বাংলা আমার জীবন-আনন্দ by কে জি মোস্তফা

সুদূর মফস্বল থেকে এই সেদিন ভাইজি ঝর্ণা তার ছোট ছেলে রাতুলকে নিয়ে ঢাকায় বেড়াতে এলো। ছিল আমাদের বাসায়। রাতুল চঞ্চল, চটপটে। সারাক্ষণ ছেঁড়া কাগজ দিয়ে এটা-সেটা বানাচ্ছে। লাল-নীল পেনসিল দিয়ে পল্লীর নৈসর্গিক ছবি আঁকছে। মাঝে মধ্যে ছবিগুলো দেখাতে ঘনিষ্ঠ হয়ে আমার কাছে আসে। তার ছবি আঁকার হাত বেশ। আমি উৎসাহ দিতে থাকি।
সন্ধ্যার পর আমি সাধারণত শুয়ে-বসে বই পড়ি। পাশে রাখা রেডিওতে গান শুনি। হঠাৎ এক সময় বেজে উঠল একটি ইংরেজি গান। রাতুল পাশের রুম থেকে দৌড়ে এসে ওই গানের সাথে গলা মিলিয়ে নেচে নেচে গানটি গাইতে শুরু করল। গান শেষ হওয়ার পর জিজ্ঞেস করলামÑ এ গানটা তুমি কী করে জানো? বলল, এটা তো ‘বেবি ডল’। পাল্টা প্রশ্ন- সবাই জানে, তুমি জানো না? বললাম না তো! আমি তাকে জনপ্রিয় একটি বাংলা ছড়াগানÑ ‘বাকবাকুম পায়রা, মাথায় দিয়ে টায়রা আয় ছুটে আয়’ শোনাতে চাইলাম। সে মুখ বেঁকিয়ে চলে গেল। শুনতে চাইলো না।
ওদের কী দোষ। ইদানীং রেডিওর এফএম ব্যান্ড বা টিভি চ্যানেলগুলোতে হরহামেশাই ইংরেজি বা হিন্দি গানের মহোৎসব। মেধাবী উপস্থাপনায় আরজেদের শিল্পিত কণ্ঠে, সান্দ্র উচ্চারণে বেশির ভাগ বিদেশী ভাষা। মায়ের উষ্ণকোলে শেখা, মায়ের মুখের বুলি, হায় রে আমার বাংলা ভাষা! এ কী অদেখা নিয়তির নির্দেশ! ব্যথা না পাওয়ার ব্যথা!
সময়ের কোনো মতিগতি নেই। জাগ্রত অমর একুশে আবার হাজির আমাদের দ্বারে। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র বিষণœ সুর বাজছে এখানে-ওখানে-সবখানে। কিন্তু শোকের মাতম স্তিমিত হয়ে সেটা আজ উচ্ছ্বাস ও আবেগে পরিণত। জানি, একুশের ভোররাত থেকেই হাজির হবে সর্বস্তরের মানুষ, যেখানে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ধ্রুপদী স্থাপত্যের সৌন্দর্য নিয়ে চত্বরের এক দিকে সমুন্নত গাম্ভীর্যে দাঁড়িয়ে আছে। অসংখ্য পুষ্পস্তবকে নিবেদিত হবে শহীদদের অমলিন স্মৃতির প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধার্ঘ্য। এ দিকে ১ ফেব্রুয়ারি থেকেই বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য সেমিনার, স্লোগান, সম্প্রচারে আকাশ-বাতাস মথিত হচ্ছে। ঝরছে কুম্ভিরাশ্রু। ফেব্রুয়ারি মাস পার হলেই আবার যে কে সেই।
অমর একুশে ও আন্তর্জাতিক ভাষাদিবসের মাস ফেব্রুয়ারি। অনেকে বলেন, বাংলা পৃথিবীর পঞ্চম ভাষা, কারো কারো মতে ষষ্ঠ ভাষা। তবুও একটি আত্মজিজ্ঞাসা, বাংলা ভাষা কার? কত দূর পর্যন্ত তার ব্যাপ্তি? নতুন প্রজন্ম কি চায় মাতৃভাষা বাংলাকে?
পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে ঢাকা শহরে আছি। আমাদের ঠিক আগের প্রজন্মের মানুষজন একে একে টুপটাপ হলদে পাতার মতো খসে যেতে শুরু করেছে। আমি আশা আর আশঙ্কা, আবাহন আর বিসর্জনের মধ্যে একটা নিরাসক্ত, বিচ্ছিন্ন, বোধশূন্য মানুষ। সবাইকে মরতে হবে, কিন্তু একটু শান্তিতে মরার সাধ কার না থাকে। বলতে চাই,পশ্চিমে লালিত লজিক-নিষ্ঠ আমাদের মনটাকে নির্বাসনে পাঠাতে হবে। জাগিয়ে তুলতে হবে সেই মনকে, যে মন বুঝতে চায় মায়ের মুখের বুলি, প্রিয় বাংলা ভাষাকে।
বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত গানটির সাথে আসুন আমরাও কণ্ঠ মেলাই :
আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই/ আমি আমার আমিকে চিরদিনÑ এই বাংলায় খুঁজে পাই/ আমি বাংলায় দেখি স্বপ্ন, আমি বাংলায় বাঁধি সুর
আমি এই বাংলার মায়াভরা পথে, হেঁটেছি এতটা দূর
বাংলা আমার জীবনানন্দ, বাংলা প্রাণের সুখ/ আমি একবার দেখি, বারবার দেখি, দেখি বাংলার মুখ।/ আমি বাংলায় কথা কই, আমি বাংলার কথা কই/ আমি বাংলায় ভাসি, বাংলায় হাসি, বাংলায় জেগে রই
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার/ আমি সব দেখেশুনে খেপে গিয়েÑ করি বাংলায় চিৎকার/ বাংলা আমার দৃপ্ত স্লোগান, প্তি তীর ধনুক
আমি একবার দেখি, বারবার দেখি, দেখি বাংলার মুখ।/ আমি বাংলায় ভালোবাসি, আমি বাংলাকে ভালোবাসি/ আমি তারই হাত ধরে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে আসি/ আমি যা কিছু মহান বরণ করেছি বিনম্র শ্রদ্ধায়/ মিশে তেরো নদী, সাত সাগরের জল গঙ্গায়-পদ্মায়।/ বাংলা আমার তৃষ্ণার জল, তৃপ্ত শেষ চুমুক/ আমি একবার দেখি, বারবার দেখি, দেখি বাংলার মুখ।
লেখক : গীতিকার, কবি ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.