মানুষকে একটু স্বস্তি দিন

কাকে বলি, ওগো মৃত্যু থামাও_ এমন আবেদন-নিবেদন-আকুতি আর কত জানাবে বাংলাদেশের মানুষ? আন্দোলনের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে আর কত রক্ত ঝরানো হবে? আর কত নিষ্পাপ মুখ দগ্ধ হবে? সহিংসতার মাস পূরণ হয়েছে ৪ ফেব্রুয়ারি। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে এ ভূখণ্ডে নানা ইস্যুতে আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু এবারে 'আন্দোলনকারী শক্তি' সাধারণ মানুষের প্রতি যেভাবে ঘৃণা ও ক্ষোভ-রোষের প্রকাশ ঘটাচ্ছে, সেটা অতীতে দেখা যায়নি। এ পর্যন্ত পেট্রোল বোমার আগুনে যাদের মৃত্যু হয়েছে কিংবা যারা বেঁচে থেকেও নিদারুণ অহর্নিশ মৃত্যু-যন্ত্রণা ভোগ করছেন, তাদের কেউই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। তাদের একমাত্র অপরাধ_ জরুরি প্রয়োজনে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পেঁৗছানোর জন্য যাত্রীবাহী বাসে আরোহণ কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও অন্যান্য দ্রব্য নিয়ে ট্রাক-কাভার্ডভ্যান চালানো। লক্ষ্যবিহীন আন্দোলনে শিক্ষাজীবন বিপন্ন। গত সোমবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরুর কথা ছিল। কিন্তু অনেক আবেদন-নিবেদনের পরও দেশবাসীকে বিস্মিত-স্তম্ভিত করে সেদিন হরতাল আহ্বান করেছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। কোমলমতি প্রায় ১৫ লাখ ছাত্রছাত্রীর নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকার এ পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন করে ৬ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার নির্ধারণ করে। দ্বিতীয় পরীক্ষাটি অনুষ্ঠানের কথা ছিল বুধবার। কিন্তু বিএনপির কোনো কোনো নেতা 'কিসের পরীক্ষা' ধরনের অপরিণামদর্শী মন্তব্য করার পরপরই বুধ ও বৃহস্পতিবারেও হরতাল বর্ধিত করা হয়। ফলে দ্বিতীয় পরীক্ষাও স্থগিত রাখতে সরকার বাধ্য হয়। আজ শুক্রবার এবং আগামীকাল শনিবার এই স্থগিত দুটি পরীক্ষা অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। কিন্তু দেশের সর্বত্রই উদ্বেগ_ ছাত্রছাত্রীরা নির্বিঘ্নে পরীক্ষা দিতে পারবে তো? সহিংস আন্দোলনের কারণে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি কাজে অভাবনীয় বিঘ্ন ঘটেছে। 'আন্দোলনকারীরা' এদের শিক্ষাজীবন নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা করতে রাজি হয়নি। সরকার পতনসহ যে কোনো ইস্যু নিয়েই আন্দোলন করতে পারে বিএনপি-জোট। কিন্তু পরীক্ষার দিনগুলোতে কেন হরতাল আহ্বান করা হচ্ছে_ তার কারণ আমাদের বোধগম্য নয়। এ ধরনের কর্মসূচি বিবেকবর্জিত। পরীক্ষা শুরুর দিন ২ ফেব্রুয়ারি সোমবার একটানা ৭২ ঘণ্টা হরতাল আহ্বানের সিদ্ধান্ত জানার পর 'সমকাল' ৩১ জানুয়ারি 'প্রত্যাহার করুন এই সর্বনাশা কর্মসূচি' শিরোনামে বিশেষ সম্পাদকীয়তে লিখেছিল :'বিএনপির নৈতিকতা-বিবর্জিত সিদ্ধান্তে আমরা বিস্মিত ও মর্মাহত। শুধু আমরা নই, বিবেকবান প্রতিটি মানুষ ক্ষুব্ধ। হরতালের সময় এসএসসি পরীক্ষা চললে এবং একটি অঘটন ঘটলেও তার দায় বিএনপিকেই নিতে হবে।' আমরা আশা করব যে, শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং আজ থেকে শুরু হওয়া মাধ্যমিক পরীক্ষা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হতে দেওয়া হবে। বর্তমান সরকারের আমলে স্কুল পর্যায়ে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণ শুরু হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মাধ্যমিক বা এসএসসি পরীক্ষাই শিক্ষার্থীদের কাছে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষা। এ জন্য স্কুলে স্কুলে চলে বিশেষ কোচিং এবং অন্যান্য প্রস্তুতি। ঘরে ঘরে চলে সন্তানের মঙ্গল কামনায় আয়োজন। ধনবান থেকে দিনমজুর-বস্তিবাসী, কত পরিবারে কিংবা তাদের নিকটজনের কোনো না কোনো পরিবারে রয়েছে পরীক্ষার্থী। কেন আন্দোলনের নামে তাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা_ সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। গত এক মাসের সহিংস আন্দোলনে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নেই_ সেটা উপলব্ধি করার মতো অনেক বিচক্ষণ নেতা বিএনপি এবং তাদের মিত্র দলগুলোতে রয়েছে বলেই আমরা মনে করি। আন্দোলন আর নাশকতা এক কথা নয়। অভিজ্ঞতা শেখায় যে, জনগণ যখন আন্দোলনে সাড়া দেয় না তখন উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করেন কুশলী রাজনীতিকরা। সড়কপথে পেট্রোল বোমায় জীবন্ত দগ্ধ হওয়ার ভয়ে পথে যানবাহন বের করেন না অনেক লোক। এর ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষতি হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের সংগঠন থেকে বলা হয়েছে, দিনে ক্ষতির পরিমাণ অন্তত দুই হাজার কোটি টাকা। এভাবে দেশের ক্ষতি করে কী লক্ষ্য অর্জিত হবে? বিএনপির নেতারা বলছেন, লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। এমন সংকল্পে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু দেশবাসীর মতো আমাদেরও আকুতি_ সহিংসতা বন্ধ করুন, মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের নির্বিঘ্নে পরীক্ষাকেন্দ্রে যেতে এবং পরীক্ষা শেষে ঘরে ফিরতে দিন। মানুষকে একটু মুক্ত নিঃশ্বাস ফেলতে দিন। ঘর থেকে বের হয়ে নিরাপদে ঘরে ফেরার পরিবেশ সৃষ্টি করুন। এ পথে চললে জনগণ তাকে 'আন্দোলনকারীদের' পরাজয় মনে করবে না, বরং বাস্তবতা উপলব্ধি করার জন্য সাধুবাদই দেবে।

No comments

Powered by Blogger.