একদিন নয় বিষাদ ভুলিয়া by জয়া ফারহানা

ভালোবাসা নিয়ে যত বেশি শব্দের চর্চা হয়েছে অন্য আর কোনো বিষয় নিয়ে প্রকাশিত শব্দের চর্চা তার কাছাকাছিও যেতে পারেনি। এত চর্চা, এত গবেষণা এবং বিস্তর বিশ্লেষণের পরও শেষ পর্যন্ত কিন্তু ভালোবাসা অধরাই রয়ে গেছে অক্ষরবিদদের হাতে। এমনকি জোড়াসাঁকোর সেই বৃদ্ধ কবিও পাননি উত্তর। দ্বিধান্বিত কবিকেও অতএব বলতে হয়েছে 'ভালোবাসা কারে কয়' এবং সেই সঙ্গে একদিন জীবনের সব বিষাদ ভুলে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য সবাইকে এক রকম উস্কানিও দিয়েছেন তিনি (একদিন নয় বিষাদ ভুলিয়া, সকলে মিলিয়া গাহিব মোরা, ভাবনা কাহারে বলে... ভালোবাসা কারে কয়)। তো একদিন সব কাজ ও বিষাদ ভুলে সবাই মিলে যদি আমরা ভালোবাসা কী তা খুঁজতে যাই তাতে বরং পুনরায় অধিকতর বিষাদে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কিন্তু ঢের বেশি। কারণ ফ্রয়েডের তত্ত্ব। বিখ্যাত সেই তত্ত্বটি পিটুইটারি গ্রন্থির খেলা সম্পর্কিত। ফ্রয়েডের তত্ত্বটি এমন যে ভালোবাসা বলে আসলে কিছু নেই, যা আছে তা কেবল পিটুইটারি গ্রন্থির খেলা। ভালোবাসা সংক্রান্ত ব্যাপারে ফ্রয়েডের এই মন খারাপ করে দেওয়া তত্ত্ব প্রাণ দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। প্রায় একক প্রচেষ্টায় এবং সাত্তি্বক একনিষ্ঠতায় প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন প্লেটোনিক প্রেম। কখনও কাতর কণ্ঠে বলেছেন, ভালোবেসে কেবল নিভৃত যতনে প্রেমিকার মনের মন্দিরে তার নামটি লেখা থাকলেই চলবে আর কিছু চান না। কখনও সারা পথের ক্লান্তি ঘোচাতে শুধু প্রেমিকার মুখের বাণীর সঙ্গে একটুখানি নির্দোষ পরশ চেয়েছেন (শুধু তোমার বাণী নয় হে বন্ধু হে প্রিয়...)। বিপরীত পক্ষের জন্যও ছিল তার সমান আড়াল-আবডাল। নিজের মনে প্রেমিকাকে রাখতে চেয়েছেন নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমার নিশীথিনী-সম নীরবে। তবে গীতবিতানের কাল পার হয়ে সময় এখন যেকালে এসে পেঁৗছেছে তাতে প্রেমিকের আবেগ প্রকাশিত হয় '... আরও বেশি কাঁদালে উড়াল দেবো আকাশে' জাতীয় ভাবনায়। অর্থাৎ কি-না রজকিনী-প্রেম নিকষিত হেমকালের মতো প্রেমিকার জন্য ১২ বছর জলে ছিপ ফেলে যন্ত্রণার্ত অপেক্ষার কষ্ট করতে রাজি নয় কেউ আর। ডিজুস প্রজন্ম সুখের লাগি প্রেম চায়, প্রেম না মিললে আবার তারা খানিক বাদে নিদ্বর্িধায় আকাশে উড়ালও দেয়।
ভালোবাসার ঈর্ষা সন্দেহ স্বাস্থ্যকর অনুষঙ্গ কিন্তু কী এক বিচিত্র কারণে ভালোবাসা সংক্রান্ত মিথগুলোতে ঈর্ষা, সন্দেহ, অভিনয় ইত্যাদি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। শিরি-ফরহাদ, লাইলি-মজনু, রোমিও-জুলিয়েট, চণ্ডীদাস-রজকিনী ইত্যাদি সব ভালোবাসা সংক্রান্ত মিথে ভালোবাসার এই অনিবার্য অনুষঙ্গ অদ্ভুতভাবে অদৃশ্য।
পাকিজা চলচ্চিত্রে মীনা কুমারীর পায়ের প্রেমে নিমগ্ন অশোক কুমার তার পায়ের কাছে চিরকুটে লিখে রেখেছিলেন, যে পা এত সুন্দর, তা যেন মাটিতে না পড়ে। ছবিতে অশোক কুমারের বিয়ের অনুষ্ঠানে স্বেচ্ছায় পায়ের নিচে বোতল রেখে নেচে ভাঙা কাচের টুকরোয় অশোক কুমারের সেই প্রিয় পা রক্তাক্ত করে তোলেন মীনা। এ রক্তাক্ত পায়ের অনুবাদ হলো, যে পা এতদিন তোমার ছিল এখন তা শুধুই আমার। অতএব একে নিয়ে আমি যা খুশি তা করতে পারি। ভালোবাসায় এই জাতীয় ইগোর ইচ্ছাপূরণের নজির আছে ভূরি ভূরি। অদ্ভুত যে ভালো না বেসেও ইগো চরিতার্থ করার নজির কম নয়। যেমন এ মুহূর্তে আমাদের রাজনীতিকরা করছেন। জনগণকে ভালো না বেসেও তারা তাদের ইগো চরিতার্থ করে যাচ্ছেন। ইগোর বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না কেউ-ই। তবে সন্দেহ নেই, তারা আমাদের ভালো না বাসলেও আমরা তাদের ভালোবাসি খুব। দশকের পর দশক ধরে পালাক্রমে আমরা তাদের ভালোবেসে ভোট দিয়ে যাচ্ছি। দুই পক্ষের কাছ থেকেই যারপরনাই হেনস্তা হওয়ার পরও ভালোবাসার এই যে একনিষ্ঠতা প্রদর্শন বিশ্বে এ ধরনের নজির আর দ্বিতীয়টি নেই।
নির্বাহী পরিচালক, কিংবদন্তি মিডিয়া

No comments

Powered by Blogger.