মনোনয়ন দাখিলের দিনেও আতঙ্ক

তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের দিনেও আতঙ্ক তাড়া করেছে বিরোধী সমর্থক প্রার্থীদের। গ্রেপ্তার আতঙ্কের কারণে বেশির ভাগ বিএনপি সমর্থক প্রার্থীই সরাসরি মনোনয়নপত্র জমা দিতে যাননি। কেউ আইনজীবী কেউ-বা পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। বিরোধী জোটের সম্ভাব্য প্রার্থীদের বেশির ভাগই একাধিক মামলার আসামি। দীর্ঘদিন আত্মগোপন ও নিরাপদ অবস্থানে থেকেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তারা। সরকার হঠাৎ করে সিটি নির্বাচনের উদ্যোগ নিলে ভোটের লড়াইয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপিও। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার কারণে বিরোধী নেতারা মাঠে নামতে পারছেন না। প্রার্থীসহ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশি হয়রানি বন্ধ, প্রচার-প্রচারণায় সমান সুযোগ দেয়াসহ কয়েকটি দাবি জানিয়েছেন বিরোধী জোটের নেতারা। সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়োজনে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিএনপিপন্থি বিশিষ্ট নাগরিকদের সংগঠন ‘শত নাগরিক’-এর একটি প্রতিনিধি দলও এসব পরামর্শ তুলে ধরেছেন। কিন্তু পুলিশি হয়রানি বন্ধসহ এসব দাবির ব্যাপারে কোন ইতিবাচক সাড়া মেলেনি নির্বাচন কমিশন, সরকার ও প্রশাসনের তরফে। ঢাকার দুই সিটিতে বিএনপির সমর্থন প্রত্যাশী ৫ মেয়র প্রার্থীর মধ্যে মাত্র একজন গতকাল রিটার্নিং কার্যালয়ে গেছেন। তবে ঢাকার চেয়ে কিছুটা স্বতঃস্ফূর্ত চলাফেরা করতে পারছেন চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে বিরোধী জোটের সমর্থন প্রত্যাশী প্রার্থীরা। এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বিএনপির ৪ নেতা। এর মধ্যে দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপনই একমাত্র প্রার্থী যিনি সশরীরে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। অন্যদের মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগর কমিটির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসের পক্ষে তার দুই আইনজীবী, বিএনপির অর্থনৈতিক বিষয়ক সম্পাদক আবদুস সালামের পক্ষে তার স্ত্রী ফাতেমা সালাম এবং সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক কারাবন্দি নাসিরউদ্দিন আহম্মেদ পিন্টুর পক্ষে তার স্ত্রী নাসিমা আক্তার কল্পনা মনোনয়নপত্র জমা দেন। অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু। মিন্টুর পক্ষে মনোনয়নপত্র জমা দেন তার ছেলে তাফসিরুল এম আউয়াল। এসময় তাফসীর আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার দায়িত্ব ইসির। নির্বাচন কমিশনের উচিত নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করা। এখন কেউ আদালতে মামলার পেছনে দৌড়াচ্ছে আর কেউ নির্বাচনী প্রচারনা চালাচ্ছে এটা হতে পারে না। সবার জন্য সমান সুযোগ থাকা উচিত। ওদিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এম মনজুর আলম মঞ্জু দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান ও মহানগর বিএনপির সভাপতি আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেন। যদিও মনোনয়নপত্র সংগ্রহের মতো জমা দেওয়ার ক্ষেত্রেও প্রার্থীকে রিটার্নিং কর্মকর্তার দপ্তরে সশরীরে হাজির হওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। তবে নেতাকর্মীরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, এমন পরিস্থিতি বজায় থাকলে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পারবেন কিনা তা প্রশ্নসাপেক্ষ। এছাড়া দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় খুলে দেয়া এবং চেয়ারপারসন কার্যালয়ের নেতাকর্মীদের যাতায়াতে বাধা তুলে না হলেও নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে জটিলতার মধ্যে পড়তে হবে। বিশেষ করে গ্রেপ্তারের ঝুঁকি নিয়ে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ও কেন্দ্রীয়ভাবে প্রার্থীর নির্বাচনী কার্যালয় পরিচালনা এবং জনসংযোগ অসম্ভব বিষয়। তবে ঝুঁকি, আতঙ্ক ও হয়রানির আশঙ্কা সত্ত্বেও নির্বাচনী কর্মকাণ্ড শুরু করেছে বিরোধী জোট নেতারা। বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয় সূত্র জানায়, নির্বাচন কমিশন প্রার্থিতা যাচাই-বাছাই সম্পন্ন করার পর ৭-১০ই এপ্রিলের যে কোনদিন শত নাগরিক জাতীয় কমিটি আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকার দুই সিটির মেয়র প্রার্থী ঘোষণা করবে। এরপর নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হবেন বিএনপি নেতারা। এছাড়া এ সময়ের মধ্যে সুযোগ মতো মেয়র এবং কাউন্সিলর প্রার্থীরাও জামিনের জন্য উচ্চ আদালতে যাবেন। এ ব্যাপারে শত নাগরিক-এর আহ্বায়ক প্রফেসর ড. এমাজউদ্দিন আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, আগে নির্বাচন কমিশনের যাচাই-বাছাই সম্পন্ন হতে হবে। তারপর প্রার্থীদের তালিকা চূড়ান্ত হলে শত নাগরিক ঢাকার দুইটি সিটিতে গ্রহণযোগ্য দুইজন প্রার্থীকে সমর্থন দেয়ার ব্যাপারে আলোচনা করেছে। কারণ এ সময়ের মধ্যে প্রার্থীতা বাতিল, প্রত্যাহার অনেক কিছুই হতে পারে। তাই সেটা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ৯ই এপ্রিলের পরেই হবে। এদিকে পুলিশি হয়রানির ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের তরফে ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও বিএনপিপন্থি বিশিষ্ট নাগরিকদের সংগঠন ‘শত নাগরিক’-এর আহ্বায়ক প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমেদ। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। প্রার্থীদের পক্ষে মিছিল-মিটিং, সমাবেশ ছাড়া নির্বাচন হয় না। সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে মিছিল-মিটিং করার পরিবেশ তৈরি প্রয়োজন। এদিকে ঢাকা ও চট্টগ্রাম ৩ সিটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরপরই অনেকটা খোলামেলা নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে পড়েছেন সরকারি দল সমর্থিত প্রার্থীরা। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রকাশ্যে প্রার্থী চূড়ান্ত করায় খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নির্বাচনী বিধি ভঙ্গে অভিযোগ এনেছেন বিরোধী জোটসহ দুই জোটের বাইরে থাকা একাধিক রাজনৈতিক দল। তবে নির্বাচন কমিশনের বিধির কারণে এখনই নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পারছেন না বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা। এ জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে- প্রচারণা শুরুর আনুষ্ঠানিক দিন ৭ই এপ্রিল পর্যন্ত। বিএনপির কয়েকজন নেতা জানান, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা বিষয়টি নিশ্চিত ছিল না সরকার। যখনই বিএনপি নেতারা নির্বাচনের প্রাথমিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন তখনই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ফলে সকল প্রার্থীর সমান অধিকারের সুযোগ পাচ্ছেন না বিরোধী জোট সমর্থিত প্রার্থীরা। যেখানে সরকারি দল সমর্থক প্রার্থীরা এক সপ্তাহ আগে থেকেই প্রচারণা শুরু করেছেন সেখানে প্রচারণার আনুষ্ঠানিক দিন ঘোষণা করা হয়েছে ৭ই এপ্রিল। সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নেয়া না হলে বিধির ব্যত্যয় ঘটলে বিরোধী জোট সমর্থিতরা রেহাই পাবেন না। ফলে তাদের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। আর এর মাধ্যমে প্রচারণায় আড়াই সপ্তাহ পিছিয়ে পড়ছে বিরোধী জোট সমর্থিত প্রার্থীরা। এ ব্যাপারে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বলেছেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও সরকার যদি ৫ই জানুয়ারির খেলা খেলতে চায়, তাহলে এই খেলাই হবে শেষ খেলা। বিরোধী জোটের প্রার্থী-সমর্থকদের হয়রানি কিংবা সভা-সমাবেশের মতো কর্মসূচিতে বাধা দিলে পরিণতি শুভ হবে না। এদিকে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে সিটি নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্তে কিছুটা হতাশা তৈরি হয় বিরোধী জোট নেতাকর্মীদের। এমন পরিস্থিতিতে বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়েছে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে। বলা হয়েছে, আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ। এছাড়া সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস রোববার হরতালের আওতামুক্ত রাখা হলেও ফের হরতালের ডাক দিয়েছে ২০ দল। তবে এবার সিটি নির্বাচনের সুবিধার্থে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরকে হরতালের আওতামুক্ত রাখা হয়েছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, সরকারের আচরণের ওপর নির্ভর করছে বিএনপির অবস্থান। কৌশলগত কারণেই চূড়ান্ত প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতিতে বিএনপিকে নির্বাচন থেকে সরে যাবার পথ খোলা রেখে এগোতে হচ্ছে। নেতারা জানান, আন্দোলন কর্মসূচি থেকে পুরোপুরি সরে এলে ফের সেটা চাঙ্গা করতে নতুন করে জটিলতার মধ্যে পড়তে হবে বিএনপিকে। তাই নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখা ও সরকারের ওপর চাপ ধরে রাখার অংশ হিসেবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরের বাইরে সারা দেশে হরতালের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। পরিবেশ ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচির পাশাপাশি ধারাবাহিকভাবে কিংবা প্রতি সপ্তাহে নির্দিষ্ট কয়েকদিন ছাড় দিয়ে হরতাল কর্মসূচিও চালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হরতাল পর্যায়ক্রমে কমিয়ে এনেও কীভাবে সরকারকে ব্যতিব্যস্ত বা চাপে রাখা যায় সে ব্যাপারে কৌশল প্রণয়ণে কাজ করছেন জোট নেতাদের কয়েকজন।

No comments

Powered by Blogger.