কম প্রচারিত ইতিহাস জানাবে খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড ১৯৫০

প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের লেখা বই ‘খাপড়া ওয়ার্ড
হত্যাকাণ্ড ১৯৫০ -এর প্রকাশনা উৎসবে বক্তব্য দিচ্ছেন কামাল
লোহানী। মঞ্চে (বাঁ থেকে) গোপেশ মালাকার, আহমদ রফিক ও
মতিউর রহমান। ছবিটি আজ বিকেলে জাতীয় জাদুঘরের বেগম
সুফিয়া কামাল মিলনায়তন থেকে তোলা। ছবি: জাহিদুল করিম
খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড ১৯৫০ বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে বক্তারা বলেছেন, এ বইটি ৬৫ বছর পর এ অঞ্চলের রাজনীতির একটি স্বল্প প্রচারিত অধ্যায় মানুষকে জানার সুযোগ করে দিয়েছে। সেই সঙ্গে মানুষ জানতে পারবে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কমিউনিস্ট ও বামপন্থী রাজনীতিকদের অবদান, তাঁদের আত্মত্যাগের ইতিহাস।
আজ শুক্রবার বিকেলে জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে বইটির প্রকাশনা উৎসবে বক্তারা এ কথা বলেন। বইটির লেখক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ডের ৬৫ তম বার্ষিকী উপলক্ষে বইটি প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন।
১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে কমিউনিস্ট ও বামপন্থী রাজবন্দীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। ওই নৃশংস ঘটনায় সাতজন রাজবন্দী নিহত এবং ৩২ জন আহত হন। ওই সময়ের মুসলিম লীগ সরকারের নিষ্পেষণের মধ্যে এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে সামান্য তথ্যই জানতে পেরেছিল দেশের মানুষ। বইটিতে রয়েছে ওই সময়ে জেলের ভেতরের ও খাপড়া ওয়ার্ডের অবস্থা, নিহত ও আহত রাজবন্দীদের জীবনসংগ্রাম ও পরিচয়, হত্যাকাণ্ডের বিশদ বিবরণ, প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান ও সমকালীন পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ।
বইটি লেখার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে তাঁর প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরেন মতিউর রহমান। তিনি বলেন, বইটি লেখার জন্য তিনি ওই ঘটনায় শহীদ ও আহতদের পরিবারের সদস্যদের খুঁজে বের করে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এ ছাড়া নানা সময় বিভিন্ন পত্রিকায় এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে লেখা প্রবন্ধ সংগ্রহ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে তা এ বইতে সংযুক্ত করা হয়েছে।
খাপড়া ওয়ার্ডের ৩৯ জন রাজবন্দীর মধ্যে একমাত্র জীবিত আছেন সত্যরঞ্জন ভট্টাচার্য। বর্তমানে তিনি ভারতের শিলিগুড়িতে থাকেন। শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিনি প্রকাশনা উৎসবে আসতে না পারলেও তাঁর ধারণ করা বক্তব্য শোনানো হয়। এতে তিনি বলেন, ৬৫ বছর পর খাপড়া ওয়ার্ডে শহীদদের স্মরণ করার মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হয়, তাঁরা হারিয়ে যাননি। শহীদের মৃত্যু হয় না, তাঁরা মানুষের মনের মাঝে রয়ে যান।
বই নিয়ে আলোচনায় ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক বলেন, খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতা হিটলারের ফ্যাসিস্ট নীতিকেও ছাড়িয়ে যায়। রাজবন্দীদের শুধু গুলি ছুড়ে হত্যা করা হয়নি, এরপর আবার লাঠিপেটা করা হয়। খাপড়া ওয়ার্ডের ইতিহাস মানুষকে জানার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য তিনি লেখককে ধন্যবাদ জানান।
৪৭-এর দেশবিভাগের পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস লেখার ওপর গুরুত্ব দিয়ে আহমদ রফিক বলেন, দেশের বামপন্থী রাজনীতি কতটা সঠিক নীতি নিয়ে চলতে পেরেছে, তা জানতে ও বুঝতে গেলে এ ধরনের একটি ইতিহাসনির্ভর ও বিশ্লেষণধর্মী বই প্রয়োজন।
খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ডের সময় রাজশাহী কারাগারে রাজবন্দী ছিলেন বিপ্লবী গোপেশ মালাকার। ওই সময়ের স্মৃতি চারণ করে তিনি বলেন, ওই সময়ের কমিউনিস্ট পার্টির বিপ্লবের সিদ্ধান্তের বিষয়ে অনেকেরই হয়তো মত পার্থক্য ছিল, কিন্তু কেউ দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাননি। প্রত্যেকেই দলের সিদ্ধান্ত মেনে আত্মত্যাগ করেছেন।
প্রকাশনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী। তিনি বলেন, বাংলাদেশে জেলহত্যার বৃহত্তম ঘটনা খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড। অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতার চার দশকের বেশি সময় পার হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে ওই সাত শহীদকে আজও সম্মান দেখানো হয়নি।
কামাল লোহানী আরও বলেন, দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলোতে কমিউনিস্ট পার্টি ও বামপন্থীদের অবদান আজও অনুল্লেখিত। বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকারীরা ওই অবদান অস্বীকার করার চেষ্টা করে, অনেকে বিকৃত করে। এ জন্য সত্য উদ্‌ঘাটনের জন্য ১৯৪৭-এর পর থেকে কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা দরকার।
প্রকাশনা উৎসবে আরও বক্তব্য দেন খাপড়া ওয়ার্ডের রাজবন্দী আবদুস শহীদের মেয়ে জয়া শহীদ, প্রসাদ রায়ের মেয়ে বৃত্তা রায় দীপা এবং আমিনুল ইসলাম বাদশার ছেলে সাবিরুল ইসলাম বিপ্লব। তাঁরা তিনজনই জাতীয়ভাবে এ দিনটি পালনের দাবি জানান।
প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত এই ২০০ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য ৩০০ টাকা।

No comments

Powered by Blogger.