বায়তুল মোকাররম মসজিদে ইমামের পদোন্নতি নিয়ে নানা অভিযোগ by আহমেদ জামাল

জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে এক পেশ ইমামের পদোন্নতি নিয়ে নানা অভিযোগ উঠেছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে  কম যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে পদোন্নতি দেয়ায় মসজিদের অন্য তিন ইমাম ও তিন ইমাম মুয়াজ্জিনসহ সংশ্লিষ্টদের মাঝে চরম অসন্তোষ এবং ক্ষোভ বিরাজ করছে। এদিকে সার্ভিস রুলস অনুযায়ী  যেই ডিগ্রি দিয়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদের মুয়াজ্জিন হতে পারে না সেই ডিগ্রি দিয়ে ইমাম নিয়োগ  দেয়া হয়েছে। গত ১৫ই মে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে মহাপরিচালক সামিম মুহাম্মদ আফজাল মাওলানা মিজানুর রহমানকে বায়তুল মোকাররম মসজিদের সিনিয়র পেশ ইমাম পদে পদোন্নতি দেন। মিজানুর রহমান বর্তমানে দশম গ্রেডভুক্ত পেশ ইমাম। ২০০৬ সালের ২৬শে জুন সিনিয়র পেশ ইমামের স্কেল ৫ম গ্রেডে ও পেশ ইমামের স্কেল ৬ষ্ঠ গ্রেডে উন্নীত করা হয়েছে। মাওলানা মিজানুর রহমানের ৬ষ্ঠ গ্রেড স্কেল পাওয়ার যোগ্যতা না থাকার পরও তাকে ৬ষ্ঠ গ্রেডের স্কেলে বেতন দেয়া হয়। তার পদটি ৫ম গ্রেডভুক্ত সিনিয়র পেশ ইমাম পদের ফিডার পদ নয়। এজন্য তাকে ৫ম গ্রেডভুক্ত সিনিয়র পেশ ইমাম পদে পদোন্নতি দেয়া যায় না। জাতীয় বেতন স্কেল ২০০৯ এর ১০নং অনুচ্ছেদে পদের পূর্ণ বেতন প্রাপ্তির শর্তাবলীতে লেখা আছে যে, ৫ম গ্রেডে বেতন পাওয়ার জন্য প্রথম শ্রেণীর পদে দশ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতার শর্ত রয়েছে, যেহেতু তিনি এখনও ১০ম গ্রেডের পেশ ইমাম, ১০ম গ্রেড হলো ২য় শ্রেণীর  স্কেল, সেহেতু ১০ম গ্রেড থেকে ৫ম গ্রেডে পদোন্নতি পাওয়ার কোন বিধান নেই।  এছাড়া এ পদোন্নতিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিধান অনুসরণ করা হয়নি। ইফার সার্ভিস রুলসের ‘পদোন্নতির মাধ্যমে নিয়োগ’- অনুচ্ছেদে লেখা আছে যে, জ্যেষ্ঠতা ও মেধার ভিত্তিতে পদোন্নতির মাধ্যমে নিয়োগ করা হইবে। অথচ এই পদোন্নতিতে ওই বিধি লঙ্ঘন করা হয়েছে। কেননা বিদ্যমান সমস্ত ইমাম প্রথম শ্রেণীর দাওরায়ে হাদিসের অধিকারী হলেও মাওলানা মিজানুুর রহমান একমাত্র ২য় শ্রেণীর দাওরায়ে হাদিসের অধিকারী। তিনি সব ইমামের মধ্যে কম যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি। চাকরিতে সিনিয়রিটির দিক থেকেও তিনি জুনিয়র। এছাড়া পেশ ইমাম হিসেবে নিয়োগের বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ ছিল বলেই তার পেশ ইমাম হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার বিষয়টিকে রিট মোকাদ্দমা নং ৮২৪৭/২০০৭ এর মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে যা এখনও বিচারাধীন। ওই রিটে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইমামের নির্বাচনী পরীক্ষায় শিক্ষাগত যোগ্যতার জন্য বিশ নম্বর রাখা হয়েছিল। যথাক্রমে দাখিল, আলিম, ফাযিল, কামিল। প্রত্যেকটি স্তরের ১ম শ্রেণীর জন্য ৫, ২য় শ্রেণীর জন্য ৪, ৩য় শ্রেণীর জন্য ৩ নির্ধারণ করা হয়েছিল। মাওলানা মিজানুর রহমান দরখাস্তে মাত্র দুটি সার্টিফিকেট দাখিল করেছিলেন তথা ফাযিল ও তাকমিল যা ২য় শ্রেণী। সেই হিসেবে তার শিক্ষাগত যোগ্যতার নম্বর পাওয়ার কথা ছিল ৮, কিন্তু তাকে দেয়া হয়েছে ২০। তাকে শিক্ষাগত যোগ্যতার জন্য সঠিক নম্বর দেয়া হলে তিনি ১ম হওয়া তো দূরের কথা প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে কম নম্বর হতো তার। তবে কোন ১ম শ্রেণী না থাকা সত্ত্বেও তাকে শিক্ষাগত যোগ্যতার পরিপূর্ণ নম্বর দিয়ে ১ম করা হয়েছে। মিজানুর রহমান হিফজুল কোরআন, কেরাত, মিশকাত, দাওরায়ে হাদিসে পরীক্ষা দেয়ার জন্য বেফাকে যে নিবন্ধন করেছেন সে নিবন্ধন বহিতে তার জন্ম তারিখ ১৬/০৫/১৯৭৪ ইং। ২০০৫ সালের ২রা আগস্ট পেশ ইমাম নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর ওই সালের ৯ই আগস্ট জন্ম তারিখ ১৯৭৪ ইং পরিবর্তন করে ১৯৭৭ ইং করেন। কোন এফিডেভিট ছাড়া শুধু পেশ ইমাম পদে বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আবেদনের যোগ্যতা অর্জনের জন্য এরকম জন্ম তারিখ পরিবর্তন করে জন্ম সনদ অর্জন অনৈতিক বলে অনেকের অভিমত! অনিয়মতান্ত্রিকভাবে জন্ম তারিখ পরিবর্তন করে ২০০০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মাওলানা ওয়ালিউর রহমান পেশ ইমাম পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। ২০০৩ সালে জোট সরকার জন্ম তারিখ পরিবর্তন করার কারণে তাকে চাকরিচ্যুত করে। সংশ্লিষ্টরা জানান, মহাপরিচালক শুধু সিনিয়র পেশ ইমাম পদে পদোন্নতি প্রদানে দুর্নীতি করেছেন তাই নয় এর আগে তিনি ২০১২ সালের ৮ই এপ্রিল দুর্নীতির মাধ্যমে দুজন পেশ ইমামও নিয়োগ করেছিলেন। একজন তার ভাগিনা মাওলানা এহছানুল হক। তাকে নিয়োগ দেয়ার জন্য তখন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রদান থেকেই অনিয়মের আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। ২০১১ সালের ২৯শে মে প্রকাশিত ওই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে কেউ যেন দরখাস্ত করতে আগ্রহী না হয় তার জন্য স্কেল লেখা হয়েছিল ৬ষ্ঠ গ্রেড যা প্রথম শ্রেণীর প্রবেশ পদের তথা ৯ম  গ্রেডের তিন ধাপ উপরে। তার পরেও উক্ত পেশ ইমাম পদটিকে লিখা হয়েছিল ২য় শ্রেণী। এ রকমভাবে আগের নিয়োগবিধিতে অনূর্র্ধ্ব বয়স ত্রিশ থাকলেও পেশ ইমামদের বেতন স্কেল আপগ্রেড করার সময় নিয়োগবিধি পরিবর্তন করে শিক্ষাগত যোগ্যতা ২য় শ্রেণীর স্থলে ১ম শ্রেণী ও অভিজ্ঞতা ৫ বছরের ক্ষেত্রে ৮ বছর, বয়স অনূর্ধ্ব ত্রিশ এর স্থলে চল্লিশ করা হয়। এতে করে যোগ্য প্রার্থীরা একদিকে দরখাস্ত করতে পারেন নাই, অন্যদিকে ত্রিশ বছরের বয়সীদের মধ্যে ৮ বছরের ১ম  শ্রেণীর কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রার্থী পাওয়া না যাওয়ায় তার ভাগিনা মাওলানা এহছানুল হকের ছাত্রকালীন সময়কে অভিজ্ঞতা দেখিয়ে এবং তার দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রি কামিল সমমান না হওয়া সত্ত্বেও তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। এ সংক্রান্ত একাধিক রিপোর্ট মানবজমিন-সহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছিল। ওই দুই ইমাম নিয়োগে দুর্নীতির বিষয় উচ্চ আদালতে রিট হয়। এছাড়া দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রিধারী তিন ইমামের নিয়োগের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট রুল জারি আছে।
এদিকে মিজানুর রহমানকে পদোন্নতি দিয়ে ওই পদ শূন্য ঘোষণা করে পেশ ইমাম পদে নিয়োগ দেয়ার জন্য গত ৭ই মে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়, যদিও তার পদটি বিচারাধীন। উক্ত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ৬ষ্ঠ গ্রেড স্কেল উল্লেখ ছিল, তবে এবারের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে পদটি ২য় শ্রেণী বলে উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতেও শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা উল্লেখ করা হয়েছে নিয়োগবিধি অনুযায়ী আর বয়স উল্লেখ করা হয়েছে আগের নিয়োগবিধি অনুযায়ী ত্রিশ বছর যাতে করে বিজ্ঞপ্তিতে কামিল, আরবি বা ইসলামী বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি। ওই পদের যোগ্যতা ধরা হলেও কামিল বা আরবি বা ইসলামী বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রিধারীরা এই বয়সে আট বছরের অভিজ্ঞতা দেখিয়ে দরখাস্ত করতে না পারেন। অন্যদিকে দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রি প্রদানে সরকারের কোন সংশ্লিষ্টতা না থাকার কারণে এই ডিগ্রিধারীরা যখন যেখানে যেভাবে প্রয়োজন বয়স পরিবর্তন করিয়ে সার্টিফিকেট ইস্যু করিয়ে নেন। বিজ্ঞপ্তিতে কামিল, আরবি বা ইসলামী বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি পদের যোগ্যতা ধরা হলেও এই পর্যন্ত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পেশ ইমাম পদে কোন কামিল বা মাস্টার্স ডিগ্রিধারী নিয়োগ পাননি। বরং বিজ্ঞপ্তিতে ১ম শ্রেণীর কামিল সমমান দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রীর কথা উল্লেখ থাকার কারণে দাওরায়ে হাদিস কামিল সমমানের না হলেও দাওরায়ে হাদিস যা কামিল সমমান নয় তাকেই নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। একদিকে দাওরায়ে হাদিস পেশ ইমাম পদের যোগ্যতা হওয়ার জন্য কামিল সমমান হওয়ার শর্ত দেয়া হয়েছে, অন্যদিকে নিয়োগ দেয়ার সময় দাওরায়ে হাদিস কামিল সমমান হওয়ার বিষয়টি সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে কিনা সেটা দেখা হচ্ছে না। অথচ  ইফার সার্ভিস রুলস অনুযায়ী সমমান মাদ্‌রাসা ডিগ্রি অর্থ সরকার কর্তৃক সমমান বলে ঘোষিত কোন মাদ্‌রাসা সার্টিফিকেটকে বুঝায়। এ অবস্থায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে কামিল সমমান দাওরায়ে হাদিস  লেখার কারণে দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রি সরকার কর্তৃক কামিল সমমান ঘোষিত না হওয়ায় শুধু দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রি নিয়ে আবেদনকারীদেরকে নিয়োগ দেয়া দূরের কথা বাছাইয়ের মধ্যে বাদ পড়ার কথা। অথচ তাদেরকেই নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।
সংস্থার মহাপরিচালক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার সম্পর্কের জোর দেখিয়ে সমস্ত অনিয়ম করে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। যা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ছয় লাখ টাকা দামের চায়না মেশিন বসিয়ে পৌনে দুই কোটি টাকার বিল পরিশোধ, ও এম আর মেশিন ক্রয় করে চার কোটি টাকা আত্মসাৎ, নিয়োগ বাণিজ্য, আত্মীয়করণ, ঢাকা মহানগরীতে গণশিক্ষার দুই হাজার ও চট্টগ্রামে দেড় হাজার কেন্দ্র পরিচালনার নামে ৭০ কোটি টাকা আত্মসাৎ, ডিপিপি উপেক্ষা করে মসজিদ ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্পে নির্ধারিত পদের অতিরিক্ত পদে ৩৮ জন ফিল্ড অফিসার, ফিল্ড সুপারভাইজার নিয়োগ এবং মাস্টার ট্রেইনার পদে মৌখিক নির্দেশে চাকরি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে গণমাধ্যমে। এসব অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত হয়েছিল বহুবার। কিন্তু তার দাপটের সামনে সব চাপা পড়ে যায় এমন অভিমত সংশ্লিষ্টদের।

No comments

Powered by Blogger.