হাজি সেলিম কেন পুরুষ নির্যাতনবিরোধী আইন চান? by সোহরাব হাসান

স্বতন্ত্র সাংসদ কাম আওয়ামী লীগ নেতা হাজি মো. সেলিমের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া না-হওয়ার গোলমেলে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ খবর দেশবাসীর তেমন মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। এমনকি আমাদের নারী সংগঠনগুলোও এ ব্যাপারে প্রতিবাদ করেছে, এমন খবর চোখে পড়েনি। খবরটি হলো বর্তমানে চিকিৎসা ও তীর্থস্থান পরিদর্শনে ভারত সফররত হাজি সেলিম কয়েক দিন আগে জাতীয় সংসদে পুরুষ নির্যাতন (বিরোধী) আইন করার প্রস্তাব রাখেন। এ রকম একটি প্রস্তাব ‘জঙ্গিবাদের সহযোগী বিএনপি কিংবা সরাসরি জঙ্গিবাদী দর্শনে বিশ্বাসী জামায়াতে ইসলামীর কোনো সাংসদ আনলে হয়তো অবাক হতাম না। কিন্তু প্রস্তাবটি যিনি এনেছেন, তিনি জাতীয় সংসদে স্বতন্ত্র সাংসদ হলেও নারীর ক্ষমতায়নে ব্যাকুল আওয়ামী লীগের একজন নেতা।’
একটি বার্তা সংস্থা পরিবেশিত খবরটি এখানে তুলে ধরছি: গত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে হাজি মো. সেলিম বলেছেন, নারীদের হাত থেকে পুরুষদের রক্ষার একটি আইন করার দাবি জানাচ্ছি। আমি চাই পুরুষ নির্যাতনের বিষয়ে একটি আইন হোক। তিনি বলেন, প্রিয় সহকর্মী ভাই ও বোনেরা হয়তো আমি দু-এক দিন সংসদে আছি। সংসদ থেকে পদত্যাগ করে আমি সিটি করপোরেশন নির্বাচন করব। তার আগে নারীদের হাত থেকে পুরুষদের রক্ষার জন্য এ আইনটি করার দাবি জানাচ্ছি। আমি চাই পুরুষ নির্যাতনের বিষয়ে একটি আইন হোক। বর্তমানে দেশে শুধু নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইন আছে। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীও ভয়ংকর হন। তাঁরা ওই আইনের অপব্যবহার করে পুরুষদের হয়রানি করেন।’
এখানেই শেষ নয়। পণ্ডিতমন্য এই সাংসদ কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কবিতা বলে চালিয়ে দিতেও দ্বিধা করেননি। কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত ‘নারী’ কবিতার দুটি পঙ্ক্তি হলো, ‘বিশ্বে যা–কিছু মহান সৃষ্টি চির–কল্যাণকর,/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’। কিন্তু জাতীয় সংসদে তিনি সেই কবিতাকে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি বলে দাবি করলেও কেউ প্রতিবাদ করেননি।
প্রস্তাবিত আইনের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে হাজি সেলিম বলেছেন, নারী-পুরুষ এখন ফিফটি ফিফটি মিলিয়ে এক শ। তাই ন্যায়বিচারের স্বার্থে পুরুষ নির্যাতন আইন করা দরকার। কিন্তু এই পণ্ডিতপ্রবর জানেন না যে ফিফটি ফিফটি নারী হওয়ার কারণে নারী নির্যাতনবিরোধী আইন হয়নি। আইন হয়েছে সমাজে পুরুষের দ্বারা যেসব নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘঠছে, তা বন্ধ করার জন্য। ভবিষ্যতে যদি নারী নির্যাতন রহিত হয়ে যায় তখন স্বাভাবিকভাবে এই আইনের কার্যকারিতাও থাকবে না। তবে সমাজে হাজি সেলিম বা জয়নাল হাজারীর মতো মানুষ থাকতে সেটি ঘটার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আর তিনি যে ফিফটি ফিফটি তত্ত্ব দিয়েছেন, সেটি কেবল একটি আইনের মধ্যে সীমিত রাখতে চাইছেন? কেন সম্পদ, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরিবাকরির ক্ষেত্রে চালু করার কথা বলেন না?
হাজি সেলিম যখন প্রস্তাবটি রাখেন তখন সংসদ পরিচালনা করছিলেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনিও হাজি সেলিমের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেননি।
পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘স্বতন্ত্র সাংসদ হাজি সেলিম যখন এসব কুৎসিত মন্তব্য করেন, তখন নাকি সংসদের অনেক পুরুষ সদস্য টেবিল চাপড়ে তাঁর প্রতি সমর্থন জানান। আর পেছনের সারিতে বসা সংরক্ষিত আসনের নারী সাংসদেরা হইচই করে প্রতিবাদ জানান।’ প্রথম আলোতে খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পর অনলাইনে পাঠকেরা যথার্থই হইচই শব্দ ব্যবহারের সমালোচনা করেছেন। পুরুষ সদস্যদের টেবিল চাপড়ানো বাহবা হবে, আর নারী সাংসদদের প্রতিবাদ কেন হইচই হবে? তাহলে কি আমাদের মনোজগতেই নারীবিদ্বেষ আছে?
আমরা জানি না যেসব পুরুষ সদস্য টেবিল চাপড়াচ্ছিলেন, তাঁরা কি আসলেই হাজি সেলিমের বক্তব্যকে সমর্থন জানাচ্ছিলেন, না তাঁকে ঠাট্টা করছিলেন। যদি তাঁরা ঠাট্টাও করে থাকেন, বিষয়টি মোটেই ঠাট্টার নয়। যে দেশে ঘরে-বাইরে নিয়ত নারী নির্যাতন, হয়রানি ও বৈষম্যের শিকার হন, যে দেশে নারী নির্যাতনবিরোধী আইন থাকলেও তার প্রয়োগ নেই, সেই দেশের একজন সাংসদ এ ধরনের আইন আনার কথা বলতে পারেন কীভাবে? হাজি সেলিমের পড়াশোনা, কতটি মামলা তাঁর বিরুদ্ধে আছে বা ছিল কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তিনি কোথায় পালিয়ে ছিলেন, সে বিষয়ে আমরা কিছু বলতে চাই না। কিন্তু আমাদের উদ্বেগের বিষয় হলো, নারীর বিরুদ্ধে একজন পুরুষ সাংসদের অবস্থান।
আসলে এটি হলো মূল্যবোধ, মানসিকতা, রুচি ও সংস্কৃতির প্রশ্ন। ভোটে জয়ী হয়ে সাংসদ হওয়া যায়, কিন্তু মনোজগতের অন্ধকার দূর করা যায় না। বর্তমান বাংলাদেশে হাজারটা সমস্যা থাকতে তিনি কেন পুরুষ নির্যাতনবিরোধী আইন করতে চাইলেন, আমরা বুঝতে অপারগ। সত্যি সত্যি কি তিনি ঘরে বা বাইরে কোনো নারী দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন কি না, সেই কথ্যও আমাদের জানার কথা নয়। এর আগে হেফাজতে ইসলামের আমির মাওলানা শাহ আহমদ শফী চতুর্থ শ্রেণির বেশি নারীর পড়াশোনার প্রয়োজন নেই বলে মন্তব্য করে ব্যাপকভাবে সমালোচিত ও নিন্দিত হয়েছিলেন। আমরাও লিখেছি। কিন্তু হাজি সেলিমের বক্তব্যটি আরও বিপজ্জনক। যেখানে নারীরা ঘরে-বাইরে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, সেখানে তিনি উল্টো নারীর বিরুদ্ধে আইন করার দাবি জানালেন।
হাজি সেলিম বলেছেন, তাঁর কাছে ২০ জন সালিসি করতে এলে তার মধ্যে ১৫ জনই নারী নির্যাতনের বিষয় নিয়ে আসেন। তিনি নারী নির্যাতনবিরোধী আইনের নামে স্বামীর ভাইবোন, বাবা-মায়ের হয়রানির কথা বলেছেন। কিন্তু এই সাংসদ কি জানেন না যে, তাঁর কাছে যাঁরা প্রতিকার চাইতে আসেন, তার চেয়ে অনেক বেশি নারী নীরবে নির্যাতন সহ্য করেন। তাঁর এটাও অজানা থাকার কথা নয় যে নারী নির্যাতবিরোধী হয়রানিমূলক মামলার পেছনেও থাকে প্রভাবশালী পুরুষের বদমতলব। থাকে পুরুষ পুলিশ সদস্যদের প্ররোচনা। তাঁরাই বলে দেন কোন ধারায় এবং কতজনকে আসামি করতে হবে। আইনপ্রণেতা হিসেবে হাজি সেলিমের দায়িত্ব ছিল নারী নির্যাতনবিরোধী আইনের অপব্যবহার ও অকার্যকারিতা নিয়ে কথা বলা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারীর মর্যাদা রক্ষা সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ বলেই আমরা জানি। অথচ তিনি যেই জাতীয় সংসদে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেই সংসদেরই একজন সদস্য নারীর মর্যাদার প্রতি হানিকর আইন আনার দুঃসাহস দেখালেন! নারীর রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের সাফল্য যে বহির্বিশ্বে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে, তাও কালিমালিপ্ত করে দিতে চান এই আওয়ামী লীগ নেতা। এক হাঁড়ি দুধে এক ফোঁটা চনাই যথেষ্ট।
সংসদ নেত্রী শেখ হাসিনা বলতে পারেন, হাজি সেলিম আওয়ামী লীগের সাংসদ নন, স্বতন্ত্র সাংসদ। তাঁর মুখে লাগাম টেনে ধরা তাঁর কাজ নয়। কিন্তু দলীয় সভানেত্রী হিসেবে তো তিনি হাজি সেলিমকে দলীয় নীতি ভঙ্গের দায়ে ব্যবস্থা নিতে পারেন। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে নিশ্চয়ই পুরুষ নির্যাতনবিরোধী আইন করার কথা নেই। কিন্তু নগর আওয়ামী লীগ নেতা সে ধরনের একটি আইন চাপিয়ে দিতে চাইছেন দেশের নারীসমাজের ওপর। এই দুঃসাহস তিনি পেলেন কোথায়?
হাজি সেলিম আওয়ামী লীগের সাংসদ না হয়েও অনেক সাংসদের চেয়ে ক্ষমতাবান। তাঁর বিরুদ্ধে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখলের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। সেখানে সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা হল পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু মহা ক্ষমতাবান স্বতন্ত্র সাংসদ হাজি সেলিমের বিরুদ্ধে তাঁরা কিংবা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পেরে ওঠেনি। পেরে ওঠেননি লালবাগ এলাকার ভদ্রলোক রাজনীতিক নামে পরিচিত মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনও। গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে লড়েছিলেন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে ভোটযুদ্ধে অংশ নেওয়ার পরও হাজি সেলিমের দলীয় পদটি অটুট রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী খামোশ না করলেও হয়তো তিনি দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রও হয়ে যেতেন। দুই দিন আগে তাঁরই প্রতিদ্বন্দ্বী ও আওয়ামী লীগ-সমর্থক প্রার্থী সাঈদ খোকনকে উদ্দেশ করে হাজি সেলিম বলেছেন, ‘ওর সঙ্গে কজন লোক আছেন। আওয়ামী লীগের সব নেতা-কর্মী আমার সঙ্গে আছেন।’
একসময় হাজি সেলিম ছিলেন বিএনপির নেতা। ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদে বিএনপি থেকে মনোনয়ন না পেয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং সাংসদ নির্বাচিত হন। সেই দফায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময়েই আমরা তাঁর নাইনশ্যুটার তাণ্ডবও দেখেছি। সেই হাজি সেলিম এখন জনসংখ্যার অর্ধেক নারীকে নির্যাতক হিসেবে চিহ্নিত করে পুরুষ নির্যাতনবিরোধী আইন করতে চাইছেন। এর উদ্দেশ্যটা কী? হাজি সেলিমেরা কি বাংলাদেশটাকে ফের অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে িনতে চান, যেখানে সংসদ থেকে শুরু করে শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য—কোথাও নারীর অধিকার থাকবে না। কেউ সেই অধিকারের কথা বললেই পুরুষ নির্যাতনবিরোধী আইন করে তাঁর মুখ বন্ধ করে দেওয়া হবে। দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, জাতীয় সংসদের নেত্রী নারী, বিরোধী দলের নেত্রী নারী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী নারী, জাতীয় সংসদের স্পিকার নারী। এই নারীবিদ্বেষী সাংসদ সম্পর্কে আমরা তাঁদের অবস্থান জানতে চাই। যদি স্পিকার ও সংসদ নেত্রী হাজি সেলিমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেন, ধরে নেব মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ।
জাতীয় সংসদে কেবল হাজি সেলিমই প্রথম নারীবিদ্বেষী বক্তব্য রাখেননি। সপ্তম সংসদে ফেনীর গডফাদার বলে খ্যাত জয়নাল হাজারী আরও জঘন্য ভাষায় নারীর বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন সরকার বা সংসদ তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি মৌখিক নিন্দাও জানাননি কেউ। এবারেও হাজি সেলিমের নারীবিরোধী বক্তব্য প্রতিবাদহীন চলে যাবে?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab০3@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.