প্রধানমন্ত্রী কাজের সুযোগ দেবেন, আশা আনিসুলের by কামাল আহমেদ

প্রথম আলো: আপনি মূলত ব্যবসায়ী। নির্বাচিত হলে কি একজন খণ্ডকালীন মেয়র হবেন নাকি ব্যবসা থেকে পুরোপুরি দূরে সরে যাবেন?
আনিসুল হক: আমার কাছে মেয়র পদে নির্বাচনের প্রস্তাবটি যখন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আসে, তার পর প্রায় তিন মাস সময় নিয়েছি নিজেকে বোঝার জন্য যে আমি পারব কি না। আমার কোম্পানির যে কাঠামো তাতে ১৫ বছর ধরে আমাকে হাতের কাজ করতে হয় না। কোম্পানির ১৫ হাজার লোকের মধ্যে ৫০ জন আমার কাছে আসেন তাতে যদি কোনো স্পার্কলিংও হয় সে খবর ফ্যাক্টরির ব্যবস্থাপকদের অন্য কেউ জানার আগে আমি জানি। এভাবে আমি কাজ করি। তাই বলতে পারি, সিটি করপোরেশনে আমি অনেক সময় দেব। আমাকে ব্যবসার জন্য খুব বেশি সময় দিতে হবে না। যেহেতু আমি একটি গ্রুপের মেম্বার, সে জন্য আমার অল্প সময় হলেও হবে। কাজ থেমে থাকবে না।

প্রথম আলো: আপনি এত বড় একটা ব্যবসায়ী গ্রুপের প্রধান, কিন্তু আপনার আর্থিক সম্পদের বিবরণীতে দেখা গেছে আপনার নিজের কোনো গাড়ি নেই, আপনি আপনার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের গাড়ির ওপর নির্ভরশীল। এটা নিয়ে সমালোচনা আছে।
আনিসুল হক: এটাই তো স্বাভাবিক। বড় কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচালকেরা এখন আর নিজেদের পয়সায় গাড়ি কেনেন না। আমি কোম্পানির একজন অংশীদার। কোম্পানির আরও ২০০ জন এক্সিকিউটিভ কোম্পানির প্রয়োজনে গাড়ি পান, সে হিসেবে আমিও কোম্পানি থেকে গাড়ি পাই। আমি তো কোম্পানির প্রধান নির্বাহী (সিইও)। সে হিসেবে আমিও কোম্পানি থেকে গাড়ি পাই।

প্রথম আলো: এখন নির্বাচনের প্রচারাভিযানের সময় কার গাড়ি ব্যবহার করেছেন?
আনিসুল হক: নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় আমি প্রচুর ভাড়া গাড়ি নিয়েছি। কখনো কখনো আমি আমার গাড়ি ব্যবহার করছি, সেটা কোম্পানি অনুমোদন করে। কারণ, এটি প্রাইভেট কোম্পানি। বাইরের কোনো অংশীদার নেই।

প্রথম আলো: আপনি বলেছেন যে ঢাকা শহরে নিজের কোনো বাড়ি নেই।
আনিসুল হক: হ্যাঁ। ঢাকা শহরে আমার নিজের বাড়ি আছে। যেহেতু বয়স হয়েছে। কখন মরে যাই। কখন কোন ভেজাল লেগে যায় সে জন্য আমি আমার সন্তানদের সেটা লিখে দিয়ে দিয়েছি। সেটা আমার হলফনামায় উল্লেখ করেছি।

প্রথম আলো: আপনি ঢাকায় মেয়র হতে চান কেন?
আনিসুল হক: মেয়র হওয়ার স্বপ্ন আমার ছিল না। আমি সে লক্ষ্যে কাজ করিনি। প্রধানমন্ত্রী ভেবেছেন। কারণ, আমি অনেক বছর ধরে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলাম, বিজিএমইএর সঙ্গে জড়িত ছিলাম, এফবিসিসিআইয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলাম, সার্ক চেম্বারে ছিলাম। আমার নিজের কাজের বাইরেও অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িত ছিলাম। ২৫ বছর ধরে আমি কমবেশি ভালো হোক, মন্দ হোক সুনাম অর্জন করেছি। আমার বিরুদ্ধে খুব বেশি অভিযোগ নেই। আমার বিরুদ্ধে কেউ অসততার অভিযোগ করতে পারেননি। সুতরাং সেদিক থেকে তাঁর মনে হয়েছে সনাতন রাজনীতির বাইরে থেকে কাউকে নিয়ে আসা। আমি কোনো দলের সদস্য নই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ করেছি। সুতরাং, আমি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ। সে জন্যই হয়তো আমার কথা তিনি ভেবেছেন। আমার বাবাও বলেছেন, তুমি সমাজের জন্য কাজ করেছ, এটা অনেক বড় সুযোগ। এসব কারণেই আমি নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

প্রথম আলো: প্রধানমন্ত্রী আপনাকে বিনিময়ে কী দেবেন?
আনিসুল হক: প্রধানমন্ত্রী আমাকে কাজ করার সুযোগ দেবেন। এমনও হতে পারে, ঢাকার ইতিহাসে আমার নাম একটু ভালোভাবে লেখা থাকতে পারে। আমাকে তাঁর দলের সবাই সমর্থন দিচ্ছেন। তাঁর দল পূর্ণভাবে আমার সঙ্গে কাজ করছে।

প্রথম আলো: আপনি কি মনে করেন ঢাকার মেয়র হলে ক্ষমতাসীন দল বা ক্ষমতাসীন সরকারের সঙ্গে একটি ভালো সম্পর্ক থাকবে?
আনিসুল হক: আমার সঙ্গে ক্ষমতাসীন বা যাঁরা ক্ষমতায় ছিলেন না তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক। আপনি দেখেছেন যে দুটো রাজনৈতিক দলের মধ্যে মীমাংসা করার জন্য আগে ব্যবসায়ীরা আমাকেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আমার ধারণা, ক্ষমতাসীন দল যখন থাকে, তার সমর্থিত মানুষ যখন থাকে, তখন তাঁরা ভালো কাজ করতে পারেন। ঢাকাবাসীর কাছে আমার আবেদন, আপনি দেখেন কে ভালো কাজ করবেন, কার ওপর বিশ্বাস আছে, কার অতীতটা স্বচ্ছ। কার কাজের নিঃস্বার্থ আত্মনিয়োগের রেকর্ড আছে। আমার জীবনে ২৫ বছরের একটি রেকর্ড আছে।

প্রথম আলো: আপনি আওয়ামী লীগের সদস্য নন। মেয়র হলে কি দলের সদস্য পদ নেবেন না?
আনিসুল হক: এ প্রস্তাব আমার কাছে এখনো আসেনি। যদি কখনো আসে, সেটা আমি চিন্তা করে দেখব। কিন্তু আমি মনে করি, এটা খুব বেশি সমস্যা করবে না।

প্রথম আলো: কিন্তু আওয়ামী লীগের কর্মীদের একটি অংশ বলছে আমদানি করা প্রার্থী দিয়ে দল নির্বাচন করছে, সে কারণে আপনাকে তাঁরা খুব একটা ভালোভাবে নেননি।
আনিসুল হক: আমি তাঁদের কোনো দোষ দিই না। এটা মানুষের ইচ্ছা ও গণতান্ত্রিক অধিকার। কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারেন। কেউ রাগ করতে পারেন। আরও পাঁচজন দেখবেন খুশি হয়েছেন। আওয়ামী লীগ কী চায়? আওয়ামী লীগ চায়, আরও উন্নত করে দেশকে একটি জায়গায় নিয়ে যেতে। এটা সব সরকারই চায়। সে জায়গাটিতে আওয়ামী লীগ যিনি চালান, তিনি ভেবেছেন আমি ভালো হব।

প্রথম আলো: আপনি তো উত্তর ঢাকার মেয়র হতে যাচ্ছেন। অপর অংশের মেয়রের সঙ্গে মতের মিল না হলে অনেক কিছুতেই সমন্বয় হবে না।
আনিসুল হক: আমার জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। ম্যানিলায় ১৭ জন মেয়র আছে, ফ্রান্সে ১২ জন মেয়র আছে। সমন্বয় করা খুব প্রয়োজন। এ জায়গাটিতে আমি যখন ঢুকব কাজের মধ্যে, তখন আমার অভিজ্ঞতা আমাকে গাইড করবে। আপনি দেখেন যেকোনো প্রতিষ্ঠান হোক, একটা প্রতিষ্ঠানকে হাজারটা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় করে চলতে হয়। না হলে একা চলতে পারে না। সে কারণে আমি মনে করি, যদি দুটো ঢাকাও হয়, যদি সমন্বয় করা যায়, তাহলে দুজনই ভালো চায় ঢাকার। কেন হবে না।

প্রথম আলো: অতীতের কারণে এবং প্রচারণায় যাঁরা আপনার সঙ্গে আছেন, তাঁদের কারণে একটা প্রশ্ন এসেছে যে আপনি কি তাহলে ব্যবসায়ীদের প্রার্থী?
আনিসুল হক: প্রথমত আমি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের সমর্থনে প্রার্থী। তার পরে ব্যবসায়ীরা। দেশের উন্নয়নে সবচেয়ে বড় অবদান ব্যবসায়ীদের, ব্যবসায়ীদের প্রার্থী হওয়া তো একধরনের বিশ্বাসযোগ্যতার বিষয়। সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল সমর্থন করছেন, ব্যবসায়ীরা সমর্থন করছেন এবং আমার সঙ্গে যে সিভিল সোসাইটির একটা ভালো সংযোগ আছে, তাঁরাও সমর্থন করছেন।

প্রথম আলো: আপনার অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো কী হবে?
আনিসুল হক: আমার অগ্রাধিকার কাজ হবে ক্লিনিং, প্রধান কাজ হবে মশা নিধন, কাজ হবে ঢাকাকে আলোকিত করা, ঢাকাকে লাইট দেওয়া। একটি কাজ আমি খুব রিলিজিয়াসলি করতে চাই। প্রথম তিন মাসে এটা পারব না। ছয় মাস পর থেকে আমি ঢাকাকে সবুজ ঢাকা করতে চাই। না হলে ভবিষ্যৎ ঢাকার মানুষ বেঁচে থাকতে পারবে না।

প্রথম আলো: সবুজ ঢাকার প্রসঙ্গে আপনি বলেছেন পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকার তাপমাত্রা পাঁচ ডিগ্রি কমাতে চান।
আনিসুল হক: এটা কমানো প্রয়োজন। না হলে আমার আপনার ভবিষ্যতের মানুষগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

প্রথম আলো: জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যাঁরা আন্তর্জাতিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে চান, তাঁরা দুই ডিগ্রি কমাতে চান আগামী ১৫ বছরে। তাহলে আপনি কী করে পাঁচ বছরে পাঁচ ডিগ্রি কমাবেন? ঢাকাকে সারা দেশ বা বাকি বিশ্ব থেকে কি বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব?
আনিসুল হক: না, বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। তবে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা এ জন্য পরিকল্পনা করছেন এবং আমাকে তাঁরা সাহায্য করবেন। যদি বড় কেউ সহায়তা করে, তাহলে হবে।

প্রথম আলো: আপনি তো অর্ধেক ঢাকা নিয়ন্ত্রণ করবেন। বাকি অর্ধেক যদি শামিল না হয়?
আনিসুল হক: তারা যদি গ্রহণ করে, তাহলে ভালো হয়। না করলে সেটা তাদের সমস্যা। তবে এটা এমন এক সমস্যা যে সমস্যা ওই বাড়ির মালিক নিজে গ্রহণ করবেন নিজেকে সুস্থ রাখার জন্য। তাঁদের বলেছি, মাটির ওপর গবেষণা করুন, যে মাটি মশার বংশবিস্তার করবে না। যে মাটিতে অনেক বেশি পানি দিতে হবে না। সেটা নিয়ে তাঁরা গবেষণা করছেন। আপনি আপনার বাড়িতে নিজে গাছ লাগাবেন। ঢাকা শহরে প্রতি পাঁচজন ভোটারের একজন যদি গাছ লাগান, তাহলে পাঁচ লাখ গাছ লাগানো যায়। এটা সম্ভব হলে তিন বছর পর দেখবেন ঢাকা শহরের চিত্র বদলে গেছে। মেয়রের পক্ষে একা কোনো কিছু করা সম্ভব নয়। মেয়র কম্পিউটার না, ঢাকা শহর কম্পিউটার না। যদি ঢাকা শহরের মানুষ চায় তাহলে আমরা বলতে পারি এটিই সমাধান। তেমনিভাবে নিরাপদ ঢাকা করাও সম্ভব। আমি যদি ৫০ জনকে বলি আমাকে একটা করে সিসি ক্যামেরা দেন। আমাকে কে না দেবেন বলেন। সবাই চান তাঁর এলাকা নিরাপদ থাকুক। সারা ঢাকা শহরকে দুই বছরের মধ্যে কমপ্লিটলি সিসিটিভির নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। দেখবেন তখন অপরাধ অনেক কমে যাবে।

প্রথম আলো: নাগরিকদের কতটুকু ভূমিকা থাকবে নীতিনির্ধারণীর ক্ষেত্রে বা আপনাদের কাছ থেকে জবাবদিহি আদায় করায়?
আনিসুল হক: সবাই বলে নগর ভবন। আমি বলতে চাই এটা হবে নাগরিক ভবন। আমার স্বপ্ন থাকবে নগর ভবনকে নাগরিক ভবনে রূপান্তরিত করা। আমি একটি অ্যাপস তৈরি করেছি। আমরা একটি কলসেন্টার তৈরি করব। এ মুহূর্তে সেটা আমাদের আছে ছোট আকারে। যেটা আমরা বড় করব। জনগণ মানে নাগরিকেরা সিদ্ধান্ত নেবেন কে কাজ করবে। আমি খুব খুশি হব যদি আমি নির্বাচিত হই এবং তাঁরা যদি আমার টিমে থাকেন। আমি চাইব আমার একটা উপদেষ্টা কমিটি থাকবে। সেখানে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এভাবেই ভবিষ্যৎ গড়ব। এভাবে দেখি একটা কালচার তৈরি করে যেতে পারি কি না, যা অনেকের কাছে দৃষ্টান্ত মনে হবে।

প্রথম আলো: আপনার কাছে বিশেষ কী আছে যা আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীদের নেই?
আনিসুল হক: আমার চুল একটু বেশি পাকা। আমি অনেক বেশি কাজ করেছি। আমার কাজের পেছনে রেকর্ড আছে, যেটা আপনি ১০ মিনিটে যাচাই করতে পারেন। আমি বলেছি আমার সততা নিয়ে খুব বেশি প্রশ্ন নেই। আমি বন্ধুভাবাপন্ন বিনয়ী মানুষ। আমি অনেক চিন্তাভাবনা করে এসেছি। পাঁচ বছর কাজ করব। পাঁচ বছর পর নিজের কাজে ফিরে যাব। আমার ৩০ বছরের অর্জনকে পাঁচ বছরের কাজে রক্ষা করার চেষ্টা করব।

প্রথম আলো: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আনিসুল হক: আপনাকেও ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.