শিক্ষাকার্যক্রম লণ্ডভণ্ড- ভর্তি এখনো শেষ হয়নি ; সেশন জটের আশঙ্কা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ; স্কুল-কলেজ খোলা তবে শিক্ষার্থী নেই by আমানুর রহমান

লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে দেশের শিক্ষাকার্যক্রম। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় সীমাহীন অনিশ্চয়তায় পড়েছে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা স্তর পর্যন্ত সর্বত্র। শিক্ষাজীবন নিয়ে অনিয়শ্চয়তায় পড়েছে চার কোটি ৭৪ লাখ ৫২ হাজার ৩৭৪ জন শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা। শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষা এসএসসির সময়সূচি ইতোমধ্যেই ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে।  কোনোমতে দু’টি পরীক্ষা নেয়া হলেও পরবর্তী পরীক্ষা অনুষ্ঠানে রয়েছে অনিশ্চয়তা। আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষা নিয়েও সংশয় কাটছে না।  বছরের শুরুর দিন থেকেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের কাস শুরুর কথা থাকলেও কোথাও নিয়মিত কাস শুরু হয়নি। স্কুলগুলোতে রি-অ্যাডমিশন এখনো শেষ হয়নি। কলেজে আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতিতেও ভাটা পড়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কাস ও পরীক্ষা হচ্ছে ধুঁকে ধুঁকে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশন জটের আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
দেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটে সরকার ও বিরোধী দলের অনড় অবস্থানের কারণে পুরো শিক্ষাব্যবস্থা থমকে গেছে। হরতালের মধ্যেই প্রাথমিক-মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেয়া হলেও পরে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচিতে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাস শুরু করা যায়নি। প্রাথমিক-মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষার্থীদের নতুন কাসে ভর্তি এখনো শেষ হয়নি। দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম ভিকারুন নিসা নূন স্কুলে পুনঃভর্তির সময় নতুন করে ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে পুনঃভর্তির নতুন সূচি ঘোষণা করা হয়েছে। আরেক সেরা স্কুল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পুনঃভর্তির সময়ও বাড়ানো হয়েছে বলে গতকাল জানিয়েছেন অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা। তিনি বলেন, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অবরোধের মধ্যেও কাস চালু রাখতে হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কম। আর হরতালের মধ্যে কাস বন্ধ রাখা হয়। শিক্ষা ক্যালেন্ডারের এক মাস কোনো কাস করা যায়নি। এসএসসি পরীক্ষা নেয়া যাচ্ছে না। আসন্ন এইচএসসির কী হবে? তিনি বলেন, এরূপ অনিশ্চয়তার অবসান হওয়া দরকার।
ভিকারুন নিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণীতে পুনঃভর্তির জন্য ৮, ৯ ও ১০ ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত শাখা থেকে ভর্তি ফরম ও বেতনের রসিদ সংগ্রহ করে জমা দিতে বলা হয়েছে। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় জানুয়ারি মাসে ভর্তিকার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। তাই নতুন তারিখ ঘোষণা করা হয়।
পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী পগোজ স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীর মা বেগম উন্মেহানী খানম নয়া দিগন্তকে বলেন, সন্তানেরা নতুন কাসে উঠেছে। আনন্দ-খুশিতে নতুন বই নিয়ে স্কুলে যাবে। কিন্তু বছরের শুরুর দিন থেকেই রাজনৈতিক অস্থিরতার শিকার হতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। অভিভাবক হিসেবে তিনি এ অচলাবস্থার অবসান চাচ্ছেন।
মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি উচ্চবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ বেলায়েত হোসেন জানান, নির্দিষ্ট সময়ে সিলেবাস শেষ করতে হবে। অবরোধ থাকলেও সিলেবাস শেষ করার জন্য শুক্রবার কাস নেয়া হচ্ছে।
সেন্ট যোশেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ব্রাদার রবি পিউরিফিকেসন বলেন, এক বছরের মধ্যেই ছেলেমেয়েদের কোর্স শেষ করতে হবে। এখন কাস করতে না পারলে তারা পিছিয়ে পড়বে।
গত ২ ফেব্রুয়ারি থেকে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও টানা অবরোধের মধ্যে নতুন করে হরতাল যুক্ত হওয়ায় এ পর্যন্ত চারটি বিষয়ের পরীক্ষা পেছানো হয়েছে। অন্যান্য বিষয়ের পরবর্তী পরীক্ষাগুলো ঘোষিত সময়ের মধ্যে নেয়া যাবে কি না তা নিয়ে আশঙ্কা-হতাশা রয়েছে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে।
সহিংসতার আশঙ্কায় কলেজগুলো এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের মডেল টেস্ট ও কোচিং বন্ধ রয়েছে। কলেজগুলোতে এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য মডেল টেস্ট নেয়া যাচ্ছে না। পরীক্ষার্থীরা কোচিং সেন্টারনির্ভর হয়ে পড়েছে। আগামী এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এইচএসসি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে সমস্যা হচ্ছে।
অন্য দিকে অব্যাহত হরতাল-অবরোধের প্রভাব পড়েছে দেশের উচ্চ শিক্ষাঙ্গনেও। প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজ করছে অস্থিরতা-স্থবিরতা। একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান, কাস ও টিউটোরিয়াল পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। যেগুলোতে কাস হচ্ছে সেগুলোতে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কম। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহনব্যবস্থা সচল না থাকায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক (সম্মান) শ্রেণীর কাস শুরুর কথা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি ডিগ্রি ও স্নাতক পর্যায়ের কলেজগুলোতে কাস ও পরীক্ষা নেয়া।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে চার কোটি ৪৪ লাখ ৫২ হাজার ৩৭৪ জন। এর বাইরে দেশের ৩৪টি পাবলিক ও ৮০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৩০ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অবরোধের মধ্যে দেশের সর্ববৃহৎ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দফতর ও বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকেরা তাদের অফিস খোলা রেখেছেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দফতর ও বিভাগ খোলা রাখা হচ্ছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রম বিঘিœত হচ্ছে। তবে বেশির ভাগ বিভাগেই কোনো কাস বা পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে না। কয়েকটি বিভাগে কাস নেয়া হলেও সেখানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল কম। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে শিক্ষার্থীদের আনা-নেয়ার জন্য কোনো পরিবহন ছেড়ে যাচ্ছে না।
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০ দলের চলমান অবরোধে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে প্রথম বর্ষ স্নাতক (সম্মান) শ্রেণীর ভর্তিকার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। এর আগে প্রথম বর্ষের ভর্তিপ্রক্রিয়া ১১ থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত চলার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কা থেকে অনেক শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক হলও ছেড়ে দিয়েছে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের প্রতিনিধিদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও নতুন শিক্ষাবর্ষে স্নাতক শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের কাস শুরুর মওসুম চলছে। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে কাস শুরু করা যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে শিক্ষার্থীদের আনা-নেয়ার জন্য কোনো পরিবহন ছেড়ে যাচ্ছে না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় সব বিভাগে কাস-পরীক্ষা মোটামুটি হচ্ছে। তবে উপস্থিতি বেশ কম। ঢাকা থেকে এসে যেসব শিক্ষার্থী কাস করছেন তাদের কাস কম হচ্ছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শীতকালীন ছুটি শেষে গত ১২ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছে। গত মঙ্গলবার থেকে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের কাস শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি, আরবি, দর্শন, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগের পূর্বনির্ধারিত পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। অন্য বিভাগে কাস-পরীক্ষা নিয়মিত হচ্ছে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের প্রথম বর্ষের ভর্তিকার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। পরীক্ষার ফল প্রকাশের মাস পেরিয়ে গেলেও ভর্তির সাক্ষাৎকার শুরু করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় এক মাস ধরে সব বিভাগের কাস বন্ধ রয়েছে।
কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ। দুই মাস ধরেই বন্ধ রয়েছে এটি। এতে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। ইতোমধ্যেই সেশন জট চরম আকার ধারণ করেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের  চেয়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দুই-তিন সেমিস্টার এগিয়ে গেছে। জানা গেছে, একজন শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় গত বছরের ২৯ নভেম্বর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত টানা ৩৭ দিন বন্ধ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়টি। ৭ জানুয়ারি খুললেও এক জরুরি সিন্ডিকেট সভায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে রাজনৈতিক অস্থিরতায় প্রায় সব ক’টি বিভাগের শিক্ষার্থীরা আট মাসের সেশন জটে ছিলেন। চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি থেকে আরো প্রায় এক মাস যোগ হয়েছে। এ অবস্থায় সেশন জট দীর্ঘায়িত হওয়া নিয়ে শঙ্কিত শিক্ষার্থীরা। সব ক’টি বিভাগে কাস-পরীক্ষা হচ্ছে না।
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গত ৫ জানুয়ারির পর থেকে মাত্র চার দিন কাস-পরীক্ষা হলেও বাকি দিনগুলো বন্ধ থেকেছে কাস-পরীক্ষা। রাজনৈতিক অস্থিরতায় একের পর এক পরীক্ষা পেছানো হচ্ছে। বর্তমানে বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীরা প্রায় পাঁচ থেকে ছয় মাসের সেশন জটে রয়েছেন। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাস ও পরীক্ষা চললেও বন্ধ রয়েছে নিজস্ব বাস সার্ভিস। ফলে ভোগান্তিতে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা।
রাজনৈতিক অস্থিরতার কবলে পড়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সেশন জটমুক্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গত এক মাসে কাস ও পরীক্ষা না হওয়ায় প্রায় প্রতিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশন জটের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। অবরোধের মধ্যে কাস-পরীক্ষা চালানোর সিদ্ধান্ত থাকলেও অভিভাবকদের অনুরোধে এবং হরতালে তা বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে মধ্য ফেব্রুয়ারিতে ‘মিড টার্ম’ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান না হলে ‘মিড টার্ম’ পরীক্ষা পেছানো হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.