খালেদার গাড়িবহরে হামলা

সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বিএনপি চেয়ারপারসন
খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা চালায় একদল তরুণ
নির্বাচনী গণসংযোগে নজিরবিহীন হামলার শিকার হয়েছে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গাড়িবহর। সোমবার বিকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের পক্ষে প্রচার চালানোর সময় হঠাৎ করেই ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিয়ে একদল যুবক লাঠিসোটা হাতে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে বেপরোয়া হামলা চালায়। আশপাশের বিভিন্ন ভবনের ওপর থেকে বৃষ্টির মতো ইট ছোড়া হয়। এতে খালেদা জিয়ার গাড়ির কাচ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এলোপাতাড়ি ভাংচুর করা হয় তার নিরাপত্তাকর্মীদের (সিএসএফ) তিন-চারটি গাড়িসহ বেশ কয়েকটি গাড়ি। পুলিশের উপস্থিতিতেই এ তাণ্ডব চলে। এতে কিছু সময়ের জন্য কারওয়ান বাজার এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। হামলাকারীদের অনেকের হাতে ছিল কালো পতাকা। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররাই এ হামলা চালিয়েছে। খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা সমন্বয়কারী মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবর জানান, হামলার সময় খালেদা জিয়ার গাড়ি লক্ষ্য করে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সন্ধ্যার কিছু আগে কারওয়ান বাজারের কাঁচা বাজারের সামনে একটি পথসভায় হ্যান্ডমাইকে বক্তব্য দিচ্ছিলেন খালেদা জিয়া। বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরের ওপর বৃষ্টির মতো ইট-পাটকেল ছুড়ে মারা হয়। এরপর শুরু হয় গাড়ি ভাংচুর। এ সময় পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এতে খালেদা জিয়া অক্ষত থাকলেও তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মীসহ প্রায় অর্ধশত আহত হন। আহতদের মধ্যে খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এসএম সাত্তার, নিরাপত্তাকর্মী ফজলু ও ফারুক এবং ব্যক্তিগত গাড়িচালক শাহেদের অবস্থা আশংকাজনক। তাদের ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া সাবেক সংসদ সদস্য হেলেন জেরিন খান, শাম্মী আক্তার, সুলতানা রহমানও আহত হন। ঘটনাস্থলে কয়েকজন পুলিশ সদস্য থাকলেও তারা ছিলেন নির্বিকার। হামলার সময় অনেকটা নিরাপত্তাহীন ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। ৫ থেকে ৭ মিনিটের তাণ্ডবে তার গাড়িটি ছাড়া বহরের ৮-১০টি গাড়ি ভাংচুর করে হামলাকারীরা। খালেদা জিয়ার গাড়ির ওপর আহত নিরাপত্তাকর্মীদের রক্তের দাগ দেখা যায়। ইটের আঘাতে খালেদা জিয়ার গাড়ির ডান পাশের গ্লাস ফেটে গেছে। আগেরদিন খালেদা জিয়া প্রচার চালাতে উত্তরায় গেলে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা কয়েক দফা কালো পতাকা নিয়ে বিক্ষোভ করেন।
সোমবার হামলার ঘটনার পর খালেদা জিয়ার গাড়ি কারওয়ান বাজার থেকে এফডিসির দিকে চলে যায়। একই সময় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা সোনারগাঁ হোটেলের সামনে ও কারওয়ান বাজার এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল বের করে। তারা খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দিতে থাকে। এদিকে গাড়িবহরে হামলার পরও গণসংযোগ থামাননি খালেদা জিয়া। কারওয়ান বাজার থেকে তিনি যান মালিবাগ এলাকায়। এরপর রাজারবাগসহ আশপাশের এলাকায় দক্ষিণে দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থী মির্জা আব্বাসের পক্ষে ভোট চান খালেদা জিয়া। বিএনপি চেয়ারপারসনের গাড়িবহরে হামলা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসনের গণসংযোগের সময় একদল যুবক কালো পতাকা নিয়ে সেখানে মিছিল করে। এ সময় খালেদা জিয়ার নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে তাদের উত্তেজনা দেখা দেয়। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।’
বিকাল সাড়ে ৪টায় গুলশানের বাসা থেকে তৃতীয় দিনের মতো গণসংযোগে বের হন খালেদা জিয়া। আগের দু’দিন তার গাড়িবহরে পুলিশের নিরাপত্তা থাকলেও সোমবার আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্যকে তার বহরে দেখা যায়নি। ৪টা ৫০ মিনিটে খালেদা জিয়ার গাড়িবহর এটিএন নিউজের গলি দিয়ে কারওয়ান বাজারে প্রবেশ করে। এ সময় তিনি সেখানকার ব্যবসায়ী, দিনমজুর, শ্রমিকসহ পথচারীদের কাছে তাবিথ আউয়ালের পক্ষে বাস মার্কায় ভোট চান। তার গাড়িবহর ধীরে ধীরে সামনের দিকে যায়। কারওয়ান বাজার পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের সামনে পৌনে ৬টায় হ্যান্ডমাইকে বক্তব্য দেন খালেদা জিয়া। এ সময় তিনি উপস্থিত ভোটারদের উদ্দেশে বলেন, ‘চোরদের ভোট দেবেন না। সারা দেশে তারা শুধু চুরি আর চুরি করছে। আপনারা তাবিথ আউয়ালকে ভোট দেবেন।’ পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের উল্টো দিকে গাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে পূর্বমুখী হয়ে বক্তব্য রাখছিলেন খালেদা জিয়া। এ সময় উল্টো দিকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে বেশ কয়েকজন যুবক তাকে জুতা ও কালো পতাকা দেখায়। এ সময় খালেদা জিয়া তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘সন্ত্রাসী গুণ্ডামি করতেছ। তোমাদের দেখে নেব। এর পরিণতি ভালো হবে না।’ এ বক্তব্যের শেষের দিকে তার গাড়ি লক্ষ্য করে ঢিল ছোড়া হলে উত্তেজনা দেখা দেয়। এ সময় ভয়ে সাধারণ মানুষ এদিক-সেদিক ছোটাছুটি শুরু করে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, তেজগাঁও থানা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শহীদ মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা খালেদা জিয়ার গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ করে। ছাত্রলীগের সঙ্গে যোগ দেয় শ্রমিক লীগের নেতাকর্মীরা। এলোপাতাড়িভাবে ইট ও ডাবের খোল ছুড়তে থাকে তারা। ভিড়ের কারণে খালেদা জিয়ার গাড়ি সামনের দিকে এগোতে পারছিল না। তার গাড়ির ছাদ ও কাচে ইটের টুকরা পড়তে থাকে। এ সময় বিএনপির কয়েকজন নেতাকর্মী ও নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মীরা খালেদা জিয়ার গাড়ি ঘিরে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে তাকে অক্ষত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। ওই সময় খালেদা জিয়ার গাড়ির ঠিক পেছনে তার নিরাপত্তায় নিয়োজিত একাধিক মাইক্রোবাসে হামলাকারীরা লাঠি, লোহার পাইপ দিয়ে এলোপাতাড়ি ভাংচুর চালাতে থাকে। গাড়ি সামনের দিকে এগোতে থাকলে হামলাকারীরাও ধাওয়া দিয়ে ভাংচুর চালাতে থাকে। খালেদা জিয়ার গাড়ি বাদে বহরে থাকা ৮-১০টি গাড়ি ব্যাপক ভাংচুর চালায়। এ সময় বহরের বাইরে থাকা সাধারণ মানুষের দুটি মাইক্রোবাসও ভাংচুর করা হয়। সেখানে হাতেগোনা কয়েকজন পুলিশ সদস্য থাকলেও তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়। পরে খালেদা জিয়ার গাড়িবহর এফডিসির গেটের দিকে চলে যায়। যাওয়ার পথেও পেছন থেকে গাড়িতে হামলা চালায় ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের নেতাকর্মীরা। পরে হামলাকারীরা কারওয়ান বাজার ও সোনারগাঁও হোটেলের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করে। এ সময় ‘কারওয়ান বাজারের মাটি, ছাত্রলীগের ঘাঁটি’সহ নানা ম্লোগান দেয় তারা।
আব্বাসের পক্ষে খালেদা জিয়ার প্রচার : হামলার ঘটনা সত্ত্বেও গণসংযোগ অব্যাহত রাখেন খালেদা জিয়া। কারওয়ান বাজার থেকে তিনি মালিবাগ এলাকায় যান। সেখানে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের কাছে ভোট চান। পরে যান বেইলি রোড এলাকায়। সেখানে মির্জা আব্বাসের জন্য ভোট চান। রাজারবাগসহ আশপাশের এলাকায় গণসংযোগ চালান খালেদা জিয়া। এরপর তিনি মির্জা আব্বাসের শাহজাহানপুরের বাসার সামনে যান। সেখানে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী সঙ্গে নিয়ে খিলগাঁও ফ্লাইওভারের নিচে চৌধুরীপাড়া ও বাসাবো এলাকায় আব্বাসের পক্ষে ভোট চান। সেখান থেকে গুলশানের বাসায় ফেরার পথে তিনি ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতদের দেখতে যান।
বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে ছিলেন ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, শিরিন সুলতানা, রেহেনা আক্তার রানুু, সুলতানা রহমান, বিলকিস জাহান প্রমুখ।
খালেদা জিয়ার প্রচারণায় বাধা লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেবে ইসি : সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নির্বাচনী প্রচারণায় বাধার বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়েছেন ইসি সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম। সোমবার কমিশন সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ এলে কমিশন ব্যবস্থা নেবে। তবে অভিযোগের প্রমাণ থাকতে হবে। তা না হলে ওই অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা কাজ করতে পারব না।

No comments

Powered by Blogger.