একটি বই সবার পড়া উচিত by আশরাফ আল দীন

শিরোনামটা অনেকের কাছেই বিজ্ঞাপনের মতো শোনাবে। ব্যাপারটা আসলে তা নয় বরং বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমরা কেউই যখন সমস্যা থেকে উত্তরণের কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছি না, তখন আমার মনে হলো- একই ধরনের পরিস্থিতিতে কী কাণ্ড ঘটে গিয়েছিল অন্য দেশে তা আমরা, আমাদের রাজনীতিবিদেরা হিসাবে আনতে পারি। এতে বোধোদয় হলে মঙ্গল। আর তা না হলে যা অনিবার্য তা-ই হবে। শেষ হয়ে যাবে দেশ, সর্বস্বান্ত হবে দেশের মানুষ! সে কারণেই, আইভান মেলভিন রজার্সের ‘দ্য চাইল্ড সোলজার’ বইটি সবার পড়া উচিত বলে আমার মনে হয়েছে। এই বই সম্পর্কে বিস্তারিত পরে বলছি।
বর্তমানে চরম অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে সমগ্র বাংলাদেশে। রাজধানী ছাড়া পুরো দেশ কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। আর রাজধানীতে কড়া নজরদারিতে জীবনযাত্রা চলছে অনেকটা স্বাভাবিকের মতো। বিশ্বযুদ্ধের সময়ও দেখা গেছে, বেশির ভাগ দেশের রাজধানী শহরগুলোর জীবনযাত্রা সচল ছিল, যদিও পুরো দেশ অচল! সে যা-ই হোক, রাজধানী ঢাকায় এখন বইমেলার মৌতাত! বইমেলায় মানুষের উপচে পড়া ভিড়। তাই বলতে চাইছি, বই পড়ার কথা! যত দূর জানি, প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখিত এগারোটি বই এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। যারা লেখেন বেশি এরা পড়েনও বেশি। সেই সূত্রে বিনীতভাবে অনুরোধ জানাব, আমাদের প্রধানমন্ত্রী যেন এ বইটি অবশ্যই পড়ে নেন। ১৫৮ পৃষ্ঠার বইখানি পড়ার সময় না হলে, অন্তত বইটির শুরুতে যুক্ত মাত্র পাঁচ পৃষ্ঠার ‘গ্রন্থের পেছনের গল্প’টুকু যেন পড়ে নেন। এ ছাড়াও, বিরোধীদলীয় নেতৃসহ পক্ষ-বিপক্ষের সব রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের এই বই পড়া উচিত বলে আমার মনে হয়েছে। কেন পড়া উচিত? তা একটু পরেই বলছি।
শাসকের একগুঁয়েমি ও গৃহযুদ্ধ
৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ রোববারের পত্রিকায় দেখলাম, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- তিনি কোনো অবস্থাতেই জঙ্গিদের কাছে নতি স্বীকার করবেন না। ঘোষণাটি দ্ব্যর্থহীন ও অনমনীয়, সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার ভেতরটা অনিরাপত্তায় কেঁপে উঠল। আমার মনে পড়ল সিয়েরা লিয়নের কথা। দীর্ঘ দশ বছরের গৃহযুদ্ধে সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া দেশটির ধ্বংসাবশেষ আমি অত্যন্ত কাছে থেকে দেখেছি। গণমানুষের কাছে গিয়ে এবং সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের সাথে কাজ করে আমি ওদের ক্ষয়ক্ষতির যে বীভৎস রূপ দেখেছি, তা বর্ণনাতীত। তাই আজো আমি ‘গৃহযুদ্ধ’ শব্দটি শুনলে আর ‘শাসকের একগুঁয়েমি’ দেখলে নিজে নিজেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। এক্ষণে পাঠকদের সম্মানে আমি ‘চাইল্ড সোলজার’ বইটির ৮ নম্বর পৃষ্ঠা থেকে খানিকটা তুলে ধরছি।
‘‘কী অঘটন ঘটেছিল সিয়েরা লিয়নে? এই প্রশ্ন মনে আসা স্বাভাবিক। সংক্ষেপে এটুকুই কেবল বলা যায় যে, শুধুমাত্র একজন শাসকের জেদ ও খামখেয়ালিপনার জন্য কৃষি ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর ও সম্ভাবনাময় এই দেশটি নিক্ষিপ্ত হয়েছিল ‘গণতন্ত্রের স্বপ্ন’ থেকে ‘স্বৈরশাসনের আঁস্তাকুড়ে’ আর নিপতিত হয়েছিল ধ্বংসের রাহুগ্রাসে। সে এক করুণ ইতিহাস!” এরপর যে ইতিহাসের বর্ণনা, তার অনেক কিছুই আমাদের অতীত-বর্তমানের সাথে হুবহু মিলে যায়! “--- নির্বাচনের মাধ্যমে বিরোধী দল ক্ষমতায় আসে এবং ১৯৬৭ সালের ২ মার্চ সাইকা স্টিভেন্স প্রধানমন্ত্রী হন। নিজের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তিনি সিয়েরা লিয়নকে প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করেন এবং নিজে প্রথম প্রেসিডেন্ট হন। --- তিনি বামধারার রাজনীতিকে গ্রহণ করেছিলেন এবং --- একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন।--- দেশের অর্থনীতি ও সার্বিক অবস্থার আরো অবনতি হতে থাকে ক্রমাগতভাবে। এ অবস্থায় ১৯৯১ সালের ২৩ মার্চ রেভল্যুশনারি ইউনাইটেড ফ্রন্ট (আরইউএফ) গৃহযুদ্ধের সূচনা করে।” এর পরের ইতিহাস কেবলই ক্যু-কাউন্টার ক্যু এবং প্রতিশোধপূর্ণ হত্যা-প্রতিহত্যার মাধমে মেধাহীন ধ্বংসযজ্ঞ ও রক্তের হোলিখেলার ইতিহাস!
সাইকা স্টিভেন্স কারো কথাই শুনতে চাননি। যে গণমানুষের ভোটে তিনি ক্ষমতায় এলেন তাদের কাছ থেকেই ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’ কেড়ে নিলেন। তিনি মনে করলেন, তিনিই একমাত্র দেশপ্রেমিক এবং তার একারই দায়িত্ব দেশকে রক্ষা করা! তিনি শুনতেই চাইলেন না যে, দেশের মানুষের একটি বিশাল অংশ তাকে এবং তার কর্মকাণ্ডকে পছন্দ করছে না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে তিনি ব্যক্তিগত আক্রোশ ও প্রতিহিংসার শিকারে পরিণত করলেন। তাদের শায়েস্তা করার জন্য তিনি জেল-জুলুম, পেটোয়া বাহিনী এবং হত্যার পথ বেছে নিলেন। গণতন্ত্রকে মেনে নিয়ে ‘চেয়ার’ ছাড়তে তিনি রাজি হলেন না। দেশকে তো তিনি রক্ষা করতে পারলেনই না, বরং ’৭১ থেকে ’৯১ দীর্ঘ সময় ধরে অরাজকতা বিরাজ করার পর দেশে শুরু হলো গৃহযুদ্ধ! গৃহযুদ্ধ তো এমন জিনিস যে পুরো দেশ ছারখার না হওয়া পর্যন্ত সে কখনো নিবৃত্ত হয় না!
বাংলাদেশের ওপরও কি সাইকা স্টিভেন্সের ভূত সওয়ার হয়েছে? এ কথার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য আমরাও কি বিশ বছর অপেক্ষা করব? আমাদের অশিক্ষিত গ্রাম্য লোকেরাও ভূতের কথা শুনলে ওঝা ডাকতে ছোটে। শুনেছি কোথাও কোথাও, রোগীকে ঝাঁটাপেটা করে ভূত ছাড়ায়! এখন আমরা শিক্ষিত লোকেরা কী করব? গালিগালাজ, হুঙ্কার, প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা ও হত্যা ছাড়া কি আর কোনো পথ নেই? যারা রাজনীতি-সম্পৃক্ত তারা ছাড়াও যারা কথায় কথায় ‘গৃহযুদ্ধ’ শব্দটি বলেন বা লেখেন তাদের সবারই প্রয়োজন ‘দ্য চাইল্ড সোলজার’-এর মেসেজটুকু আত্মস্থ করা। আশা করা যায় আমরা যুদ্ধংদেহি মনোভাব থেকে বেরিয়ে গণতান্ত্রিকতায় নিবিষ্ট হবো।
বইটি কেন পড়বেন?
বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে লন্ডনের বিখ্যাত ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ পত্রিকা সম্প্রতি মন্তব্য করেছে : ‘খাদের কিনারে বাংলাদেশ!’ এই কথাটা আমরা কতজন কতটুকু বুঝি? এই ‘খাদ’ সম্পর্কে কি আমাদের কোনো ধারণা আছে? এই খাদ কতটা গভীর, ভয়ঙ্কর আর কতটা না-ফেরার দেশ, তা আমাদের সবারই ভালোভাবে জানা দরকার, বিশেষত বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে। গৃহযুদ্ধটা যে কোনোভাবেই ঠাট্টা মশকরার বিষয় নয়, এ কথা আমাদের গলাবাজ জননেতাদের ভালোভাবে জানা প্রয়োজন। কাউকে ছোট করার জন্য এ কথা বলছি না। আসলে কার কতটুকু অভিজ্ঞতা আছে গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে? রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতি তথা পুরো জীবনটা তছনছ করে দেয় একটি গৃহযুদ্ধ! ২০০১ সালে সদ্যসমাপ্ত গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী সিয়েরা লিয়নকে সরেজমিন দেখে আমার মনে হয়েছে, তাদের ক্ষয়ক্ষতি ও যন্ত্রণা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সুদীর্ঘ নয় মাসের নরকযন্ত্রণার তুলনায় শত গুণ বেশি। সেই অবর্ণনীয় পরিস্থিতির খানিকটা আঁচ হৃদয়ে ধারণ করার জন্য দ্য চাইল্ড সোলজার পড়ে দেখা প্রয়োজন বলে আমার মনে হয়েছে।
অনেক ভালো ভালো শাসক সিয়েরা লিয়ন পেয়েছে। ১৯৬১ সালের ২৭ এপ্রিল সিয়েরা লিয়ন ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। প্রথম বহুদলীয় সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হন স্বাধীনতার স্থপতি ও দেশপ্রেমিক নেতা স্যার ড. মিলটন এ এস মরগাই। তিনি ছিলেন উদার ও জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ। কিন্তু পরবর্তীকালে একজন মাত্র শাসকের স্বেচ্ছাচারিতা ও একগুঁয়েমির ফলে সে দেশের গণতন্ত্র মুখথুবড়ে পড়ে। সাইকা স্টিভেন্স উন্নয়নের নামে বা বাহানায় যা কিছু করেছেন তাতে গণতন্ত্র ছত্রখান হয়ে গেছে, জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হয়েছে এবং নিতান্তই রাজনৈতিক বিরোধ গোত্রীয় প্রতিহিংসার রূপ পরিগ্রহ করেছে। ধ্বংসের জন্য যা কিছু বাকি ছিল তা পূর্ণ করা হলো দশকব্যাপী গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে। এ ধরনের গল্পের শুরুটা শুনে মনে হতে পারে আমরা বাংলাদেশের কাহিনীই বর্ণনা করছি। তারপরও কি আমাদের অপেক্ষা করতে হবে ‘দেখি না, কী হয়’ বলে! ‘অসম্পূর্ণ মূক্তিযুদ্ধ’, ‘চেতনা রক্ষার যুদ্ধ’ বা ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ প্রভৃতি অস্থির রাজনীতির স্লোগান দিয়ে আমাদের কি প্রবেশ করতেই হবে গৃহযুদ্ধের সর্বগ্রাসী আবর্তে দেশ ও জাতির শেষ ধ্বংসটুকু সম্পন্ন করার জন্য? এখনো আমরা আশায় বুক বাঁধি! গণতন্ত্রের পথের ওপর আজদাহা সাপের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে আমাদের শাসকেরা তো পারেন সরে দাঁড়াতে; দেশটা যেন বিপথে পা না বাড়ায়! নিজ দলের সুবিধামতো ও পছন্দমতো সংবিধান কাটাছেঁড়া করে সংশোধন করে গণতন্ত্রের স্বাভাবিক বিকাশকে বিঘ্নিত করার মধ্যে কেবল ধ্বংসের অশনি সঙ্কেতই বিরাজ করে; এ ছাড়া অন্য কোনো কল্যাণ নেই- এই শিক্ষা আমরা সিয়েরা লিয়নের ইতিহাস থেকে নিতে পারি। সিয়েরা লিয়নের দুর্ভাগ্যের ইতিহাস আমাদের জন্য শিক্ষা নেয়ার সৌভাগ্য বয়ে আনতে পারে বৈকি!
এবার বইটি সম্পর্কে বলি
জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর একটি কন্টিনজেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে আমি সিয়েরা লিয়ন যাই ২০০১ সালের ২৬ মার্চ। সেখানেই আমার হাতে আসে আইভান মেলভিন রজার্স নামের একজন শিশু সৈনিকের ইংরেজিতে লিখিত আত্মকথনের পাণ্ডুলিপি। আমি তা বাংলায় অনুবাদ ও সম্পাদনা করি সে দেশে অবস্থানকালেই। প্রকাশের আগে বইটির শুরুতে ভূমিকা হিসেবে ‘গ্রন্থের পেছনের গল্প’ এবং শেষে পরিশিষ্ট হিসেবে ‘শিশু সৈনিক’ ও ‘শিশু শ্রম’-এর ওপর দুখানি গবেষণামুলক প্রবন্ধ সংযুক্ত করে দিই। বইটিতে শিশু সৈনিকদের ও তাদের নিষ্ঠুরতার কিছু ছবি ছাপা হয়েছে। বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশক : অ্যাডর্ন পাবলিকেশন।
সিয়েরা লিয়নের আইভান মেলভিন রজার্স মাত্র দশ বছর বয়সে জড়িয়ে পড়েছিল গৃহযুদ্ধের আবর্তে। চাইল্ড সোলজার হিসেবে। সশস্ত্র যুদ্ধের সব ধরনের অমানবিকতা ও নৃশংসতার অভিজ্ঞতা অর্জন করে সে। অবশেষে বিশ বছর বয়সে যুদ্ধাহত হয়ে সে ছিটকে পড়ে জীবনের সব স্বস্তি থেকে। এই আত্মকথন এতটাই বিচিত্র যে, এই সময়কালের ভেতর তিনটি পৃথক দেশের (সিয়েরা লিয়ন, লাইবেরিয়া ও গিনি) সেনানিবাসে কাজ করার অভিজ্ঞতা তার হয়েছে। তার স্থান হয়েছে মেহমান হয়ে প্রেসিডেন্ট ভবনে এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে কারাগারেও! সব কিছু ছাপিয়ে উঠেছে গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতার বর্ণনা।
ইতিহাস থেকেই তো আমরা শিক্ষা নিতে পারি!
মিরপুর, ঢাকা, ০৮-০২-২০১৫

No comments

Powered by Blogger.