সঙ্কটকে স্বীকার করে ছাড় দিন by আলী ইদরিস

দেশের  দুরবস্থা, মানুষের অবর্ণনীয় ভোগান্তি- এ সবের জন্য কাকে দোষ দেব, আমাদের ভাগ্যকে না কর্মফলকে। প্রবাদ আছে ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’। প্রবাদটি যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে আমাদের ভাগ্যকে নয়, কর্মকেই দায়ী করতে হয়। ২০০১ সালে বিএনপিকে এবং ২০০৮ সালে ১৪দলীয় মহাজোটকে আমরা ভোট দিয়ে যেভাবে নিরঙ্কুশ বিজয় এনে দিয়েছিলাম সেটা কি ভুল হয়েছিল? ভুল আমাদের হয় নি। ভোট তো আমাদের এক দলকে দিতেই হবে। কিন্তু উভয় বছরে আমরা ভোটারগণ ক্ষমতাসীন দলের কর্মকাণ্ডকেই বিবেচনায় নিয়েছিলাম। সুতরাং ভোটার নয়, রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডই তাদের জয় বা পরাজয়ের জন্য দায়ী। জলের মতো এই সহজ এবং পরিচ্ছন্ন সত্যিটি রাজনৈতিক দলগুলো অনুধাবন করেও না করার ভান করে। তারা আমাদের নেতা-নেত্রী, হর্তাকর্তা এবং মহান পেশার অধিকারী হয়েও এক দল পেট্রলবোমা  ফাটিয়ে মানুষ হতাহত করছে আরেক দল রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োগ করে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের দমন করছে। অর্থাৎ দু’দলই পেশিশক্তি প্রয়োগ করে নিজেদের ক্ষমতার পরিধি প্রদর্শন করছে  এবং কেউ যে কারোর চেয়ে দুর্বল বা কম মর্যাদাসম্পন্ন নয় তা প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। প্রাধান্য বা প্রভাব দেখাতে পেশিশক্তি প্রয়োগ করে অশিক্ষিত অজপাড়াগায়ের মানুষ অথবা আফ্রিকার দুর্গম অঞ্চলের অসভ্য গোত্র। তারা গ্রামের বা গোত্রের জন্য বীরের মতো মরে অমর হতে চায়। তারা নিজেদের গ্রাম বা গোত্র নিয়েই স্বপ্ন দেখে, বাঁচে এবং মৃত্যুবরণ করে। গ্রাম বা গোত্রের বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে তাদের ধারণা অল্প কিংবা একেবারেই নেই। কিন্তু ২০ ও ১৪দলীয় জোট তো ঐতিহ্যবাহী, পুরানো এবং দেশ শাসনে অভিজ্ঞ রাজনৈতিক দল, তারা সারা দেশের মানুষের  মঙ্গলের জন্য, সারা পৃথিবীর রাজনীতির ভাল দিকগুলো  বিবেচনায় নিয়ে দেশ শাসন করা উচিত। রাজনৈতিক আন্দোলন করতে যেয়ে পেট্রলবোমা  ফাটিয়ে নিরপরাধ মানুষ হতাহত করা কোন ভাবেই কাম্য হতে পারে না। এটা অমানবিক ও বর্বর কাজ। রাজনীতির জন্য এটা  খুবই খারাপ দৃষ্টান্ত। ১৪দলীয় জোট কখনও বিরোধী দলে গেলে যদি তারা একই খারাপ দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে তখন তাদের বারণ করার মতো ২০ দলের মুখ থাকবে না। তর্কের খাতিরে হয়তো বলবেন আওয়ামী লীগও অতীতে হরতাল চলাকালে প্রাণহানি ঘটিয়েছিল। এটাও ছিল খুব খারাপ দৃষ্টান্ত। ২০দলীয় জোট যদি একই কাজ করে, তাহলে মানুষ পার্থক্য করবে কিভাবে। দ্বিতীয়ত. গণতন্ত্রে ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, অহিংসার নীতি অপরিহার্য। প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতিতে গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারে না। প্রাণহানি ও দেশের সম্পদের ক্ষতি হয় এমন কর্মসূচি পরিহার করা উচিত। আন্দোলনের বহু পদ্ধতি আছে। অনশন, মানববন্ধন, পদযাত্রা, স্বেচ্ছায় কারাবরণ, ঢাকায় অনুমতি না মিললে  ঢাকার বাইরে সারা দেশে মিটিং, মিছিল, বিক্ষোভ ইত্যাদি। সরকারের দমন-পীড়নে এসব কর্মসূচি করতে না পারলেও জনসাধারণকে সাক্ষী রেখে বারবার চেষ্টা করাই হলো গণতান্ত্রিক আন্দোলন। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী যে অনশন শুরু করেছেন তা মহৎ কাজ। ক্ষমতাসীন দলের কিছু অগণতান্ত্রিক আচরণের উল্লেখ না করলেই নয়। এ বছরের ৫ই জানুয়ারি একটি সভা বন্ধ করতে ২০দলীয় জোটের নেত্রীকে কিভাবে বালু, ইট- পাথরের ট্রাক, সশস্ত্র পুলিশ, র‌্যাব দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হলো তা কি জনমানুষ মিডিয়াতে দেখেনি? এরপর ঠাট্টা মশকরা করে বলা হলো বেগম জিয়া স্বেচ্ছায় নিজকে অবরুদ্ধ করে রেখেছেন, তিনি বাড়ি মেরামত করার জন্য ইট, বালির ট্রাক এনে রেখেছেন। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োগ করে তাদের দুর্দশায় ঠাট্টা মশকরা করা কি রাষ্ট্রনায়কদের গণতন্ত্র চর্চা? এখনও বলা হচ্ছে, বিএনপির এ আন্দোলন ইস্যুবিহীন, অনর্থক। খুনিদের সঙ্গে কিসের আলোচনা, বিএনপি স্বাধীনতাবিরোধী, সন্ত্রাসী, জঙ্গিবাজ দল। আবার জনৈক নেতা আদেশ পেলে বিএনপিকে নির্মূল, নিশ্চিহ্ন করার হুমকিও দিচ্ছেন। বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করলে গৃহপালিত এরশাদের দল নিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্র চর্চা চলবে কি? আর নিশ্চিহ্ন করা কি গণতান্ত্রিক? আর এক সংসদ সদস্য উনার এলাকায় অবরোধ করলে গুলি চালানো হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আরও একজন সংসদ সদস্য বলেছেন আদালতের বিচার প্রয়োজন নেই, সন্ত্রাসীকে সরাসরি গুলি করা উচিত। একজন নগণ্য নাগরিক হিসেবে দেশের ত্রাণকর্ত্রী দু’নেত্রীর দরবারে আকুল আবেদন জানাচ্ছি যে ভুক্তভোগী অসহায়  জনগণের দুর্দশা লাঘবে আপনাদের ক্ষমতা প্রয়োগে সামান্য ছাড় দিন। দেশের ভেতরে  বিশিষ্ট নাগরিকগণ, সুশীল সমাজ, ব্যবসায়ী সংগঠন অনেকেই সংলাপের পক্ষে মত দিয়েছেন, জাতি সংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ইইউ ইত্যাদি সংস্থা সংলাপের তাগিদ দিচ্ছে, একগুঁয়েমি  না করে আপনাদের ছাড় দেয়া উচিত। সহিংসতা পরিহার করুন, সঙ্কটকে স্বীকার করে তা সমাধানের উদ্দেশ্যে সংলাপে বসুন। দেশটাকে বাঁচান। যিনি যতটুকু ছাড় দেবেন, ইতিহাস, দেশের মানুষ ও সারা বিশ্ব তাকে ততটুকু সম্মান ও মর্যাদা দেবে। >>১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, বুধবার
আলী ইদরিস

No comments

Powered by Blogger.