সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্ব চান না তাবিথ -বিশেষ সাক্ষাৎ​কারে : তাবিথ আউয়াল by মিজানুর রহমান খান

প্রথম আলো: আপনি কীভাবে সমর্থন পেলেন? খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে কবে, কীভাবে আলাপ হলো?
তাবিথ আউয়াল: প্রার্থী হওয়ার আগে নয়, পরে হয়েছে। তারেক রহমানের সঙ্গে আমার সরাসরি কোনো যোগাযোগ নেই। সমর্থন ঘোষণার পর তিনি আমাকে টেলিফোনে অভিনন্দন জানিয়েছেন।

প্রথম আলো: গাজীপুর, রাজশাহী ও চট্টগ্রামের মেয়রদের মতো বিপাকে পড়লে কী করবেন? তখন কী করে ভোটারদের দেওয়া অঙ্গীকার পূরণ করবেন?
তাবিথ আউয়াল: নির্বাচিত হলে সমন্বয় করাই হবে আমার মূল দায়িত্ব। প্রয়াত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের নগর সরকারের ধারণা আমি সমর্থন করি। সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্বে না গিয়ে আমি এটা বাস্তবায়নে উদ্যোগী হব। নগর সরকারের কিছুটা স্বায়ত্তশাসন দরকার। সিটি করপোরেশনের আয় সরাসরি রাষ্ট্রীয় তহবিলে জমা পড়ে। অথচ নগর সরকার তার আয়ে অনেকটাই চলতে পারে।

প্রথম আলো: ঢাকার বিভক্তি কীভাবে দেখেন? দুই দিকে দুই মতের মেয়র হলে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নে জটিলতা হবে কি না?
তাবিথ আউয়াল: ঢাকা ভাগ ইতিমধ্যে সমস্যা সৃষ্টি করেছে। সামনে আরও বড় সমস্যা সৃষ্টি করবে। উচিত ছিল গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও মানিকগঞ্জকে একীভূত করা, তা না করে আমরা দুভাগ করেছি। কিন্তু রাজউক, পুলিশসহ সরকারের যে বিভিন্ন রকম অঙ্গ রয়েছে, সেসব ভাগ করা হয়নি। উত্তর বা দক্ষিণের মেয়র কী করে মাস্টারপ্ল্যান করবেন? মিরপুরের বাস কি ফার্মগেটে এসে থেমে যাবে? উত্তরের নদী-খাল নিয়ন্ত্রণ করে মশামুক্ত করা হলে মশারা কি দক্ষিণে গিয়ে থাকবে, নাকি ফের উত্তরে চলে আসবে?

প্রথম আলো: ঢাকা ভাগের আগেই দিল্লিকে তিন টুকরো করা হয়েছে।
তাবিথ আউয়াল: ঢাকার সবচেয়ে জটিলতা হলো বিদ্যমান আইন ও বিধিমালা। দিল্লির সঙ্গে ঢাকার অনেক মৌলিক তফাত রয়েছে। মূল তফাতটা হলো আইনের। দিল্লিতে বলা আছে, কোন কোন দায়িত্ব সিটি প্রশাসন আর কোন কোন দায়িত্ব রাজ্য সরকারের প্রশাসন দেখবে। কিন্তু ঢাকার আইনে অস্পষ্টতা রয়েছে। কোথায় পানির সংযোগ লাগবে, তা ওয়াসা দেবে, আবার পানি না পাওয়া গেলে তখন সেটা সিটি করপোরেশনের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তাই আইনি জটিলতাগুলো দূর করা হলে ঢাকাকে দুভাগ বা চার ভাগ করাও সম্ভব। আমরা কেবল জনগণকে দুভাগ করেছি। কিন্তু সেবার আইনগুলো আমরা সংস্কার করিনি।

প্রথম আলো: আপনার নামে মামলা নেই, আনিসুল হকেরও নেই। কিন্তু আপনার বাবার নামে ১৩টি দুর্নীতির মামলা আছে। ভোটে এর প্রভাব পড়বে?
তাবিথ আউয়াল: মনে হয় না। তাঁর (মিন্টু) মামলাগুলো পুরোপুরি রাজনীতির বিষয়।

প্রথম আলো: আপনার বাবা কেন আপনার কাছ থেকে ১ কোটি ৮১ লাখ টাকা ঋণ নিলেন?
তাবিথ আউয়াল: আবদুল আউয়াল মিন্টু কারাগারে থাকাকালে তাঁর কিছু বকেয়া পরিশোধে ঋণ দিতে হয়েছিল। ছেলের কাছ থেকে তিনি ঋণ নিতেই পারেন।

প্রথম আলো: আপনার মেজো ভাই প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর মেয়েকে বিয়ে করেছেন। আবার আপনার শ্বশুর ইসলামী ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এ ধরনের সম্পর্ককে কীভাবে দেখেন?
তাবিথ আউয়াল: আসলে এমন সম্পর্ক ঘটে যায়। অনেক রাজনৈতিক পরিবার বিবেচনায় দেখবেন, বিয়ের কারণেও তাঁরা এক হয়েছেন। এর ভালো দিক হলো, বিভিন্ন পথ ও মতের মানুষের জন্য রাজনীতিতে জায়গা করে দেওয়ার ঘাটতি পূরণ হবে। কারণ, আপনি পরিবারের বাইরে যেতে পারবেন না বা যাওয়া উচিত হবে না। রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের জন্য পরিবার তো ভেঙে যাবে না।

প্রথম আলো: মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কামারুজ্জামানের মুক্তিযোদ্ধা শ্যালক কিন্তু তাঁর বোন-ভগ্নিপতির সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে দিয়েছেন।
তাবিথ আউয়াল: না, ওটা আত্মীয়তা। আমি বলছি যাঁদের মধ্যে বিয়ে হয়েছে, তাঁরা তো রাজনৈতিক কারণে সম্পর্ক ভাঙছেন না। এ রকম পারিবারিক সম্পর্কগুলো ভবিষ্যতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ করবে। আমি এর মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখি না।

প্রথম আলো: এ রকম সম্পর্ক করতে আপনার বাবা কি তেমন কিছু ভেবেছিলেন?
তাবিথ আউয়াল: না, তিনি তো সম্পর্ক করেননি। সম্পর্ক গড়েছি আমরা। আমার ভাই ও রিজভী সাহেবের মেয়ে যে প্রেমে পড়েছেন, তা আমরা শুনেছি অনেক পরে। আমার বিয়েও প্রেমের সম্পর্কের ছিল।

প্রথম আলো: আপনার মুখ্য প্রতিদ্বন্দ্বীর স্ত্রী রুবানা হককে প্রচারণায় দেখছি। আপনার স্ত্রী পর্দার আড়ালে কেন?
তাবিথ আউয়াল: আমার স্ত্রী সওসান ইস্কান্দার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিমা বিষয়ে অতিথি প্রভাষক হিসেবে পড়ান। তাঁর মা-বাবা মাদারীপুরের, দুবাইয়ে তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠেন ম্যাসাচুসেটসে, নিউইয়র্কে প্রেম। তিনিও প্রচারণায় থাকবেন।

প্রথম আলো: ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?
তাবিথ আউয়াল: দেশের শাসনব্যবস্থায়, বিশেষ করে আমি যেখানে যেতে চাই, সেখানে সেক্যুলারিজম থাকা উচিত। তবে ব্যক্তিজীবনে আমি ধর্মানুরাগী।

প্রথম আলো: রাষ্ট্র থেকে চার্চ বা ধর্মের যে পৃথক্‌করণ, সেটা আপনি মানেন এবং বাংলাদেশে তার প্রয়োগ দেখতে পান?
তাবিথ আউয়াল: হ্যাঁ। আমি মানি।

প্রথম আলো: তাহলে তো বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে আপনার এ অবস্থানেরও একটা সংঘাত বাধবে। আপনার কৌশল কী হবে?
তাবিথ আউয়াল: আমার কৌশলটা কোনো বিষয় নয়। আমার অবস্থানটা ঢাকা সিটি মেয়রের। আর বিএনপি কিন্তু জোরালোভাবে বলছেও না যে তারা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে না। তারা সবার ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। আবার একটা জোটে বিশ্বাস করে।

প্রথম আলো: যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যথাপ্রক্রিয়া নিয়ে মত-দ্বিমত সত্ত্বেও আপনি কি মনে করেন, এটা জাতিকে চূড়ান্তভাবে সামনে এগিয়ে যেতেই সহায়তা দেবে?
তাবিথ আউয়াল: আমরা নতুন ধারার রাজনীতির কথা বলি। তাই অতীত নিয়ে কথা বলতে চাই না, বললে বিতর্ক হয়। আবার আমাদের জন্মের আগের অনেক তথ্য আমরা সঠিকভাবে জানি না। দ্বিতীয়ত, যদি ভাবতাম যে এই ইস্যুটিই আমাদের সংকটের মূল কারণ, তাহলে মন্তব্য করতাম।

প্রথম আলো: আপনি বিএনপিতেই যোগ দিচ্ছেন?
তাবিথ আউয়াল: কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই তা দিয়েছি। বিএনপিই হবে আমার ভবিষ্যৎ রাজনীতি।

প্রথম আলো: ভারতের সঙ্গে ট্রানশিপমেন্ট চুক্তির রুটে রাজধানী ঢাকাও পড়বে। আপনার অবস্থান কী হবে?
তাবিথ আউয়াল: নির্দিষ্টভাবে চুক্তি করতে পারলে বাংলাদেশই লাভবান হবে এবং এটা করা উচিত। মেয়রদের এ নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ, এ জন্য প্রচুর অবকাঠামো, পরিকল্পনা ও আইনেরও সংশোধনী লাগবে।

প্রথম আলো: আপনাদের ওয়েবসাইটে দেখলাম, গত তিন বছরে আপনি ১০০ ভাগ মুনাফা বৃদ্ধি করেছেন। কী করে?
তাবিথ আউয়াল: ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান তো, তাই কোনো মন্তব্য করতে চাই না।

প্রথম আলো: এখানেই স্বচ্ছতার প্রশ্ন আসে। হলফনামায় যেভাবে নামকাওয়াস্তে তথ্য চাওয়া ও দেখানো হয়, তা কি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির জন্য যথেষ্ট? যেমন আপনার ও আনিসুল হকের ব্যক্তিগত গাড়ি নেই। এ তথ্য জনগণের জেনে লাভ কী?
তাবিথ আউয়াল: না। মোটেই নয়। এটা একপেশে হলফনামা। যাঁর সম্পদ নেই, তাঁর পক্ষে এটা পূরণ করে মনোনয়ন বহাল রাখা সুবিধাজনক। কিন্তু যাঁর আছে, তাঁর জন্য অত্যন্ত কঠিন। আনিসুল হককে সমর্থন করেই বলব, সত্যিই ব্যক্তিগতভাবে তাঁর গাড়ি নেই।

প্রথম আলো: দেখলাম আপনারও গাড়ি নেই। কেন সব সময় কোম্পানির নামেই থাকতে হবে?
তাবিথ আউয়াল: (হাসি) সে জন্যই আমি আগে তাঁকে সমর্থন করলাম। তবে এভাবেই দেখানোর বিধানটা চলে আসছে। আসলে দেশের আইনগুলোই স্বচ্ছ হতে দেয় না। এটা বললে নিজেই নিজেকে বিপদে ফেলব। জনগণের জানাতে পারা উচিত, কেবল আয়ের উৎস নয়, আমার জীবনযাপন কীভাবে চলে। আমি মেয়র হলে কাউন্সিলর ও পদস্থ কর্মকর্তাদের সম্পদ ও দায়দেনার বিবরণী সময়ে সময়ে প্রকাশ করাতে উদ্যোগী হব।

প্রথম আলো: প্রচারণায় বাধা পাচ্ছেন কি?
তাবিথ আউয়াল: অনেকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছি। আমি ১০ এপ্রিলের পরে অল্প কয়েক দিনেই ২০টি ওয়ার্ডে যাই। এর মধ্যে ১১ জন কাউন্সিলর প্রার্থী পলাতক ছিলেন। ফোনেও অনেককে পাওয়া যায় না। নির্বাচন কমিশনের কাছে আমি দুটো অভিযোগ বিশেষ করে তুলে ধরেছি। যে জোটের সমর্থন পেয়েছি, তাদের নেতা-কর্মীদের অনেকেই পলাতক রয়েছেন। আমার প্রতিদ্বন্দ্বীর মতো করে প্রচারণা চালাতে পারছি না। দ্বিতীয়ত বলেছি অবৈধ অস্ত্রবিরোধী অভিযান চালাতে এবং বৈধ অস্ত্র জমা নিতে। ইসি নিশ্চুপ রয়েছে, আমি তাদের কাজে সন্তুষ্ট নই। এটা মনে হয় না যে কালোটাকা দিয়ে ভোটারদের ভোট কেনা যাবে। তবে পেশিশক্তি ও অবৈধ অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কা আমি করি। কিছু মহলকে হয়তো ভোট দিতে দেওয়া হবে না।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
তাবিথ আউয়াল: ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.