দাপুটে ছেলেদের যন্ত্রণা আওয়ামী লীগে by হাবীব রহমান

এমপি-মন্ত্রী পুত্র সন্তানদের ক্ষমতার দাপটে অস্বস্তি আওয়ামী লীগে। পিতার ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহারে সরকার ও দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে। অনেক স্থানে পুত্ররা পিতার প্রভাব কাজে লাগিয়ে নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র তৈরি করছেন। দলে বিভক্তি সৃষ্টি করছেন। হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছেন। আবার সময়মতো পুত্রদের মাসুল গুনতে হয় আওয়ামী লীগ নেতা পিতাদেরই। তবে প্রভাবশালী এমপি-মন্ত্রীর পুত্রদের এসব ঘটনায় আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড বারবার বিব্রত হয়েছে।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত আসনের এমপি ও মহিলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক পিনু খানের ছেলে বখতিয়ার আলম রনির পিস্তলের গুলিতে রাজধানীর ইস্কাটনে জোড়া খুনের ঘটনা ঘটেছে। সামান্য যানজটে পড়ে মানুষ খুন করায় হতবাক হয়েছেন খোদ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। তবে নাম প্রকাশ করে কেউ কিছু বলতে চাননি। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এ সদস্য বলেন, এ বিষয়টি নিয়ে সরকার ও দল বিব্রত। ঢাকা শহরে যানজটে রাজধানীবাসীর প্রাণ ওষ্ঠাগত। আর সামান্য যানজটে পড়ে গুলি করে দুই শ্রমিককে মেরে ফেলা সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের কাজ না। প্রধানমন্ত্রী লন্ডন থেকে দেশে ফিরেছেন। তিনি সব দেখেশুনে ব্যবস্থা নেবেন। তবে পিনু খানের ওপর দলের চাপ আসতে পারে।
জানা যায়, মা এমপি পিনু খানের শুল্কমুক্ত সুবিধায় কেনা বিলাসবহুল প্রাডো জিপে করে সব    অপকর্মের বিস্তৃতি ঘটাতেন বখতিয়ার আলম রনি। আতঙ্ক ছড়াতে গুলি ছোড়া ছিল নিত্য অভ্যাস। তার ভয়ে মুখ খোলার সাহস পেতেন না এলাকাবাসীর কেউ। জোড়া খুনের ক’দিন আগেও তিনি ধানমণ্ডির একটি বাসার সামনে প্রকাশ্যে ফাঁকা গুলি করে ক্ষমতার দাপটে পার পেয়ে যান। তার হাতে থাকা বৈধ অস্ত্রটি দিয়েই তিনি সব অবৈধ কাজ করে বেড়াতেন। তার এ রকম বেপরোয়া আচরণেই নির্মম কায়দায় প্রাণ হারাতে হয় ইস্কাটনের এক রিকশাচালক ও অপর এক অটো রিকশাচালককে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রনি কথায় কথায় গুলি করতে অভ্যস্ত। আগে অনেকবার এভাবে গুলি চালিয়েও তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। সম্প্রতি ধানমণ্ডির এক বাসায় গেলে তাকে প্রবেশ করতে না দেয়ায় বাসার নিচে দাঁড়িয়ে তিনি কয়েক রাউন্ড গুলি করে চলে আসেন।
শুধু পিনু খানই নয়, ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের ছেলে মুহিত উর রহমান শান্ত ময়মনসিংহ শহরের এক আতঙ্কের নাম। জেলা আওয়ামী লীগের কোনো পদে না থাকলেও তিনি জেলা আওয়ামী লীগের নেতা পরিচয় দিয়ে বেড়ান বলে অভিযোগ রয়েছে। বাবা মন্ত্রী হওয়ায় মন্ত্রণালয়ের অনেক কাজও শান্ত দেখভাল করে থাকেন। হজযাত্রীদের ব্যাগ তৈরি, সরকারিভাবে হজযাত্রীদের তালিকা তৈরি, পূজা ও ঈদের বিশেষ বরাদ্দে তিনি প্রভাব রাখেন বলে জানা গেছে। হজযাত্রীদের ব্যাগ তৈরির ক্ষেত্রে নিজের পছন্দের কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া নিজের এলাকায় মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দকৃত টাকা পূজা ও ঈদের সময় নিজের বলে চালিয়ে দেন- এমন অভিযোগ এসেছে জেলা আওয়ামী লীগ থেকে। জানা গেছে, ময়মনসিংহ শহরের রাজনীতিতে প্রভাব রাখতে যুবলীগ নেতা শাহানুর ও শহর ছাত্রলীগের সভাপতির বাড়িতে কয়েক দফায় হামলা চালিয়েছে শান্ত। জেলায় জমি দখলের অভিযোগও রয়েছে শান্তর বিরুদ্ধে।
এর আগে আরেক মন্ত্রীপুত্র দেশব্যাপী আলোচিত হয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জে সেভেন মার্ডারের ঘটনার সময়ে। এর আগে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরও রাজধানীর উত্তরায় ঠিকাদার তরাজউদ্দিন খুনের ঘটনায় ছেলে দীপু চৌধুরীর সম্পৃক্ততায় বেকায়দায় পড়েছিলেন তৎকালীন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী মায়া। এবার নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় অভিযোগ মায়ার মেয়ের জামাই ও ছেলে দু’জনকে ঘিরেই। নারায়ণগঞ্জের আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডে ক্ষমতাসীন দলের ভাবমূর্তিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বর্তমান ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী মায়ার পরিবার।
জানা যায়, ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে নিজেকে খুব ক্ষমতাধর মনে করতেন মায়াপুত্র দীপু। দিনে দিনে এক আতঙ্কের নাম হয়ে ওঠেন তিনি। উত্তরায় ক্লাবপাড়ায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে রাখেন তিনি। তার প্রধান কাজ ছিল ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় জমি দখল। উত্তরায় রাজউকের কয়েক বিঘা জমি দখল করে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে অবৈধভাবে সুপার মার্কেট করে দীপু আলোচিত হন। দখলদারি ছাড়া বিমানবন্দরকেন্দ্রিক চোরাকারবারের নিয়ন্ত্রক হিসেবেও তার নাম ছিল আলোচনায়। পরে উত্তরায় ঠিকাদার তরাজউদ্দিন হত্যা মামলার প্রধান আসামি হন দীপু। বাবা তখন প্রতিমন্ত্রী থাকলেও রক্ষা করা যায়নি দীপুকে। শেষ পর্যন্ত জেলে যেতে হয়েছে।
এর আগে রাজধানীর পাশের একটি জেলায় এক হত্যাকাণ্ডেও দুই এমপির ছেলেদের নাম আসে। যশোর-৫ আসনের সাবেক এমপি খান টিপু সুলতানের বড় ছেলে হুমায়ূন সুলতান তার স্ত্রীকে হত্যা করেন।
বিভিন্ন সময়ে পুত্রদের কুকীর্তির খেসারতও দিতে হয়েছে। রাজনীতির মাঠের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিবিহীন নির্বাচনেও পুত্রদের ক্ষমতার দাপট ও দাম্ভিকতার কারণে পরাজিত হয়েছেন কিছু এমপি। বিগত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে রাজশাহী-৩ আসনের মেরাজ উদ্দিন মোল্লা হেরেছেন নতুন প্রার্থী আয়েন উদ্দীনের কাছে। এর আগে বিতর্কিত হওয়ায় তাকে দল থেকে মনোনয়নই দেয়া হয়নি। জানা যায়, তার বড় ছেলে আবুল কালাম আজাদের নির্দেশে মোহনপুর থানা, মেঝ ছেলে জালাল উদ্দীনের নির্দেশে পবা থানা চলত। আর ছোট ছেলে মোস্তাক ছিলেন ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ছেলেদের এসব অপকর্মের খেসারত দিতে হয়েছে মেরাজ উদ্দিন মোল্লাকে। কুষ্টিয়া-১ আসনে আফাজ উদ্দীন আহমেদও খেসারত দিয়েছেন দুই পুত্রের অপকর্মের। আফাজ উদ্দীনের দুই ছেলের কাছে জিম্মি ছিল দৌলতপুরের মানুষ। উপজেলা প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাও হেনস্থা হয়েছেন তাদের হাতে। পরে বিএনপিবিহীন নির্বাচনেও আফাজ উদ্দীন পরাজিত হয়েছেন।
এর আগের মন্ত্রী হয়ে সরকারের সঙ্গে ব্যবসা করার সুযোগ না থাকার পরও কৌশলে এক মন্ত্রী তার ছেলের দ্বারা, আরেকজন তার মেয়ের দ্বারা ব্যবসা করিয়েছেন। দু’জনেই আলোচিত দুই ঘটনায় মন্ত্রিসভা থেকে বিদায় নেন। একজন মনোনয়ন পেয়ে এমপি হলেও আরেক জন দলের পদও খুইয়েছেন, এমপির টিকিটও পাননি।

No comments

Powered by Blogger.