন কোম্পানির পক্ষে এ রুটে ক্যাবল সংযোগ নেয়া সহজ। এরই ভিত্তিতে ইতালির প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের সাবমেরিন ক্যাবল নিতে আগ্রহ প্রকাশ করে। বিষয়টি বিএসসিএলের পরিচালনা পর্ষদের ১১৩তম বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়। দীর্ঘ আলোচনার পর বিষয়টি যাচাইয়ের জন্য কোম্পানির পরিচালক ড. মো. মাহবুবুল আলম জোয়ার্দ্দারকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের উপ-কমিটি গঠন করা হয়। অপর ২ সদস্য হলেন- মো. আরেফিন তালুকদার ও নাসির উদ্দিন আহমেদ। পরে উপ-কমিটি তাদের মতামতে জানায়, ২০০৫ সালে এসএমডব্লিউ-৪ সাবমেরিন ক্যাবল চালু হওয়ার পর হতে গত ১০ বছরে বিএসসিসিএলের প্রচুর ক্যাপাসিটি অব্যবহ্রত অবস্থায় রয়েছে। এর মূল্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে শূন্য দশমিক ৫০ বা শূন্য দশমিক ৫২ ইএসডি দরে ৩ পার্সেন্ট ওএন্ডএম চার্জসহ আলোচ্য আইআরইউ বিক্রি কোম্পানির জন্য সুফল বয়ে আনবে। বিএসসিসিএল জানিয়েছে, দুই বছর আগে সরকার সক্ষমতার অর্ধেক সাবমেরিন ক্যাবল বিক্রি বা লিজ দেয়ার নির্দেশনা দেয়। তখন কোন প্রতিষ্ঠানকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে ভারতে ব্যান্ডউইথ রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরই মধ্যে সাবমেরিন ক্যাবলের ইন্টারনেটের অব্যবহৃত ১০ জিবিপিএস (গিগাবাইট পার সসেকেন্ড) ব্যান্ডউইথ রপ্তানির অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এ নিয়ে ভারতের সঙ্গে ‘এগ্রিমেন্ট বিটুইন ভারত সঞ্চার নিগাম লিমিটেড (বিএসএনএল) অ্যান্ড বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিসিএল) ফর লিজিং অব ইন্টারন্যাশনাল ব্যান্ডউইথ ফর ইন্টারনেট অ্যাট আখাউড়া (জিরো পয়েন্ট)’ শীর্ষক চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়। এর মাধ্যমে বছরে ৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা (এক দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার) পাবে বাংলাদেশ। রপ্তানির জন্য ক্যাবল কক্সবাজার থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া হয়ে আগরতলা জিরো পয়েন্ট দিয়ে ভারতে যাবে। বাংলাদেশ অংশে সীমান্ত পর্যন্ত ক্যাবল স্থাপনে সরকারই খরচ বহন করবে। ভারতের অংশের জন্য ভারতের প্রতিষ্ঠানই খরচ বহন করবে। বাংলাদেশের এ ব্যান্ডউইথ ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মনিপুর ও অরুণাচল রাজ্যে ব্যবহৃত হবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বংলাদেশ শিগগিরই সিমিউয়ি-৫ এর সঙ্গে যুক্ত হবে। তখন ব্যান্ডউইথের সক্ষমতা বাড়বে আরও এক হাজার ৩০০ জিবিপিএস।

No comments

Powered by Blogger.