রানা প্লাজা ধসের দুই বছর- হতাহতদের পরিবারে চাকরির প্রত্যাশা by শাহাবুল শাহীন

রানা প্লাজা ধসে ডান পা হারানো গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর
উপজেলার সোনিয়া বেগম l ছবি: প্রথম আলো
গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার দক্ষিণ দামোদরপুর গ্রামের সোনিয়া বেগম (২০)। স্বামী মিজানুর রহমানসহ কাজ নিয়েছিলেন সাভারের রানা প্লাজার ইউএন স্টাইল নামের একটি পোশাক তৈরির কারখানায়। চাকরি নেওয়ার ২২ দিনের মাথায় ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ভবনধসের ঘটনা ঘটে। মিজানুর অন্য কাজে বাইরে থাকায় বেঁচে যান। চাপা পড়েন সোনিয়া। তিন দিন পর উদ্ধার পেলেও তাঁর ডান পা কেটে ফেলতে হয়েছে কোমরের নিচ পর্যন্ত।
সোনিয়া বলেন, ‘সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পা কাটা ও চিকিৎসা শেষে স্বামীর বাড়িতে ফিরে আসি। এরপর সরকার ১০ লাখ টাকা অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দেয়। ওই টাকা থেকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে পাচ্ছি। ১০ হাজার টাকায় এখনো চিকিৎসা ও সংসার চালাতে হচ্ছে।’
মিজানুর বলেন, ‘বর্তমানে বাড়িতে নিজ ঘরের পাশে ছোট আকারের একটি মনিহারি দোকান দিয়েছি। ওই টাকা আর দোকান দিয়ে যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চলছে।’ তিনি দাবি করেন, ‘সরকার চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও অদ্যাবধি চাকরি পাইনি।’
গাইবান্ধা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় জানায়, রানা প্লাজা ধসে গাইবান্ধার ৪৯ জন নিহত হন। নিখোঁজ হন ১১ জন ও আহত হন শতাধিক কর্মী। ঘটনার পর কেবল প্রধানমন্ত্রীর অনুদান হিসেবে নিহত পরিবারপ্রতি ১ লাখ টাকা দেওয়া হয়। এ ছাড়া তিন দফায় প্রতি পরিবারকে ৪৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়।
গতকাল বৃহস্পতিবার নিহত দুটি ও নিখোঁজ দুটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে তাদের দুর্দশা ও আক্ষেপের কথা জানা গেছে। সাদুল্যাপুর উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়নের কিশামত হলদিয়া গ্রামের নিহত স্মৃতি রানীর (২৫) মা সন্ধ্যা রানী বলেন, ‘আমাদের সহায়সম্পদ বলতে কিছুই নেই। মানুষের বসতভিটায় কোনোমতে মাথা গুঁজে আছি। তিন মেয়ের মধ্যে দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। স্মৃতি রানীর চাকরির টাকা দিয়ে সংসার চলত। ওর মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে ১ লাখ ও পরে ৪৫ হাজার টাকা পাই। তা দিয়ে মেয়ের শেষকৃত্য করি ও ৩০ শতক জমি বন্ধক নিই। এরপর দুই বছর হলো। কিন্তু আর কোনো অনুদান পাইনি। বড় মেয়ে মাধবী রানীকে নিয়ে আমি অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছি।’
স্মৃতি রানীর বড় বোন মাধবী রানী দাবি করেন, প্রধানমন্ত্রীর অনুদানের টাকার চেক দেওয়ার সময় বলা হয়েছিল, নিহত পরিবারের একজন সদস্যকে চাকরি দেওয়া হবে। কিন্তু দুই বছর পেরিয়ে গেল, চাকরি তো দূরের কথা, কেউ খোঁজও নেয়নি।
একই ইউনিয়নের দক্ষিণ ভাঙ্গামোড় গ্রামের দিনমজুর ওয়াহেদ আলীর ছেলে সবুজ মিয়া (১৮) ভবনধসের ঘটনায় নিহত হন। ঘটনার ১৬ দিন পর মুঠোফোনের সূত্র ধরে ছেলের হাড়গোড় ফিরে পান বাবা-মা। তাঁর দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। বড় ছেলে মজনু মিয়া গ্রামেই রিকশাভ্যান চালান। তাঁর পৃথক সংসার। দিনমজুরের আয় দিয়ে সংসার চলত না। সবুজ মিয়া প্রতি মাসে তিন হাজার টাকা দিত। গতকাল তাঁদের বাড়িতে গেলে মা মনজিলা বেগম বলেন, ‘ছোল মরি যাওয়ার পর সোগসুদ্দাই ১ লাখ ৪৫ হাজার ট্যাকা পাচি। এ্যাই ট্যাকা দিয়ে এ্যাক বিঘ্যা জমি বন্ধক নিচি।’ বাবা দিনমজুর ওয়াহেদ আলী বলেন, সরকার নিহত প্রত্যেকের পরিবারে একজন করে চাকরি দেওয়ার কথা বললেও এখন আর কোনো খবর নেই।
রানা প্লাজার ভবনধসে একই গ্রামের আবদুল বারীর মেয়ে বীথি খাতুন (২১) ও সোনা মিয়ার স্ত্রী কামনা খাতুন (২২) নিখোঁজ হন। এখনো তাঁদের সন্ধান মেলেনি। আবদুল বারী ও সোনা মিয়া বলেন, টাকা পাওয়া তো দূরের কথা, সরকার তাঁদের খোঁজ দিতে পারেনি। এ সময় কামনা খাতুনের ছয় বছরের ছেলে কামরুল মিয়া নির্বাক দাঁড়িয়ে ছিল। সে এখনো তাঁর মাকে খুঁজছে।
আট শিশুর পুনর্বাসন: রানা প্লাজার ভবনধসে বাবা-মা নিহত ও নিখোঁজ হয়েছে—এমন আটটি শিশু গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার হোসেনপুর গ্রামের অরকা-হোমস্ (ওল্ড রাজশাহী ক্যাডেট অ্যাসোসিয়েশন) নামের একটি প্রতিষ্ঠানে বসবাস করছে। বিজিএমইএর সহায়তায় প্রতিষ্ঠানটি শিশুদের লেখাপড়া ও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে।
শিশুরা হচ্ছে গাইবান্ধা সদর উপজেলার কুপতলা গ্রামের আরিফ হোসেন ও ধানঘড়া এলাকার আলিফ হাসান, পলাশবাড়ী উপজেলার মনোহরপুর গ্রামের শিহাব মিয়া, জামালপুর সদর উপজেলার সৌরভ হাসান, পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার মাওজি গ্রামের স্বপন ইসলাম, রংপুরের পীরগাছা উপজেলার নামাদোলা গ্রামের আল আমিন, কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলার মেহেদি হাসান মারুফ ও নাজমুস সাকিব।

No comments

Powered by Blogger.