ঢাবিতে যৌন হয়রানির নেপথ্যে বিচারহীনতা by মাহমুদুল হাসান নয়ন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীতে ঘটে যাওয়া যৌন হয়রানির ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় বারবার একই ঘটনা ঘটছে। পহেলা বৈশাখসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যৌন হয়রানির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশিষ্টজনরা। সর্বশেষ গেল পহেলা বৈশাখে টিএসসিতে ঘটে তরুণীদের বস্ত্রহরণের মতো ঘটনা। বিশিষ্টজনরা মনে করছেন, ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানে ব্যর্থতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতিই এ ধরনের ঘটনার জন্য প্রধানত দায়ী।
১৪ এপ্রিল বর্ষবরণে এসে যৌন সন্ত্রাসের শিকার হন বেশ কয়েকজন নারী। বখাটের হাতে বিবস্ত্র হয়ে সম্ভ্রমহানি হয়েছে এমন সংখ্যা অর্ধডজন বলে জানিয়েছেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে আরও অর্ধশত নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। এর আগে ১৯৯৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপন করতে এসে শ্লীলতাহানির শিকার হন শাওন আকতার বাঁধন। ২০১০ সালে বর্ষবরণে টিএসসিতে ৮-১০ জান নারী শ্লীলতাহানির শিকার হন। সেই সময়ের রেকর্ড ও প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণে দেখা যায়, পুলিশের উদাসীনতার কারণেই ওইসব দিনে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেই সময়ে ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বিভিন্ন বক্তব্য দিলেও পরবর্তীকালে তা প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেনি।
আগের ঘটনার বিচার কি হয়েছিল? এবারের ঘটনার বিচার ও কি হবে?
বস্ত্রহরণরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল ছাত্রলীগ নেতা রাসেল ও
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গনিত বিভাগের ছাত্র ছাত্রলীগ নেতা আলম
পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গাফিলতি : ১৯৯৯ সালের ঘটনায় অনুসন্ধানে জানা যায়, উচ্ছৃঙ্খল যুবকরা পুলিশ ভ্যানের সামনে দিয়ে টেনেহিঁচড়ে ওই বাঁধনকে চারুকলার দিকে নিয়ে যায়। তরুণীর আত্মীয়স্বজন এবং উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের মেয়েটিকে উদ্ধারের অনুরোধের পরও তাকে উদ্ধারে এগিয়ে আসেনি।
শ্লীলতাহানির ঘটনায় ৪৮ ঘণ্টা অতিবাহিত হলেও সে সময় কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অথচ ঘটনায় জড়িতদের বেশ কয়েকটি ছবি সে সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। পরে অবশ্য ৩ দিন পর ৪ জানুয়ারি মোট চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। শনাক্ত করা হয় আরও নয়জনকে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত এক পুলিশ সদস্যের রহস্যময় ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ঘটনার ৪ দিন পর ৫ জানুয়ারি কালু নামের একজনকে বহিষ্কার করা হয় বলেও অভিযোগ ওঠে। ৬ জানুয়ারি শাওন আকতার বাঁধন বাদী হয়ে ১০-১৫ জনকে আসামি করে শাহবাগ থানায় মামলা করেন। যার মাত্র ৩ জনকে আটক করা হয়। ১৬ জানুয়ারি ঘটনায় জড়িত অভিযোগে টুটুল নামের একজনকে বহিষ্কার করা হয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে। এ সময় ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে মেসবাহউল আলম টুটুলকে ছাড়িয়ে নেয়ার অভিযোগ ওঠে।
এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী ১ বছরের মধ্যে ক্যাম্পাস নিরাপদ হবে বলে ঘোষণা দেন। এছাড়া ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে দেয়া হবে না বলেও ঘোষণা দেন ভিসি। যদিও এরপর বেশ কয়েকবার ঢাবি এলাকায় যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর বাঁধন পুলিশ ও লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, টিএসসি সহ আরো অনেক স্থানে নারীকে
বিবস্ত্র করে যৌন নির্যাতন করা হয়। হরণ করা হয় নারীর সতীত্বকে।
বর্ষবরণের নামে যা করা হয়েছে তার দায়ভার কে নেবে? এভাবে
বাংলা উৎসব গুলি বা নববর্ষতে যদি নারীর শ্লীনতাহানি,
নারীর প্রতি পাশবিক অত্যাচার,নববর্ষ মানে যদি হয়
আমার দেশের ধর্ষিতা মা-বোনদের করুন আর্তনাদ!
২০১০ সালের বর্ষবরণেও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে। বছরটিতে পহেলা বৈশাখে বোমা হামলার হুমকি দেয় নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিজবুত তাহরির। পুলিশের পক্ষ থেকে সে সময়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা নেয়া হয়েছে বলে জানানো হয়। সতর্কতার অংশ হিসেবে রাজধানীর যেসব স্থানে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হবে সেসব স্থানে দমকল বাহিনীর প্রস্তাব অনুযায়ী ধূমপানও নিষেধ করা হয়।
অথচ পুলিশের এত নিরাপত্তার মধ্যেই সেদিন রাজু ভাস্কর্যে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে আয়োজিত কনসার্টে অনেক নারী লাঞ্ছনা ও যৌন হয়রানির শিকার হন। ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তবান সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংসদ-এর উদ্যোগে কনসার্টের আয়োজন করেছিল। ওই সময়ে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, ভিড়ের মধ্যে ৮-১০ জন যুবক নারীদের শাড়ি ধরে টান দিচ্ছে, অনেককে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে কাপড় ধরে টানাটানি করছে, ওই ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওই ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে শাহবাগ থানার তৎকালীন ওসি রেজাউল করিম জানিয়েছিলেন, নারীদের লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত করার অভিযোগ আসেনি।
সর্বশেষ ঘটনায় ১৪ এপ্রিলে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, মাত্র ২ জন পুলিশ বস্ত্রহরণের সময়ে ছিলেন। তারাও জড়িতদের ঠেকাতে এগিয়ে আসেননি। বিভিন্ন সময়ে বখাটেদের লাঠিচার্জ করা হলেও তাদের আটক করা হয়নি। সিসিটিভি ফুটেজেও এমন তথ্য রয়েছে।
বিশিষ্টজনদের বিশ্লেষণ : পূর্ববর্তী এসব ঘটনার ধরন এবং তার ফল বিশ্লেষণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের স্বনামধন্য শিক্ষকরা মনে করছেন বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদাসীনতাই এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তির জন্য দায়ী। কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এমএম আকাশের সঙ্গে। তিনি বলেন, সর্বশেষ ঘটনায় আমার কাছে মনে হয়েছে এটি পরিকল্পিত। কিন্তু কথা হল জড়িত যেই হোক না কেন, তাদের বিচার হচ্ছে কিনা? পূর্ববর্তী ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হয়েছে কিনা? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ঘটনার সময়ে ওই স্থানে গিয়েছে কিনা? পুলিশ যদি তাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেই থাকে তাহলে সিসিটিভির দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্য তখনই কেন ব্যবস্থা নিতে বললেন না?
সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. ফরিদউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, সঠিকভাবে বিচার না হওয়ায় একটি গোষ্ঠী বিশেষ দিবসে এ ধরনের ঘটনায় লিপ্ত হচ্ছে। তিনি এসব ঘটনায় সরকারকে শক্ত অবস্থানে গিয়ে জড়িতদের বিচারের দাবি জানান। বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. এজেডএম শফিউল আলম ভূঁইয়া মনে করেন, যৌন হয়রানির ঘটনাকালে উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের আইনের আওতায় আনা গেলে এ ধরনের ঘটনা কমবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শান্তনু মজুমদার বলেন, দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা আসতে পারে। তা স্বীকার করার মানসিকতা নিয়ে কাজ করলে এ ধরনের ঘটনা লোপ পাবে। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. মশিউর রহমানের মতে, পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব এবং পূর্ববর্তী ঘটনার বিচার না হওয়ায় এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে। ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের শিক্ষক সামিনা লুৎফা মনে করেন, আগে এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও বিচার না হওয়ায় যৌন হয়রানির ঘটনাগুলো বাড়ছে। পুলিশের ঘটনার শিকারদের যোগাযোগের আহ্বান বিষয়ে শিক্ষকরা বলেন, যে তরুণী ওই ঘটনার শিকার হন তিনি কোনোভাবেই পরবর্তীকালে আর যোগাযোগ করতে পারেন না। কারণ অতীতে রেকর্ড বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাঁধনের শ্লীলতাহানির ঘটনার ১৭ দিন পর ১৮ তারিখ তিনি পুলিশ ও লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান।

No comments

Powered by Blogger.