চাঞ্চল্যকর কয়েকটি হত্যাকাণ্ড : রহস্যের জট খোলেনি by শাহীন করিম

মাসের পর মাস পেরিয়ে গেলেও দেশজুড়ে চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের রহস্যের জট খোলেনি। পুলিশ হদিস পায়নি এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত খুনিদের। ব্লগার অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, মোহাম্ম¥দপুরে কলেজ শিক্ষিকা কৃষ্ণা কাবেরী ও সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও খুনিরা রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আলোচিত এসব মামলার তদন্তের অবস্থা যা ছিল তাই রয়ে গেছে। উল্লেখ করার মতো কোনো অগ্রগতি নেই। খুনিদের গ্রেফতার করতে না পারায় নিহতদের স্বজনদের মধ্যে বিরাজ করছে চরম হতাশা ও ক্ষোভ।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, জঙ্গিদের সিøপার সেলের হাতে ঘটে যাওয়া একের পর এক হত্যাকাণ্ডকে তারা গুরুত্বের সঙ্গেই দেখছেন। এসব হত্যাকাণ্ডের রহস্য উšে§াচন ও খুনিদের গ্রেফতারেও পুলিশ-গোয়েন্দারা বিরামহীন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ধরাও পড়ছে জঙ্গিরা। কিন্তু তারা এতই ধূর্ত প্রকৃতির যে, জঙ্গিবাদের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য তারা দিলেও হত্যাকাণ্ডগুলোর সঙ্গে কে জড়িত, সেই তথ্য তারা কৌশলেই এড়িয়ে যান। হত্যাকাণ্ডগুলো সুপরিকল্পিত হওয়ায় রহস্য উšে§াচনে কিছুটা সময় লাগছে।
প্রায় চার মাস আগে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে আটটার সময় সময় ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায়কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির মোড়ে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করে জঙ্গিরা। ঘটনার তিনদিন পর অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের ইন্ধনদাতা হিসেবে শাফিউর রহমান ফারাবী নামের এক সন্দেহভাজন জঙ্গিকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। পরে তাকে অভিজিৎ হত্যা মামলার তদন্ত সংস্থা গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর তাকে রিমান্ডে নিয়ে কয়েকদফা জিজ্ঞাসাবাদ করে গোয়েন্দারা। এরপর আনসারুল্লাহ বাংলা টিমসহ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের  বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তার কাছ থেকে উদ্ধার করেন গোয়েন্দারা। 
সংশ্লিষ্টরা জানান, ফারাবীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে উসকানি ও জড়িত থাকার অভিযোগে ১২ ব্লগারকে চিহ্নিত করেন গোয়েন্দারা। এছাড়া বই মেলার ৭০টি সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে বেশ ক’জন সন্দেহভাজনকে চিহ্নিত করা গেলেও এখনো কারও হদিস মেলেনি। এ হত্যাকাণ্ডের তদন্তে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআই। খুনিদের গ্রেফতারে তাদের কাছ থেকেও প্রযুক্তিগত সহায়তা নেয়া হয়। কিন্তু খুনিরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছেন।
গত ৩০ মার্চ সকালে রাজধানীর বেগুনবাড়ির দিপীকার মোড়ে প্রকাশ্য দিবালোকে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকেও একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনার সময় হওয়া জিকরুল্লাহ ও আরিফুর রহমান নামে দুইজন কিলারকে হাতেনাতে ধরে ফেলে কয়েক হিজড়াসহ স্থানীয় জনতা। তবে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায় তাহের ও মাসুম নামে অপর দুই ঘাতক। আলোচিত এ মামলাটির তদন্তভার তেজগাঁও থানা পুলিশের কাছ থেকে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কিন্ত দীর্ঘ প্রায় তিন মাসেও পালিয়ে যাওয়া ও নেপথ্যের খুনিদের গ্রেফতার করতে পারেনি গোয়েন্দা পুলিশ। একই সঙ্গে ভেদ করতে পারেনি হত্যাকাণ্ডের রহস্যের বেড়াজাল।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, ব্লগার অভিজিৎ ও ওয়াশিকুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া শাফিউর রহমান ফারাবী ও আরিফুর রহমানকে এর আগেও গ্রেফতার করেছিলেন তারা। গ্রেফতারের আগে তারা হিযবুত তাহরীর ও জেএমবির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও পরে তারা প্রত্যেকেই আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া জিকরুল্লাহ ও আরিফুর রহমানের দেয়া তথ্য অনুযায়ী আরো কয়েকজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা আবু তাহেরসহ তাদের সবাইকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
গত ১২ মে সকালে সিলেট মহানগরীর সুবিদবাজার বনকলাপাড়া এলাকায় নিজ বাসার অদূরে বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। আনসার বাংলা ৮ নামের একটি স্থানীয় জঙ্গি সংগঠন ও আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদা এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে। আলোচিত এ মামলাটির বর্তমান তদন্ত সংস্থা সিআইডি। পুলিশ সূত্র জানায়, ব্লগার অনন্ত হত্যাকাণ্ডের রহস্যের জটও খুলতে পারেনি সিআইডি। খুনিদের হদিসও এখনো পায়নি পুলিশ। সিআইডি সূত্র জানায়, এ মামলায় সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে সিলেটের স্থানীয় ‘দৈনিক সবুজ সিলেটের’ ফটোসাংবাদিক ইদ্রিস আলীকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয় সিআইডি। কিন্তু তাকে জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায়নি পুলিশ। গ্রেফতার ইদ্রিস বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। তাকে আটক করা ছাড়া এ মামলার এখন পর্যন্ত কোনো অর্জন নেই পুলিশের।
গত ৩০ মার্চ রাতে মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডের ৩/১২ নম্বর বাড়িতে বিআরটিএ কর্মকর্তার স্ত্রী কৃষ্ণা কাবেরীকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে নৃসংশভাবে হত্যা করে পালিয়ে যায় পূর্ব পরিচিত ঘাতক। আদাবরের মিশন ইন্টারন্যাশনাল কলেজের প্রভাষক কৃষ্ণা কাবেরী বিশ্বাস হত্যাকাণ্ডের প্রায় আড়াই মাস পেরিয়ে গেলেও হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি গোয়েন্দা পুলিশ। হত্যা মামলার প্রধান আসামি ব্যবসায়ী জহিরুল ইসলাম পলাশকেও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। হত্যাকারীকে গ্রেফতার ও মামলার তদন্ত দ্রুত নিষ্পত্তি করার জন্য মামলাটি ডিবিতে হস্তান্তর করা হলেও এখনো কোন সুফল মেলেনি। তদন্ত সংস্থা ডিবির কর্মকর্তাদের দাবি, তারা ঘাতক জহিরুলকে গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছেন। বারবার স্থান পরিবর্তন করার এখনো তাকে গ্রেফতার করা হয়নি হয়নি।
কলেজ শিক্ষিকা কৃষ্ণা কাবেরী বিশ্বাস হত্যাকাণ্ডের পর গুরুতর আহত তার স্বামী বিআরটিএ কর্মকর্তা শীতাংশু শেখর বিশ্বাস এবং তার দুই মেয়ে শ্রাবণী বিশ্বাস শ্রতি (১৪) ও অত্রি বিশ্বাস (৮) চিকিৎসা শেষে বাসায় ফিরেছেন। মোহাম্মদপুর এলাকায় নতুন বাসা নিয়ে দুই মেয়েসহ সেখানেই থাকছেন। ওই ঘটনায় তারা তিনজনই আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। সেখান থেকে তারা ঘটনাস্থল মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডের ওই ভাড়া বাসায় ফেরেননি। যে ফ্ল্যাটে ঘটনাটি ঘটেছে ওই ফ্ল্যাটটি কয়েকদিন আগে মালিকের কাছে হস্তান্তর করেছে পুলিশ।

No comments

Powered by Blogger.