এ কেমন মশকারা? by সাজেদুল হক

এমন চমৎকার নাটক বহুদিন দেখা হয় না। এ যেন হুমায়ূন আহমেদের নাটকের চেয়েও হিট। একদিনেই ওলট-পালট হয়ে গেল একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত। যারা এতদিন স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন বলে চিৎকার করতেন তারা এখন মুখ লুকানোর চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে নানা কিসিমের প্রধান নির্বাচন কমিশনার দেখা গেছে। এরই মধ্যে গায়েবি ভোট করে ইতিহাসে নিজের স্থান নিশ্চিত করে ফেলেছেন কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ। শোনা যাচ্ছিল সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে ঘিরে নিজের অবস্থান কিছুটা পাল্টানোর চেষ্টা করছিলেন তিনি। বিরোধী প্রার্থীদের দাবি অনুযায়ী নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের পক্ষে অবস্থান নেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। নানা নাটকীয়তা শেষে মঙ্গলবার সিদ্ধান্তও নেয় কমিশন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছাড়াও নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজও জানান, চার দিনের জন্য তিন সিটিতে সেনা মোতায়েন হবে। সেনা চেয়ে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে চিঠিও দেয়া হয় সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে। আতঙ্কগ্রস্ত ভোটারদের অনেকের মধ্যে স্বস্তিও ফিরে আসে। সিদ্ধান্ত পাল্টাতে অবশ্য একদিনও লাগেনি। পরের দিনই কমিশনের নতুন চিঠি যায় সশস্ত্র বাহিনী বিভাগে। বলা হয়, সেনা সদস্যরা সেনানিবাসেই থাকবেন। রিটার্নিং কর্মকর্তার অনুরোধে তারা স্টাইকিং ফোর্স হিসেবে কাজ করবেন। অথচ প্রচলিত আইনেই জেলা ম্যাজিস্ট্রেট চাইলে সেনা তলব করতে পারেন। এজন্য কোন জগন্নাথ কমিশনের সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হয় না। এ ধরনের একটি বিনোদনমূলক সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য কাজী রকিবউদ্দীন কমিশন ধন্যবাদ প্রাপ্য। এটা অবশ্য জাতির সঙ্গে এক ধরনের মশকারাও। ৫ই জানুয়ারির পরবর্তী যুগে এ ধরনের মশকারা করার অধিকার অবশ্যই তাদের রয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন কী কারণে হঠাৎ তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলো তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে কাদের খুশি করার জন্য ভোটের মাঠে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত থেকে তারা সরে এলেন তা একেবারেই পরিষ্কার।
সেনা মোতায়েন নিয়ে এমন আরেকটি তুঘলকি কাণ্ডের কথাও স্মরণ করছেন পর্যবেক্ষকরা। তখন ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের জমানা। রাস্তায় প্রতিদিনই চলছিল ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, রক্তাক্ত আন্দোলন। এমন পটভূমিতে ২০০৬ সালের ৮ই নভেম্বর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও প্রধান উপদেষ্টা ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ রাষ্ট্র ও জনগণের প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেন। ওই বছরের ৯ই ডিসেম্বর সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয় উপদেষ্টা পরিষদ। এ সিদ্ধান্তসহ কয়েকটি বিষয়ে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মতবিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন চার উপদেষ্টা। ১৩ই ডিসেম্বর নতুন সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন কমিশন। বলা হয়, সেনাসদস্যরা বিশ্রামে থাকবেন। তারা কোনপ্রকার অভিযানে যাবেন না। এ ছাড়া, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ড. শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন সেনা মোতায়েন চেয়েছিল। কিন্তু সরকার ওই নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করেনি।
অবশ্য শুধু সেনা মোতায়েন নয়, প্রায় প্রতিটি বিষয়েই কৌতুক করছে বর্তমান নির্বাচন কমিশন। দলীয় প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালাতে গিয়ে প্রতিদিনই হামলার শিকার হচ্ছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। হামলাকারীদের পরিচয় সংবাদমাধ্যমে বিস্তারিত প্রকাশ হয়েছে। তবে নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে নীরব নয়! প্রধান নির্বাচন কমিশনার অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে বলেছেন, তারা পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য। প্রতিদিনই কোথাও কোথাও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ আন্তর্জাতিক দুনিয়া এসব সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছে। সব দেখেশুনে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা আজকের কাগজের সেই বিজ্ঞাপনের ঠিক উল্টো- আমাদের চোখ আর হাত দুটোই বাধা। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অবশ্য নির্বাচন কমিশনের দৌড় জানেন। যে কারণে কমিশনের নিষেধাজ্ঞার পরও তিনি প্রচারণায় রয়েছেন।
কাজী রকিবউদ্দীন কমিশনও অবশ্য জানেন, তাদের বিরুদ্ধে দুর্বার কোন আন্দোলন গড়ে তোলার সক্ষমতা বিরোধীদের নেই। বিদেশীদের কার্যক্রম উদ্বেগেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এ অবস্থায় তারা থাকবেন তাদের মতোই। বিবেকের দায়বদ্ধতা বলে একটি বিষয় থাকলেও বাংলাদেশে পদত্যাগের নজির একেবারেই বিরল।
সাজেদুল হক
২৩শে এপ্রিল ২০১৫
ঢাকা

No comments

Powered by Blogger.