খালেদার গাড়িবহরে আক্রমণ, হামলাকারীরা চিহ্নিত তবুও ব্যবস্থা নেই

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার গাড়ি বহরে তিন দিনে তিন দফা হামলা হয়েছে। গাড়িবহরে যারা হামলা চালিয়েছে তাদের বেশির ভাগেরই ছবি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। পাওয়া গেছে তাদের নাম-পরিচয়ও। পুলিশ ভিডিও ফুটেজ ও স্টিল ছবি সংগ্রহ করেছে। প্রথম দিনে হামলার তিন দিন পেরিয়ে গেছে। তবু পুলিশ তাদের কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এমনকি সোমবারের প্রথম দফা হামলার পর পরের দুই দিন মঙ্গল ও বুধবারেও হামলার ঘটনা ঘটেছে। তাদেরও নাম-পরিচয়-ছবি প্রকাশ হয়েছে গণমাধ্যমে। তাদের গ্রেপ্তার তো দূরের কথা, হামলাকারীরাই উল্টো মামলা করে বুক ফুলিয়ে ঘুরছে নিজ নিজ এলাকায়। অভিযোগ রয়েছে, হামলায় সরকারি দলের নেতাকর্মীরা অংশ নেয়ায় পুলিশ তাদের চিনেও না চেনার ভান করছে। উল্টো হয়রানি করতে হামলাকারীদের দিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী জোটের শীর্ষ নেতার ওপর দিন-দুপুরে এমন ন্যক্কারজনক হামলার পরও দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা না নেয়ায় আইনের শাসন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত সোমবার বিকালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের পক্ষে প্রচারণায় মাঠে নামেন বেগম খালেদা জিয়া। বিকাল ৫টা ২০ মিনিটে খালেদার গাড়িবহর কাওরানবাজারের ভেতর দিয়ে অতিক্রম করছিল। এ সময় তেজগাঁও-কাওরানবাজার এলাকার স্থানীয় ছাত্রলীগকর্মী ও আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা প্রথমে কালো পতাকা প্রদর্শন করেন। একপর্যায়ে তারা মিছিল করতে করতে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরের সামনে গিয়ে ভাঙচুর শুরু করেন। গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়া বিভিন্ন ফুটেজ ঘেঁটে দেখা যায়, কারওয়ানবাজারের হামলায় অংশ নেয়াদের মধ্যে ছিলেন- ঢাকা উত্তর ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজান, উত্তরের ছাত্রলীগ নেতা মাহমুদ তুহিন, কাওরানবাজারের ২৬ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রেজওয়ানুল হক রোমান, একই ওয়ার্ডের সহসভাপতি মোহাম্মদ জাকির, একই ওয়ার্ডের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ও ১ নং ইউনিটের সহসভাপতি আল-আমিন, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্রলীগের সভাপতি জাকির হোসাইন সাগর ও ছাত্রলীগকর্মী মোহন। হামলায় অংশ নেয়া অন্যদের মধ্যে তেজতুরী বাজার ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আলী হোসেন সিজান ও বাউলবাগ ইউনিটের ছাত্রলীগ সভাপতি রনি খন্দকারও ছিলেন। স্থানীয় সূত্র জানায়, স্থানীয় যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও শ্রমিক লীগের অলি, দোলনসহ ৩০-৩৫ জন নেতাকর্মী এই হামলায় অংশ নেন বলে জানা গেছে। এছাড়া ২৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি জহিরুল ইসলাম জিল্লুও ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। যদিও তিনি নিজেই উল্টো বিএনপি চেয়ারপারসনের নিরাপত্তারক্ষী (সিএসএফ) ও অজ্ঞাতনামা ছাত্রদল, যুবদল নেতাকর্মীদের নামে মামলা করেছেন। অপরদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে চেয়ারপারসনের নিরাপত্তাবিষয়ক প্রধান সমন্বয়কারী মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবর বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। দুটি মামলারই তদন্ত কর্মকর্তা তেজগাঁও থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মনসুর হোসেন মানিক। তিনি বলেন, এ ঘটনায় কারা আগে হামলা চালিয়েছিল এবং হামলায় কারা অংশ নিয়েছিল তা এখনও শনাক্ত করা যায়নি। তবে হামলাকারীদের শনাক্তের জন্য একটি ভিডিও ফুটেজ ও বিভিন্ন পত্রিকার এ সংক্রান্ত কাটিং সংগ্রহ করা হয়েছে। এছাড়া আরও ভিডিও ফুটেজের জন্য গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগে আবেদন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ঘটনাটি স্পর্শকাতর বিষয়। এখানে রাজনৈতিক বিষয় রয়েছে। মামলার তদন্তের বিষয়টি সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে তদারক করা হচ্ছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, অন্য কোন ঘটনা হলে তিন দিন নয়, ঘটনার রাতেই হামলাকারীরা গ্রেপ্তার হয়ে যেতো। হামলাকারীদের সবার ছবিই বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মাধ্যম ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। কারা হামলা ঘটিয়েছে তা দিনের আলোর মতে পরিষ্কার। জানতে চাইলে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি ঠিকই তবে ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেখে আমরা হামলাকারীদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছি। ইতিমধ্যে কয়েকজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের অবস্থান জানার চেষ্টা চলছে। ডিসি বলেন, এ ঘটনায় দুই পক্ষ থেকে দুটি মামলা হয়েছে। দুটি মামলাই গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। হামলার আগে কেউ তাদের উসকানি দিয়েছিল কি না তাও গুরুত্ব দিয়ে দেখছে পুলিশ। কাওরানবাজারের স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, হামলার ঘটনায় যাদের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তারা সবাই নিজ নিজ এলাকায় অবস্থান করছে।
সংশ্লিস্ট সূত্র জানায়, বাংলামোটরে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি মামুনুর রশীদ, সাংগঠনিক সম্পাদক মশিউর রহমান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পরিকল্পনা ও কর্মসূচি বিষয়ক সম্পাদক আশিকুল পাঠানকে হামলায় নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে। এছাড়া যেই যুবকের কোমরের পেছনের দিকে পিস্তল গুঁজে রাখা অবস্থায় দেখা গেছে, এসময় তার পাশে একজন পুলিশ কর্মকর্তাও ছিলেন। আশিকুল ছাত্রলীগের কর্মী বলে জানা গেছে। তবে তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। অন্য একটি ছবিতে তাকে আওয়ামীপন্থি এক কাউন্সিলর পদপ্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণায় দেখা গেছে।
বাংলামোটরে হামলার ঘটনায়ও পাল্টাপাল্টি মামলা: এদিকে গত বুধবার বাংলামোটরে খালেদার গাড়িবহরে তৃতীয় দফা হামলার ঘটনায় রমনা থানায়ও পাল্টাপাল্টি মামলা হয়েছে। এ ঘটনাতেও হামলার পর হামলাকারীরাই আগে গিয়ে থানায় মামলা করেন। মামলার নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, গতকাল সকাল সাড়ে ৮টায় শাহবাগ থানা ছাত্রলীগের ক্রীড়া সম্পাদক বাবু হাসান বাদী হয়ে রমনা থানায় একটি মামলা (নং ২৮) দায়ের করেন। মামলায় অজ্ঞাত পরিচয় ৩০-৪০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে। মামলার এজাহারে বাবু হাসান দাবি করেন, বুধবার বিকাল ৫টায় ঢাকা দক্ষিণের মেয়র পদপ্রার্থী সাঈদ খোকনের নির্বাচনী লিফলেট বিলির সময় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গাড়ি তার কর্মীদের হত্যার উদ্দেশ্যে চাপা দেয়। এতে বাবু নিজেসহ লিটন ও জাকির দেওয়ান মাটিতে পড়ে গিয়ে আহত হন। এর প্রতিবাদ করলে গাড়িতে থাকা বিএনপির শীর্ষ নেতাদের হুকুমে সিএসএফ সদস্যসহ অজ্ঞাতনামা ২০-২৫ জন বিএনপির নেতাকর্মী শটগান ও লাঠিসোটা দিয়ে তাদের আঘাত করে। এতে লিটন ও জাকির মারাত্মক জখম হন। এছাড়া সাঈদ খোকনের লিফলেট কেড়ে নিয়ে কর্মীদের হত্যার হুমকি দেয়া হয় বলেও এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
অপরদিকে গতকাল সকাল পৌনে ৯টার দিকে বিএনপির পক্ষ থেকে সাবেক আইজিপি ও সচিব এবং বিএনপির উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আব্দুল কাইয়ুম বাদী হয়ে একটি মামলা (নং ২৯) দায়ের করেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা ৪০-৫০ জন আওয়ামী সন্ত্রাসীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, বুধবার বিকাল ৫টার পর ভোটের প্রচারে থাকা খালেদা জিয়ার গাড়িবহর বাংলামোটর এলাকা পার হওয়ার সময় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে বাঁশ, গজারির লাঠি, লোহার রড ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। তারা হিংস্রভাবে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরের গাড়ি ভাঙচুর করতে থাকে। একপর্যায়ে সন্ত্রাসীরা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে বেপরোয়াভাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-২৬১২ নম্বর গাড়ির চতুর্দিক থেকে হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ শুরু করে। এতে তার গাড়ির বাম দিকের গ্লাস ভেঙে যায়। রড ও লাঠিসোটা দিয়ে পিটিয়ে গাড়ির একটি অংশ খুলে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। সন্ত্রাসীদের আঘাতে খালেদা জিয়ার নিরাপত্তাকর্মী আতিক গুরুতর আহত হন এবং তার কোমর ভেঙে যায়। অপর নিরাপত্তাকর্মী মেজর (অব.) মঈনুল হোসেনের হাত-মুখ ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসীরা গুরুতর জখম করে। মেজর (অব.) আবদুল ওয়াহেদ, মেজর (অব.) আনোয়ারের হাত-মুখ ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে, লেফট্যানেন্ট (অব.) সামিউল হককে সন্ত্রাসীরা হত্যার উদ্দেশ্যে তার মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করে। এতে তার মাথা জখম হয়, ডান হাত ভেঙে দেয় সন্ত্রাসীরা, পিঠে লাঠি দ্বারা প্রচণ্ড আঘাত করে। তাকে দ্রুত ঢাকা মেডিক্যালে নেয়া হলে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে তার ১৩টি সেলাই দেয়া হয়। গাড়িচালক মান্নাফ জখম হওয়াসহ আবদুল কাইয়ুম নিজেও গালে ও হাতে জখমপ্রাপ্ত হন বলে উল্লেখ করেন। মামলার অভিযোগে তিনি বলেন, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সময় তাৎক্ষণিক কোন আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ইতিপূর্বে খালেদা জিয়াকে হত্যার উদ্দেশ্যে পরপর তিনবার সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এজাহারে বলা হয়েছে, সন্ত্রাসীদের আক্রমণে সাধারণ জনগণ ও দলীয় নেতাকর্মী সমর্থকরাও আহত হয়। সকল সন্ত্রাসীই আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগসহ আওয়ামীপন্থি সন্ত্রাসী বলে জানা গেছে। সন্ত্রাসীদের আক্রমণের সময় বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া তাদের ক্যামেরায় ছবি তুলেছে। ছবি দেখলেই সন্ত্রাসীদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে বলা হয়েছে। দুটি মামলারই তদন্ত কর্মকর্তা রমনা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) জুয়েল মিয়া বলেন, দুটি মামলার তদন্ত চলছে। হামলাকারীদের শনাক্ত করতে ভিডিও ফুটেজ ও স্টিল ছবি সংগ্রহ করা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.