অতঃপর বোম্বেতে... by আলী যাকের

বোম্বে এত বিশাল শহর যে, কয়েকদিনের মধ্যে এই শহরটির সব দেখে শেষ করা যায় না। এমনকি বিশেষ দ্রষ্টব্য স্থানগুলোও নয়। এখন তো বোম্বে আরও বড় হয়ে গেছে। কিন্তু ১৯৮০তে যখন আমি দ্বিতীয়বারের মতো বোম্বে গিয়েছিলাম, তখনও এ শহরটি প্রায় সীমাহীন আয়তনের ছিল। উত্তরে সান্তাক্রস বিমানবন্দর থেকে শুরু করে দক্ষিণে কোলাবা পর্যন্ত শহরটি প্রদক্ষিণে তখনও অনেক সময় লেগে যেত। বোম্বের গল্পে আসার আগে গোয়া সফরের একটি বিষয় বলে নিতে চাই। এটি অনুলি্লখিত রয়ে গিয়েছিল। আমরা যেদিন কালাংগুট সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গিয়েছিলাম সেদিন ছিল পূর্ণ সূর্যগ্রহণ। এই দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ আরও এই কারণে যে, এর আগে কখনও উন্মুক্ত প্রান্তরে পূর্ণ সূর্যগ্রহণ দেখার সৌভাগ্য আমাদের কারও হয়নি। সৈকতে বসে থাকতে থাকতে কখন যে সূর্যের আলো মৃদু থেকে মৃদুতর হচ্ছিল আমরা লক্ষ্য করিনি। হঠাৎ সচকিত হয়ে আবিষ্কার করলাম, চারপাশ সব অন্ধকার হয়ে গেছে। সে এক গা ছম্ ছম্ করা রোমাঞ্চকর অনুভূতি। মনে হচ্ছিল যেন চারদিকে সবকিছু হঠাৎ করে থেমে গেছে। এমনকি সমুদ্রের ঢেউও একেবারে নিস্তব্ধ। হঠাৎ করেই রোমান্টিক যুগের কবি স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজের লেখা 'দ্য রাইম অব দ্য এনসিয়েন্ট মেরিনার' কবিতাটির কথা মনে পড়ে গেল। সেই যখন দৈব নির্দেশে সাগরের ঢেউ এবং স্রোত থেমে গিয়েছিল। সমুদ্রের জলকে মনে হচ্ছিল ইস্পাতের মতো স্থবির। পাখির কলকাকলি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। জাহাজ নিস্পন্দ হয়ে গিয়েছিল। সূর্য ছিল মধ্য গগনে স্থির। তখন কেবল সূর্য ছিল না কোথাও। সূর্যের চারপাশে সোনালি একটি আংটির মতো গোল রেখা জ্বলজ্বল করছিল। এমন অদ্ভুদ দৃশ্য এর আগে আমরা কখনও অবলোকন করিনি। আমাদেরও যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। আমরা জানতাম আজ সূর্যগ্রহণ হবে। তবে ভুলেই গিয়েছিলাম বিষয়টির কথা।
আমরা বোম্বেতে উঠেছিলাম অভিজাত কাফ প্যারেড এলাকায় একটি বহুতল ভবনে আমার কলকাতার বন্ধু রাম চন্দ্র রায়ের আনুকূল্যে হিন্দুস্তান টমসন কোম্পানির ট্র্যানজিট ফ্ল্যাটে। এই গোটা সফরে এতদিন বাদে আমরা একটি অত্যন্ত বিলাসবহুল জায়গায় থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম। ইরেশ মহাখুশি। বাথরুমটিও খুব পছন্দ হয়েছিল ওর। এই বাথরুমের টাবে বসে ও ঘণ্টা খানেক ধরে স্নান করত। ভারতের পূর্বে অবস্থিত কলকাতা থেকে দক্ষিণের পাড় ধরে সর্ব দক্ষিণে, তারপর আবার পশ্চিমে আরব সাগরের তীর ঘেঁষে উঠে এলাম বোম্বে শহরে। দু'সপ্তাহের এই দীর্ঘ পরিক্রমায় আমরা বড়ই ক্লান্ত ছিলাম। কোথাও আমাদের কাপড়-চোপড় ধোয়ার সুযোগ মেলেনি। আমরা নিজেরাও সমুদ্রের ধারে কিংবা কড়া রোদের প্রহারে কিম্ভূতকিমাকার হয়ে উঠেছিলাম। আমাদের অর্ধেক দিন কেটে গেল নিজেদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে। প্রথমেই নোংরা কাপড়গুলো লন্ড্রিতে দিয়ে দিলাম। তারপর বাইরে গিয়ে একটি রেস্তোরাঁয় খাওয়া-দাওয়া করে এসে একটি দীর্ঘ ঘুম।
ঘুম ভাঙল পেটে প্রচণ্ড খিদে নিয়ে রাত ন'টায়। যে ফ্ল্যাটটিতে উঠেছিলাম সেখানে খাবারের কোনো বন্দোবস্ত ছিল না। অতএব বাইরে গিয়ে খেতে হবে। এই প্রথমবার ভেবেচিন্তে রেস্তোরাঁ বের করার একটি সুযোগ পাওয়া গেল। কেননা বোম্বে শহরটিতে আর যাই হোক না কেন খাবারের জায়গার কোনো অভাব নেই। কোনো কালেই ছিল না।
এই শহরে থাকব আরও তিনদিন। তারপর ফেরার পালা। ফেরার পথেই আমাদের মূল আকর্ষণ ইলোরা এবং অজন্তা দেখে কলকাতার উদ্দেশে যাত্রা হবে শুরু। অতএব তিনদিনে বোম্বের যতখানি দেখা যায় সেই চেষ্টা। একটা গল্প শুনেছিলাম, সাহেবরা ভারত ভ্রমণের পর দেশে ফিরলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় জিজ্ঞেস করা হয়ে থাকে 'হ্যাভ ইউ ডান বোম্বে'? জবাবটা যদি না বোধক হয় তাহলে প্রশ্ন কর্তা বলেন, 'দ্যান ইউ হ্যাভ নট ডান ইন্ডিয়া'। অর্থাৎ বোম্বে দর্শন না হলে ভারত দর্শন হলো না। অথচ কিই-বা আছে এই শহরে? এটি ইতিহাস খ্যাত নগর নয়, দিলি্লর মতো। দিলি্ল শুরু হয়েছিল ইন্দ্রপ্রস্থ দিয়ে। তারপর ছয়টি ভিন্ন, ভিন্ন কালে ছয়বার দিলি্লকে রাজধানী হতে হয়েছে। যে জন্য 'দ্য সিক্স ক্যাপিটালস অফ ডেলহি' একটি বিখ্যাত উক্তি। বোম্বে কেবলই একটি বাণিজ্যিক নগরী। তবে সেই কারণেই এ শহরটিতে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে নানা ধরনের মানুষের আনাগোনা। এক কথায় বলা যায় ভারতের সবচেয়ে কসমোপলিটান নগর এ বোম্বে এবং বোধকরি এ কারণেই শহরটির এমন অসাম্প্রদায়িক চরিত্র।
আমরা তিনদিনে বোম্বের উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম সর্বত্র ঘুরে বেড়ালাম। তখনও বিশ্ববিখ্যাত শচীন টেন্ডুলকার আবির্ভূত হননি ক্রিকেটের মাঠে। তবে তখনকার সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির অধিকারী সুনীল গাভাস্কারও বোম্বের খেলোয়াড় ছিলেন।
আমাদের তিনজনেরই ছিল থিয়েটারের প্রতি ভালোবাসা। সেই তাগিদেই গিয়েছি বিখ্যাত অভিনেতা পৃথ্বীরাজ কাপুরের পৃথ্বী থিয়েটার দেখতে। বোম্বের দক্ষিণ-পশ্চিম আরব সাগর তীরে অবস্থিত 'গেট ওয়ে অফ ইন্ডিয়া' দেখে চমৎকৃত হয়েছি সবাই। গেট ওয়ে অফ ইন্ডিয়ার পাশে বিখ্যাত তাজ হোটেল। এখানে সব প্রখ্যাত মানুষ থেকেছেন বিভিন্ন সময়ে। সেই ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের কাল থেকে। এখানকার সব খাবার অত্যন্ত চড়া মূল্যের। তবুও সেখানে বসে কফি খেয়েছি আমরা। ইরেশ খেয়েছে কোকাকোলা। এ শহরের ফ্লোরা ফাউন্টেইন এলাকায় রয়েছে একটি বিখ্যাত বইয়ের দোকান। নাম দ্য স্ট্র্যান্ড। তখন বই কেনার পয়সা ছিল না। তবুও ওই দোকানে গিয়ে বই দেখেছি। বিভিন্ন তাকে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নানা রকম গ্রন্থ। এভাবে কেটে গেছে তিনটি দিন। অতঃপর এক সকালে বোম্বের গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল রেলস্টেশন থেকে স্বল্প দূরত্বের একটি প্যাসেঞ্জার ট্রেনে উঠে বসেছি ইলোরা-অজন্তার উদ্দেশে।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.