‘রোহিঙ্গা সংকট সুনামির চেয়েও ভয়াবহ’

ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের তামিয়াং-এ সাগর থেকে ৪৭ বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়েছিল। তাদের নিদারুণভাবে সাহায্য প্রয়োজন ছিল তখন। শনিবার তাদের উদ্ধার করা হয়। এরপর তামিয়াং ফার্মার্স অ্যান্ড ফিশারম্যান অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান মোহাম্মদ হেন্দ্রা তার সংগঠনের সবার মোবাইল ফোনে একটি বার্তা পাঠান। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশীদের জন্য স্থানীয় মানুষজন প্রচুর কাপড়-চোপড় দান করেন। সেসবের পরিমাণ এত বেশি ছিল যে, এক পর্যায়ে থামার নির্দেশ দিতে হয়েছিল হেন্দ্রাকে। এর বাইরে ৩০ কেজি চাল, নুডলস, অর্থ দান করা হয়েছিল। নিজের বার্তায় হেন্দ্রা লিখেছিলেন উদ্ধারকৃত অভিবাসীদের সবার পা খালি। তাই অনেকে জুতাও নিয়ে এসেছিলেন। দ্যা সিডনি মর্নিং হেরার্ল্ডে এক মতামত কলামে এমনটি লিখেছেন পত্রিকাটির ইন্দোনেশিয়া প্রতিনিধি জুয়েল টপস্ফিল্ড।
হেন্দ্রা বলেন, আপনি জানেন যে, তারা নৌকায় অনেকক্ষণ ধরে ছিল। তাদের সবকিছুই হারিয়ে গেছে। আমরা তাদের জন্য দুঃখবোধ করছিলাম। এ অসাধারণ উদারতা তামিয়াং-এর যে মানুষগুলো দেখিয়েছিল, তারা নিজেরাও কিন্তু দরিদ্র। তামিয়াং-এর মানুষজন বহুদিন ধরে দুঃখ-দুর্দশায় অভ্যস্ত। ২০০৪ সালের সুনামিতে প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন তারা। এরপর ২০০৬ সালের ভয়াবহ বন্যার শিকারও তারা হয়েছিলেন। হেন্দ্রা বলেন, এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় আমাদের বাইরের মানুষরা সাহায্য করেছিলেন। এদের অনেকে আচেহর বাইরের মানুষ। অনেকে আবার বিদেশী। আমাদের ধর্ম ও পরিচয় জানতে চাননি কেউ। সবাই আমাদের সাহায্য করেছিলেন। আর এখন আমরা বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গাদের অসহায় অবস্থায় আমাদের ভূমিতেই দেখতে পেলাম। তারা হয়তো কয়েক সপ্তাহ কিংবা মাস ধরে সাগরে পড়ে ছিল। সুনামিতে আমরা যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলাম, তার চেয়েও তাদের পরিস্থিতি খারাপ।  আচেহর মানুষজন সুনামিকে সৃষ্টিকর্তার শাস্তি হিসেবে ভেবে থাকেন, ব্যাখ্যার সুরে বললেন হেন্দ্রা। অথচ তিনি দেখলেন, রোহিঙ্গারা রাখাইন বৌদ্ধদের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে। তারা নিজেদের দেশেই বর্ণবিদ্বেষের মধ্যে থাকছে। একে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার আক্রোশের চেয়েও মারাত্মক মনে হয়েছে হেন্দ্রার কাছে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের শাস্তি দিয়েছে মানুষ। তাদের ধর্মের কারণে তাদেরকে নিজ দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সুনামির সময় আমাদের বেলায় স্বয়ং স্রষ্টা যা করেছিলেন, আমি মনে করি তার চেয়ে বেশি শাস্তি মানুষ মানুষকে দেয়। হেন্দ্রা জানতে পেরেছেন, নৌকায় থাকার সময় অনেক রোহিঙ্গা হত্যা ও ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তার ভাষ্য, নৌকার মধ্যেই সবকিছু হয়েছে। সপ্তাহ-মাস জুড়ে প্রতিদিন খারাপ কাজ করা হয়েছে তাদের সঙ্গে। আমি তাদের মানসিক অবস্থা উপলব্ধি করতে পারছি না।
তামিয়াং থেকে গাড়ি চালিয়ে এক ঘণ্টা দূরের পথ আচেনিজ শহর লাংসা। সেখানে ইতিমধ্যে ৬০০ অভিবাসীকে উদ্ধার করা হয়েছে। হেন্দ্রা জানালেন, যে ৪৭ জনকে তারা উদ্ধার করেছেন, তারা হয়তো ওই বড় গোষ্ঠীরই একটি অংশ। সবার জন্য চাল, সাবান, পানি, বিছানা, অর্থ, নুডলস সব এখনও তামিয়াংবাসী দান করে যাচ্ছেন। তবে এখন স্কার্ফ, নামাজের বিছানা ও কোরআনের অভাব দেখা দিয়েছে। হেন্দ্রার মতে, আচেহর মানুষদের মতো রোহিঙ্গারাও মুসলিম। তিনি বলেন, আচেহকে দেখা হয় মক্কার বারান্দা হিসেবে। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে প্রত্যাখ্যান করেছে। এমনকি আমাদের নিজেদের নৌবাহিনীও তাদের দূরে ঠেলে দিয়েছে। আমি বুঝি না, কেন নৌবাহিনী এমন করলো। কিন্তু আচেহর মানুষ অভিবাসীদের সাহায্য করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে অভিযোগ তুলেছেন, আচেহর মানুষরা রোহিঙ্গাদের প্রতি খুব দ্রুত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন কারণ তারা মুসলিম। কিন্তু এ দাবির সঙ্গে একমত নন হেন্দ্রা। তার ভাষ্যে, আমরা সাহায্য করেছি। এর প্রথম কারণ মানবতা। দ্বিতীয়ত, তারা মুসলিম। তাদের কিছু আবার অমুসলিমও। কিন্তু আমরা তাদের সাহায্য করেছিলাম কারণ আমরা সবাই মানুষ।

No comments

Powered by Blogger.