আগাগোড়া সব সমান by শামীমুল হক

নিরাশার চোরাবালিতে ডুবছে মানুষের আশা। ভরসার জায়গা হারিয়ে যাচ্ছে গভীর সমুদ্রে। চাঁদ-সুরুজ দু’ভাই দূর দেশে বসে দেখছে তামাশা। নিত্যনতুন কৌশলে ফায়দা লুটার ব্যর্থ চেষ্টা দেখে ভেংচি কাটছে পাখিরা। আর জীবজন্তুরা বনে বসে ধ্যান করছে, প্রার্থনা করছে সুমতি দেয়ার। তবুও কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। মানুষ তো এখন বিভক্ত। দুই ভাগে লম্ফঝম্ফ করছে তারা। মুখে ফেনা তুলছে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে। এ দু’ভাগ প্রত্যেকেই নিজের কথাকে সত্য বলে দাবি করছে। আর অন্যরা যা বলছে সব মিথ্যা প্রমাণে ব্যস্ত। আসলে কে কি বলছেন নিজেই হয়তো তা জানেন না। বুদ্ধির খেলা খেলতে গিয়ে কখনও কখনও মানুষ হাসির পাত্রে পরিণত হয়। অথচ মানুষ চিন্তা করেন না সবকিছুর যেমন শুরু আছে, তেমন শেষও আছে। পৃথিবীর সৃষ্টি যেমন আছে, এর ধ্বংসও আছে। মানুষের জন্মতে যে সৃষ্টি, মৃত্যুতে তার শেষ। আবিষ্কারের নেশায় যে বিজ্ঞানী দিন-রাত কঠোর শ্রম দিয়েছেন, আবিষ্কারের মাধ্যমে সে বিজ্ঞানী নিজের নেশার ধ্বংস করেছেন। এ ধ্বংসের মাধ্যমেই মানুষ সভ্য জগৎ পেয়েছে। আধুনিক যুগ পেয়েছে। প্রযুক্তির মাধ্যমে পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় এনেছে। এত উন্নতি যাদের, তাদের আবার পেছন ফিরে তাকাতে হয় কেন? আদিম যুগে মানুষ যেভাবে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে জীবনকে এগিয়ে নিয়েছে, প্রযুক্তির যুগে কি সেভাবে এগিয়ে নিতে পারছে? যদি উত্তর- না হয়, তাহলে কেন? কি কারণে? এর জন্য দায়ী কে? রাজা- বাদশাহ, উজির-নাজিরের যেসব গল্প এখনও গ্রামবাংলার মানুষের মুখে মুখে, সেসব কাহিনী কি বর্তমান সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে পারছে? নাকি পাগলা রাজার চরিত্রকে ধারণ করে এগিয়ে যেতে চাইছে। দুটি পন্থারই ভাল-মন্দ দিক রয়েছে। বিশ্বে এমন হাজারো উদাহরণ রয়েছে। অনেক রাজা নিজের কারণে বেকায়দায় পড়েছেন। ক্ষমতায় থাকাকালে কারও কোন মতামতের তোয়াক্কা করেননি। নিজে যা ভাল মনে করেছেন তা-ই করেছেন। সর্বশেষ শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকশে সংবিধান সংশোধন করে তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন (আগে যেখানে দুবারের বেশি কেউ প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না বলে সংবিধানে উল্লেখ ছিল)। কিন্তু জনগণ তার এ অসৎ উদ্দেশ্য ভালভাবে মেনে নেয়নি। যার ফল আমরা নির্বাচনে দেখলাম। জোর করে কোন কিছুই হয় না। জোর করে যেমন ভালবাসা আদায় করা যায় না, তেমনি জোর করে কারও কথা বলাকে থামিয়ে দেয়া যায় না। অথচ যেটা যুগে যুগে হয়ে আসছে। পরিণতি ভয়াবহ জেনেও এ পথে হেঁটেছেন ক্ষমতাসীনরা। এখন হাট-বাজারে, মাঠে-ময়দানে, আড্ডায়-গল্পে একটিই প্রশ্ন- কি হচ্ছে? কোন দিকে যাচ্ছে পরিস্থিতি? হরতাল, অবরোধ থেকে কবে মুক্তি পাচ্ছে দেশ? সমঝোতা হতে আর কত দিন? কেউ কেউ বলছেন, সমঝোতা হতেই হবে। সংলাপে দুই দলকে বসতেই হবে। কারণ এভাবে দেশ চলতে পারে না। এসএসসি পরীক্ষার্থীরা রয়েছে চরম দুশ্চিন্তায়। পরীক্ষা সময়মতো যে শেষ হবে না এটা পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকরা জেনে গেছেন। তাই দুশ্চিন্তার রেখাটা একটু বেশি। কেউ কেউ রশিকতা করে বলছেন, এত দুশ্চিন্তার দরকার কি? সব পরীক্ষার্থীকে মালয়েশিয়ায় নিয়ে গিয়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা করলেই হয়। পরীক্ষাও সময়মতো হবে। সরকারও ক্রেডিট নিতে পারবে। আসলে অনেকে অনেক কথাই বলতে পারে। বাস্তবতা বড়ই কঠিন। বাস্তবতা বড় নির্মম। এ বাস্তবতাকে পুঁজি করে রাজনীতি না করে নিজ স্বার্থকে সঙ্গী করে এগিয়ে যাচ্ছে পার্টিগুলো। আর দেশের নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাসীনদের মন জয়ে ব্যস্ত। তারা সব সময় সরকার কি করলে খুশি হবে তা সহজেই বুঝে যায়। কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের নির্বাচন কমিশন বড় বোকা। তারা এটা বুঝে না। আর বুঝে না বলে মোদির দলকে আসন না দিয়ে, ওরা দেয় কেজরিওয়ালকে। পার্থক্যটা এখানেই। অন্যদিকে আমরা ভাষণ দিই। যার মধ্যে কোন রসকষ থাকে না। থাকে না মধু। ক্ষ্যাপা বামুনের মতো শুধু বলেই যায়। যে বলাতে শিক্ষা নেয়ার কিছু থাকে না। কেউ শিক্ষা নিতেও পারে না। ফলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। আগাগোড়া সব সমান। আগা থেকে যে কথার শুরু তা শেষ হয় গোড়ায় গিয়ে। এর হেরফের হয় না। সবাই চেঁচায় একদিকেই। এ প্রথা থেকে রাজনীতিকদের ফিরে আসা উচিত। আর ফিরে এলেই সুন্দর রাজনীতি দেশে আসবে। মানুষ নিরাশার চোরাবালিতে আর ডুবতে চায় না। তারা আশারবাণীও শুনতে চান না। তারা চান সত্য ও সুন্দরকে আগলে ধরে এগিয়ে যেতে। দীর্ঘ তেতাল্লিশ বছরেও যেটা হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.