এক রাতে ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত ৩

এক রাতে মাত্র ছয় ঘণ্টার ব্যবধানে র‌্যাব-পুলিশের কথিত ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন তিনজন। শনিবার রাতে ঢাকা, কুমিল্লা ও যশোরে এসব ঘটনা ঘটে। রাজধানী ঢাকায় পুলিশের সঙ্গে ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন শিবির নেতা জসীম উদ্দিন মুন্সি (২৫)। ঢাকার বাইরে কুমিল্লায় নিহত হয়েছেন স্বপন মিয়া (৩৭) নামে এক যুবক। যশোরে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মেহেদী হাসান ওরফে রাজু ওরফে ভাইপো রাজু (২৫) নামে অপর এক যুবক নিহত হয়েছেন। নিহত জসীম ছাত্রশিবিরের নেতা হলেও অপর দু’জনের রাজনৈতিক কোন পরিচয় পাওয়া যায়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষ্য, এ দু’জন স্থানীয় সন্ত্রাসী। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। সর্বশেষ ক্রসফায়ারে নিহত হওয়া এই তিন জন মিলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী গত ৫ই জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত অন্তত ২০ জন ক্রসফায়ারে নিহত হলেন। যদিও মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং অধিকারের তথ্য অনুযায়ী এই সংখ্যা আরও বেশি। পুলিশ জানায়, গতকাল ভোরে রাজধানীর শেরেবাংলানগর এলাকায় পুলিশের ক্রসফায়ারে এক শিবির নেতা জসীম উদ্দিন নিহত হন। শনিবার রাজধানীর শ্যামলী এলাকায় মিছিল থেকে কর্তব্যরত এক পুলিশ সার্জেন্টের ওপর ককটেল হামলা চালানোর ঘটনায় চার যুবককে আটক করে পুলিশ। আটককৃত ওই যুবকরা জসীমের নাম বলে। পরে তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী শনিবার রাতেই জসীমকে মিরপুর এলাকা থেকে আটক করা হয়। পরে ভোরে ঢাকা মহানর গোয়েন্দা পুলিশ ও শেরেবাংলানগর থানা পুলিশের যৌথ একটি দল জসীমকে নিয়ে তার অপর সহযোগীদের ধরতে অভিযান শুরু করে। জসীমকে নিয়ে পুলিশ আগারগাঁওয়ের ষাট ফুট রাস্তায় গেলে জসীমের সহযোগীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এ সময় জসীম পুলিশের গাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় ক্রসফায়ারে পড়ে মারা যান তিনি। তবে নিহত পরিবারের দাবি, বোনের বাড়ি যাওয়ার সময় মেধাবী এই ছাত্রকে লেগুনা থেকে সন্দেহজনকভাবে আটক করে পুলিশ। পরে তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়।
শেরেবাংলানগর থানার ওসি গোপাল গনেশ বিশ্বাস জানান, শনিবার সকালে শ্যামলী এলাকায় অবরোধের সমর্থনে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে শিবিরের নেতাকর্মীরা। এ সময় তারা সেখানে থাকা পুলিশের একটি টহল দলের গাড়িকে লক্ষ্য করে পরপর তিনটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে ওই এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পথচারীরা এদিক সেদিক ছোটাছুটি শুরু করেন। দুর্বৃত্তরা রাস্তায় দায়িত্ব পালনকারী এক পুলিশের সার্জেন্টের ওপর হামলা চালায়। পরে জমীস উদ্দীনকে আটক করা হয়। তিনি আরও জানান, আটককৃত জসীমকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে। তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী জসীমকে নিয়ে আনুমানিক রাত ৩টার সময় শেরেবাংলানগর থানাধীন আগারগাঁওয়ের তালতলার ষাটফুট রাস্তা এলাকায় অভিযান চালায় পুলিশের একটি টহল দল। এ সময় আগে থেকে ওত পেতে থাকা দুর্বৃত্তরা পুলিশের গাড়িকে লক্ষ করে গুলি ছুড়ে। পুলিশও তাদের লক্ষ করে পাল্টা গুলি ছুড়ে। এ সময় গাড়ি থেকে জসীম পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছেন। পরে পুলিশ নিহতের লাশের ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গে পাঠায়। এ ঘটনায় শেরেবাংলানগর থানায় একটি মামলা করা হয়েছে।
গতকাল সকাল ১১টায় নিহতের ভাই আনিসুর রহমান মর্গে এসে তার লাশ শনাক্ত করেন। আনিসুর রহমান জানান, তার ভাই মণিপুরি পাড়ার একটি মেসে থাকত। শিবিরের সদস্য ছিল সে। শনিবার শ্যামলীর রাস্তা দিয়ে একটি যাত্রীবাহী লেগুনাতে করে তার বোন হাফিজা বেগমের বাড়ি গাবতলীতে যাচ্ছিল। ওই লেগুনা থেকে শিবির সন্দেহে তাকে আটক করে পুলিশ। এরপর থানায় যোগাযোগ করা হলে তাকে আটকের কথা স্বীকারও করা হয়। পরে জানতে পারেন পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে। আনিসুর জানান, তার ভাই অত্যন্ত মেধাবী ছিল। দাখিলে এ-প্লাস ও আলিমে এ গ্রেড পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিল। বর্তমানে সে কাজীপাড়া মাদরাসার ফাজিল শেষ বর্ষের ছাত্র ছিল। এছাড়া তিনি ঢাকা মহানগর মিরপুর পূর্ব থানা শিবিরের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিল। এর আগেও জসিম একবার মিরপুর থানা পুলিশের হাতে আটক হয়েছিল। কয়েক মাস জেলেও ছিল। পরে আদালত থেকে জামিন নিয়ে জেল থেকে মুক্তি পায়। জসীম কোন অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল না। যদি অপরাধ করেই থাকতো তাহলে তার আইনের মাধ্যমে শাস্তি হতো। তার ভাইকে পুলিশ পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। তাকে যারা হত্যা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তিনি দাবি করেন। জসিমের পিতার নাম আব্দুর রাজ্জাক মুন্সি। গ্রামের বাড়ি বরিশাল জেলার বন্দরহাট থানার কুন্দিয়াল পাড়ায়। তিনভাই ও চার বোনের মধ্যে ষষ্ঠ ছিল জসিম। হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ সূত্র জানায়দ, তার শরীরের বুক, পিঠসহ বিভিন্নস্থানে ১২টি গুলির চিহ্ন আছে। ময়নাতদন্তে শেষে গতাকলই তার লাশ পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
এদিকে জসীম নিহত হওয়ার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির। গতকাল এক বিবৃতিতে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি আবদুল জব্বার ও সেক্রেটারি জেনারেল আতিকুর এক বিবৃতিতে অভিযোগ করে বলেন, ‘শনিবার সকাল ৮টার দিকে ঢাকা মহানগর পশ্চিম শাখা শিবির শ্যামলীতে বিক্ষোভ মিছিল করে। এরপর সেখান থেকে তারা ফেরার পথে একটি লেগুনা থেকে মিরপুর পূর্ব থানা শিবিরের সাংগঠনিক সম্পাদক জসীম উদ্দিন হাওলাদারসহ ৪ জনকে আটক করে পুলিশ। পরে তাদেরকে শেরেবাংলানগর থানায় নেয়া হয়। বিষয়টি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমেও প্রচারিত হয়। বিবৃতিতে আরও অভিযোগ করা হয়, নিরপরাধ জসীম উদ্দীনকে রাতের অন্ধকারে শেরেবাংলানগর থানার তালতলা এলাকায় নিয়ে কথিত ক্রসফায়ারের নামে গুলি করে হত্যা করে ডিবি পুলিশ। শিবিরের দুই শীর্ষ নেতা আরো বলেন, নিরপরাধ মেধাবী ছাত্রদের উপর ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে পুলিশ যে অমানবিক নির্মমতার পরিচয় দিয়েছে তাতে দেশবাসী আজ বাকরুদ্ধ। এভাবে একের পর এক ছাত্রদের হত্যার অধিকার কাউকে দেয়া হয়নি। জনগণের জানমাল রক্ষায় প্রয়োজনে যা করার তাই করার সিদ্ধান্ত ছাত্রসমাজ নিবে  বলে বিবৃতিতে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়।

কুমিল্লা থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, শনিবার রাত ১টার দিকে কুমিল্লায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ স্বপন মিয়া ওরফে কালা স্বপন নামে এক যুবক নিহত হয়েছে। নিহত স্বপন পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী বলে জানা গেছে। স্বপন জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলার উত্তর রামপুর গ্রামের মো. কাইয়ুম মিয়া ওরফে কালা মিয়ার ছেলে। সদর দক্ষিণ থানার ওসি প্রশান্ত পাল জানান, শনিবার সকালে কোটবাড়ি নন্দনপুর এলাকা থেকে স্বপনকে গ্রেপ্তার করা হয়। রাতে পুলিশের একটি টিম তাকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে উপজেলার ভাটপাড়ায় পৌঁছালে স্বপনের সহযোগীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এ সময় আত্মরক্ষার্থে পুলিশও পাল্টা গুলি  চালায়। এতে ঘটনাস্থলে গুলিবিদ্ধ হয়ে স্বপন আহত হয়। তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করার পর সেখানে তার মৃত্যু হয়। তার বিরুদ্ধে স্থানীয় যুবলীগ নেতা মোস্তাক আহমেদ হত্যা মামলা ও সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অপহরণ, মাদকসহ ২৮টি মামলা রয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশের ৫ সদস্য আহত হয়েছে বলে পুলিশ দাবি করেছে। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ ১টি পিস্তল ও কয়েক রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকের সহযোগী সামছুদ্দিন মিয়া জানান, রাত ১টা ৫৫ মিনিটে সদর দক্ষিণ থানার এসআই সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মাথা ও মুখে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় স্বপনের লাশ হাসপাতালে নিয়ে আসে। স্থানীয় সূত্র জানায়, সদর দক্ষিণ উপজেলার পদুয়ার বাজার বিশ্বরোডে যুবলীগ নেতা মোস্তাক ও স্বপনের মধ্যে সিএনজি স্ট্যান্ডের চাঁদা তোলা নিয়ে বিরোধ ছিল। ওই বিরোধের জের ধরে ২০১৩ সালের ১০ই জুলাই খুন হয় যুবলীগ নেতা মোস্তাক আহমেদ। তবে নিহত স্বপনের ভাই মোতালেব জানান, ‘তার ভাই যুবলীগের কর্মী ছিল, সে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ একটি গ্রুপের ষড়যন্ত্রের শিকার। পুলিশ তাকে আটক করার পরদিন রোববার সকালে খবর পেয়ে হাসপাতালে গিয়ে লাশ শনাক্ত করেন তারা। নিহত স্বপনের ৩ ছেলে ২ মেয়ে রয়েছে।’ রোববার কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নিহতের লাশের ময়নাতদন্ত শেষে গ্রামের বাড়িতে বিকালে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
যশোর থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, শনিবার মধ্যরাতে যশোরে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ‘কথিত’ ক্রসফায়ারে সন্ত্রাসী হিসেবে অভিযুক্ত মেহেদী হাসান ওরফে রাজু ওরফে ভাইপো রাজু নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। র‌্যাব জানিয়েছে গুলি বিনিময়কালে নিজের সহযোগীদের গুলিতেই মারা যায় সে। র‌্যাব যশোর ক্যাম্পের অধিনায়ক মেজর আশরাফ উদ্দিন জানান, একাধিক হত্যা, ছিনতাই ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন মামলার আসামি রাজু ওরফে ভাইপো রাজুকে শনিবার রাতে আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে সে তার কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকার কথা স্বীকার করে। রাতেই র‌্যাব সদস্যরা তাকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে বের হয়। ভোর পাঁচটার দিকে শহরতলির মুড়লিতে যশোর-খুলনা মহাড়কের পাশে ইশমাম পেট্রল পাম্পের বিপরীতে একটি ইটভাটার কাছে পৌঁছালে রাজুর সহযোগীরা র‌্যাব সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। গুলি বিনিময়কালে পালাতে গিয়ে নিজের সহযোগীদের গুলিতে জখম হয় রাজু। এ সময় তার সহযোগীরা পালিয়ে যায়। তাকে উদ্ধার করে যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। মেজর আশরাফ আরও জানান, ঘটনাস্থল থেকে একটি বিদেশী রিভলবার ও একটি শাটার গান এবং দুইটি গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। নিহত রাজু যশোর শহরের গাড়িখানা রোড এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা আজিবর রহমানের ছেলে। তার বিরুদ্ধে যশোরের সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর এজেডএম ফিরোজের একমাত্র ছেলে অর্নব হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলা রয়েছে বলে কোতোয়ালি থানার ওসি ইনামুল হক নিশ্চিত করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.