সংকটে দেশীয় সিরামিক শিল্প- হরতাল-অবরোধে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র by আবুল হাসনাত

চলমান টানা রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশের সিরামিক খাতে প্রতিদিন ১০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। সে হিসাবে গত ৩০ দিনে এই শিল্পের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০০ কোটি টাকা।
এ তথ্য বাংলাদেশ সিরামিক ওয়্যারস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের। সংগঠনটি বলছে, তাদের উৎপাদিত পণ্যের বিক্রি এবং সারা দেশে সরবরাহ বেশ কমে গেছে। এ ছাড়া পণ্য পরিবহনে তিন-চার গুণ বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে তাদের। আবার বিক্রি না হওয়ায় কারখানায় পণ্য জমে গেছে। ফলে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সিরামিক প্রস্তুতকারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইরফান উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ক্ষতিটা হচ্ছে কয়েকভাবে। প্রথমত আমরা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কাঁচামাল কারখানায় আনতে পারছি না। আবার রপ্তানির জন্য সিরামিক পণ্য বন্দরে পৌঁছাতে পারছি না। আবার উৎপাদিত পণ্য সারা দেশে পৌঁছাতে পারছি না। পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সব ক্ষেত্রেই আমাদের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।’
কারখানায় পণ্যের প্রচুর মজুত জমেছে মন্তব্য করে ইরফান উদ্দিন বলেন, ‘আমরা কিন্তু চুল্লি বন্ধ রাখতে পারি না। গ্যাস কিন্তু ঠিকই পুড়ছে। ফলে আমাদের উৎপাদন চালিয়ে যেতেই হয়। আগে যেখানে ৭০ হাজার ইউনিট পণ্য উৎপাদন হতো, এখন হচ্ছে ৪০ হাজার ইউনিট।’
দেশে বর্তমানে ৫০টির বেশি প্রতিষ্ঠান সিরামিক পণ্য প্রস্তুত করে। এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ৫ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবছর সিরামিক পণ্য রপ্তানি করে আয় হয় প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। আর দেশে এই পণ্যের বাজার আনুমানিক আড়াই হাজার কোটি টাকার। সিরামিকশিল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
সিরামিক প্রস্তুতকারক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, হরতাল-অবরোধে বেশির ভাগ দোকানই বন্ধ থাকে, খোলা থাকলেও ক্রেতা থাকে না। আবার দেশের বিভিন্ন স্থানে স্বাভাবিকভাবে পণ্য পৌঁছানো যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে সিরামিক পণ্যের বিক্রি ও সরবরাহ কমে গেছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। এর আনুমানিক মূল্য ৩ কোটি টাকা। আবার আমদানি করা কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্য পরিবহনে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে তিন-চার গুণ অতিরিক্ত ব্যয় গুনতে হচ্ছে। এতে পণ্য পরিবহনে দৈনিক লোকসান হচ্ছে গড়ে ২০ লাখ টাকা। এসব কারণে উৎপাদন ও আনুষঙ্গিক ব্যয় বেড়েছে ১০-১৫ শতাংশ।
অন্যদিকে অনেক কারখানাই এখন কাঁচামালের সংকটে পড়েছে। একদিকে ট্রাকের সংকট, অন্যদিকে পরিবহন ব্যয় অনেক বেড়ে যাওয়ায় আমদানি করা কাঁচামাল বন্দর থেকে আনা যাচ্ছে না। ফলে অনেক কারখানায় কাঁচামালের মজুত শেষ হয়ে গেছে। আবার সিরামিক পণ্যের বিক্রি কমে যাওয়ায় কারখানাগুলোতে প্রস্তুত পণ্যের মজুত জমে গেছে। এসব পণ্য এখন রাখাও যাচ্ছে না। ফলে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান।
সমিতির তথ্য অনুযায়ী, উৎপাদিত পণ্যের মজুত জমে যাওয়ায় এবং কাঁচামালের ঘাটতির কারণে এরই মাধ্যে ১৫-২০ শতাংশ উৎপাদন কম হচ্ছে। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে যেকোনো সময় কারখানার পুরো উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
সংগঠনটি বলছে, রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিদেশি ক্রেতারা দেশে আসছে না। সে কারণে রপ্তানির নতুন কাজও পাওয়া যাচ্ছে না। যতটুকু রপ্তানির কাজ আছে, পরিবহন সমস্যার কারণে তা-ও সময়মতো রপ্তানি করতে না পারায় বিদেশি ক্রেতারা এ দেশি পণ্য কেনার বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এসব কারণে কিছু কাজ এরই মধ্যে বাতিল হয়ে গেছে। এতে সামনের দিনগুলোতে সিরামিক পণ্যের রপ্তানি দ্রুত কমে যাবে। সিরামিক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক সংকটের দিকে যাচ্ছে।
সমিতির নেতারা বলছেন, চলমান অস্থিরতায় পণ্য বিক্রি না হলেও কারখানার ব্যয় কমেনি। শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে হচ্ছে। একই সঙ্গে পরিশোধ করতে হচ্ছে সুদসহ ব্যাংকঋণের কিস্তির টাকা। ফলে উৎপাদন চালিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এখন ঋণখেলাপি হওয়ার পথে।
সে কারণেই সংগঠনটির নেতারা এখন ব্যাংকঋণের বিপরীতে আগামী ছয় মাস পর্যন্ত সুদ মওকুফ এবং আগামী এক বছর পর্যন্ত ডাউন পেমেন্ট ছাড়া ঋণ নবায়ন করার সুযোগ দেওয়ার জন্য তফসিলি ব্যাংকগুলোর প্রতি নির্দেশনা জারি করার দাবি করছেন।

No comments

Powered by Blogger.