চট্টগ্রাম সিটি, জয়-পরাজয় ঠিক হবে নেতিবাচক ভোটে! by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মনজুর আলম ও আ জ ম নাছিরের মূল আকর্ষণী ক্ষমতা ও ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করার চেষ্টা করেছি। সদ্য সাবেক মেয়র মনজুর আলম সৎ, বিনয়ী ও সজ্জন ব্যক্তি—এ বিষয়ে দ্বিমত নেই কারোরই। তাঁর সম্পর্কে দুর্নীতির বড় ধরনের অভিযোগ যেমন কখনো ওঠেনি, তেমনি সিটি করপোরেশনকে দলীয় কর্মীদের প্রভাবমুক্ত রাখতে পারার সাফল্যও দেখিয়েছেন তিনি। কোনো ধরনের বিরোধ ও শত্রুতার পরিবেশ তৈরি না করেই তাঁর পূর্বসূরির উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছেন মনজুর আলম। নানা জনহিতকর কর্মকাণ্ডের সুবাদে এলাকায় তাঁর ও তাঁর পরিবারের সুনাম ছিল। ফলে দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ড থেকে তিনবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। মূলত আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত থাকলেও গত নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপি তাঁকে সমর্থন জানালে নতুন ধরনের মেরুকরণ হয় এবং হেভিওয়েট প্রার্থী মহিউদ্দিন চৌধুরীকে হারিয়ে চমক সৃষ্টি করেন তিনি।
অন্য দিকে নাছির তুলনামূলক নবীন ও প্রাণচঞ্চল। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি করে এসেছেন তিনি। ১৯৮০ ও ১৯৮২ সালে দুই দফায় নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। পরে দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও সাংগঠনিক কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদ পাননি। কিন্তু দলের ছাত্র ও যুবকদের একটি বড় অংশের মধ্যে তাঁর প্রতি আস্থা ও সমর্থন ছিল ঈর্ষণীয়।
ফলে দীর্ঘ বঞ্চনার পর ২০১৩ সালে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ লাভ তাঁর অনিবার্য প্রাপ্তিই বলা যেতে পারে। রাজনীতির অঙ্গন ছাড়া ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও আ জ ম নাছিরের পরিচিতি আছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সহসভাপতি, জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক, জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইত্যাদি পদে অধিষ্ঠিত থাকার ফলে তাঁর একটি তারুণ্যদীপ্ত ভাবমূর্তি আছে।
এই সদর্থক দিকগুলো আলোচনার পর স্বাভাবিকভাবে এই দুই প্রার্থীর সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতার প্রসঙ্গটি আসবেই। তবে সেই ধান ভানার কাজে যাওয়ার আগে একটু শিবের গীত হয়ে যাক।
মহিউদ্দিন চৌধুরী তৃতীয় দফায় মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর এমন কিছু পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যা চট্টগ্রামের সচেতন নাগরিক সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, প্রকৌশলী ও নগর উন্নয়ন ভাবনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নাগরিকদের সংগঠন ‘ফোরাম ফর প্ল্যান্ড চিটাগং (এফপিসি)’ বিভিন্ন সময়ে এসব উদ্যোগের বিরোধিতা করেছেন এবং বিকল্প পরামর্শও দিয়েছেন। কিন্তু এসব পরামর্শে কর্ণপাত না করেই তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকেছেন।
এমনকি আজীবন অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করেও হিন্দু সম্প্রদায়ের গো-শালা হিসেবে পরিচিত একটি জমি সিটি করপোরেশনের দখলে নিয়ে স্থাপনা নির্মাণের উদ্যোগ নিয়ে এই সম্প্রদায়ের একাংশেরও বিরাগভাজন হয়ে পড়েছিলেন তিনি। তাই চতুর্থবারের মতো নির্বাচনে এই জনপ্রিয় ব্যক্তিটি যখন হারলেন তাঁরই এক কালের শিষ্য ও তাঁর তুলনায় অনেক নিষ্প্রভ মনজুর আলমের কাছে, তখন বিস্মিত হননি এ নগরের মানুষ। এ ফলাফলকে দম্ভের কাছে বিনয়ের হার বলে মনে করেছিলেন নাগরিকেরা। পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছিলেন অনেকেই। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, আশাবাদী মানুষেরা প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব মেলাতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত হতাশই হয়েছেন।
অন্যান্য অবকাঠামোগত সাফল্যের কথা বাদ দিলেও মহিউদ্দিন চৌধুরীর আমলে সেবা ও চিকিৎসা খাতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাফল্য ছিল রীতিমতো বিস্ময়কর। করপোরেশনভুক্ত স্কুল-মাদ্রাসা-মক্তবের মান বৃদ্ধির পাশাপাশি অনেক কলেজ স্থাপন করে, সর্বোপরি এর সুষ্ঠু পরিচালনা নিশ্চিত করে নিজেকে নূর আহমদ চেয়ারম্যানের সার্থক উত্তরসূরি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন মহিউদ্দিন। করপোরেশন পরিচালিত হাসপাতাল ও মাতৃসদনগুলোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সেবার মান বেসরকারি ক্লিনিকগুলোর কাছে হয়ে উঠেছিল ঈর্ষণীয়।
চট্টগ্রামে প্রথম ও সর্ববৃহৎ সিএনজি স্টেশন স্থাপন, লাশ পরিবহনের জন্য শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গাড়ির ব্যবস্থা, গণশৌচাগার নির্মাণ ছিল তাঁর সময়োপযোগী ও জনকল্যাণমূলক কাজের নমুনা। অবৈধ স্থাপনা ভেঙে মহিউদ্দিন রাস্তাঘাট নির্মাণের সাহসী উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলেই আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, ও. আর. নিজাম রোড, পাহাড়তলীসহ অনেক প্রশস্ত সড়ক জন ও যান চলাচলের উপযোগী হয়েছে।
এসব দিক বিবেচনা করলে সদ্য সাবেক মেয়র মনজুর আলমের মেয়াদকালে সিটি করপোরেশনের সেবার মান যে কমেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হাসপাতাল ও মাতৃসদনগুলোর অবস্থা করুণ। এমনকি আবর্জনা অপসারণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য যে নগরটি সারা দেশের রোল মডেলে পরিণত হয়েছিল, সেটি এখন প্রায় ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে বলা চলে।
এসব ব্যর্থতার জন্য বিরোধীদলীয় মেয়রের প্রতি সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণ ও উন্নয়নকাজে অর্থ বরাদ্দের অপ্রতুলতার কথা তুলতে পারেন অনেকেই। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও স্মরণে রাখতে হবে যে তিনটি নির্বাচনে মহিউদ্দিন মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন তার মধ্যে দুটিই অনুষ্ঠিত হয়েছে এমন সময়ে, যখন তাঁর দল আওয়ামী লীগ ছিল বিরোধী দলে। অর্থাৎ সরকারের প্রথামাফিক বিমাতাসুলভ আচরণের শিকার হয়েছিলেন তিনিও। তাতে উন্নয়ন তৎপরতা রুদ্ধ করা যায়নি।
বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী মনজুর আলম সৎ, বিনয়ী ও সজ্জন ব্যক্তি এ কথা শুরুতেই বলেছি। কিন্তু যেখানে তাঁর ঔদার্য ও সাফল্য, সম্ভবত সেখানেই তাঁর ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতা। দাপুটে মহিউদ্দিন যে কঠোর শৃঙ্খলায় সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিচালনা করেছেন, সেই কঠোর পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেননি বলেই প্রশাসন থেকে মাঠপর্যায় পর্যন্ত কর্মীদের মধ্যে শৈথিল্য দেখা গেছে, যার ফলে সেবার মান হয়েছে নিম্নমুখী। সরকারি দলের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে সিটি করপোরেশনকে অবজ্ঞা করে বা সেই প্রতিষ্ঠানটির ওপর প্রভার বিস্তার করে যারা শহরজুড়ে যত্রতত্র বিলবোর্ড স্থাপন করে প্রায় অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ার মতো দৃঢ়তা দেখাতে পারেননি তিনি। সম্প্রতি নতুন পুলিশ কমিশনার এসে নিজ উদ্যোগেই এসব বিলবোর্ড উচ্ছেদ করে তাঁর সেই ব্যর্থতাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন যেন। মোট কথা, নগরপিতা হিসেবে এই নগরের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছেন মনজুর।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী আ জ ম নাছিরের সবচেয়ে বড় সাফল্য দলের তরুণদের আনুগত্য লাভ করা এবং নিজের তারুণ্যদীপ্ত কর্মচঞ্চল একটি ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারা। গত ১০ বছরে এই নগরে ভোটারসংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৬ লাখ ৭৬ হাজার। অর্থাৎ এই বিশাল অঙ্কের ভোটারদের অধিকাংশের বয়স ১৮ থেকে ২৮-এর মধ্যে। সুতরাং তরুণদের সমর্থন লাভের ওপর নির্বাচনের জয়-পরাজয় অনেকটাই নির্ভরশীল। কিন্তু ঠিক এই জায়গাটিতেই নাছিরের দুর্বলতার ক্ষেত্রটিও নিহিত বলে আমাদের ধারণা।
ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক বেশ কিছু কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। অন্তর্দলীয় কোন্দলে, টেন্ডার দখলের জন্য নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে, সাংবাদিক নির্যাতনসহ নানা উচ্ছৃঙ্খলতার কারণে সংবাদের শিরোনাম হয়েছে সরকারি দলের ছাত্র-যুবক-তরুণ নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা। মহিউদ্দিন ও মনজুর এ ধরনের কর্মী-সমর্থকদের নগর ভবনে ঘেঁষতে দেননি, সাবেক রাজনীতিক ও বর্তমান ঠিকাদারদের রাখতে পেরেছেন সহনীয় দূরত্বে। নাছিরের পক্ষে সেটা কতটা সম্ভব হবে, সে সংশয়টা ভোটারদের মনে আসতেই পারে।
দেখেশুনে মনে হচ্ছে, এবার নির্বাচনে পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে রায় দেওয়ার চেয়ে অপছন্দের প্রার্থীর বিপক্ষে রায় দেওয়ার তাগিদই যেন বেশি ভোটারদের। পরিতাপের বিষয়, সম্ভবত নেগেটিভ (নেতিবাচক) ভোটই হতে যাচ্ছে এবার জয়-পরাজয়ের নিয়ামক।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.