সন্দেহ হলেই পুলিশের গুলি- রক্ষকেরাই এখন আইনের ভক্ষক!

বেশ কিছুদিন ধরে আমাদের দেশে বিভিন্ন স্থানে পুলিশ কর্তৃক সন্দেহ বা ক্ষোভবশত অনেককে গুলি চালিয়ে আহত করার খবর পত্রপত্রিকায় উঠেছে। পুলিশের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় নিহতের সংখ্যাও কম নয়। সর্বশেষ, শনিবার রাতে সীতাকুণ্ডে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েতে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হতাহতের খবর এসেছে। ইদানীং রাজধানীতে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ এবং সন্দেহবশত পুলিশের গুলি করার ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। নজিরবিহীন এ পরিস্থিতিতে জনমনে ছড়িয়ে পড়েছে উদ্বেগ-আতঙ্ক।  গতকাল রোববার নয়া দিগন্তের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, রাজধানীতে পুলিশ সন্দেহবশত গুলি করছে। নিরপরাধ ব্যক্তিরাও রেহাই পাচ্ছেন না। এতে বলা হয়, রাজধানীতে এবার যারা পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন, তাদের প্রত্যেকের দাবি- পুলিশ অকারণে তাদের ধরে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করেছে। এ ব্যাপারে তাদের হাতে পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকার কথাও জানানো হয়েছে। এদের কেউ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন রাস্তায়। আবার কারো অভিযোগ, পুলিশ ধরে নিয়ে গুলি করেছে। অপর দিকে পুলিশের দৃষ্টিতে এরা ‘নাশকতাকারী’। তারা পুলিশের ওপর হামলা, অগ্নিসংযোগ, বোমা নিক্ষেপ, যানবাহন ভাঙচুর ইত্যাদি করার সময় তাদের গুলি করা হয়েছে। আলোচ্য রিপোর্টে বৃহস্পতিবার রাতে যাত্রাবাড়ী এলাকার একটি ঘটনার উল্লেখ করে জানানো হয়, আতাউর নামের এক যুবক গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। পুলিশ বলেছে, বাসে বোমা ছোড়ার চেষ্টা করায় গুলি করা হয়। কিন্তু আতাউর ও আত্মীয়স্বজনের বক্তব্য, তারা রাজনীতিতে জড়িত নয় এবং কারো সাথে বিবাদও নেই। আতাউর নারায়ণগঞ্জ থেকে ফেরার পথে দোলাইরপাড় থেকে কয়েক যুবক তাকে মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। সাথে সাথে পুলিশ তাকে গুলি করে এবং পুলিশই হাসপাতালে নিয়ে যায়। শনিবার বিকেলে ৯০ নম্বর ওয়ার্ডে যুবদলের জনৈক নেতাকে ধরতে না পেরে তার স্কুলপড়–য়া ভাইকে গুলি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে তাকে পুলিশ বেদম প্রহারের পর হাসপাতালে নিয়ে গেছে। এ ধরনের আরো কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ আছে প্রতিবেদনটিতে।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখন কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তার প্রমাণ পুলিশ। দুর্বৃত্ত বা অপরাধীরা এসব ঘটনার দৃষ্টিতে ‘সন্দেহভাজন’ মনে হলে কাউকে গুলি করে কিংবা অন্যভাবে আহত ও নির্যাতন করা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু পুলিশ বা অন্য কোনো বাহিনী এ ধরনের অন্যায় করা শুধু বিস্ময়কর নয়, বিপজ্জনকও। কারণ, আইনের রক্ষক যখন এর ভক্ষক হয়ে দাঁড়ায়, তখন অনিবার্যভাবেই বিপন্ন হয় আইনের শাসন। গণতন্ত্রের একটি বড় বৈশিষ্ট্য আইনের শাসন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোনো সংস্থার লোকজন ক্ষমতার অপব্যবহার করলে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার বিপর্যস্ত এবং সুশাসন ুণœ হয়। সুশাসনের অভাবকে ক্ষমতাসীন নেতৃবৃন্দের সুবচন, এমনকি কথিত উন্নয়নের হিড়িক দিয়ে পূরণ করা অসম্ভব। পুলিশ, র‌্যাব এবং এজাতীয় অন্যান্য বাহিনীর কাজ ভীতির সঞ্চার নয়, বরং জনগণের মনে নিরাপত্তা ও স্বস্তির অনুভূতি সৃষ্টি করাই তাদের দায়িত্ব। আমাদের দেশে নিছক সন্দেহবশত পুলিশ কর্তৃক ব্যাপক আটক ও গ্রেফতারের ঘটনা ঘটছে অনেক আগ থেকে। সাধারণত বিরোধীদলীয় লোকজনই এভাবে সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে থাকেন। আর এখন শুরু হয়েছে সন্দেহভাজন হলে গুলি করার মতো অবিশ্বাস্য ব্যাপার। পুলিশ-র‌্যাবের সন্দেহ হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আটক করে যথাসময়ে আদালতে সোপর্দ করাই তাদের কর্তব্য। কেউ দণ্ডনীয় অপরাধ করলে সভ্য জগতে তাকে বিচারের মাধ্যমেই শুধু শাস্তি দেয়া বৈধ। এটা আদালতের কাজ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নয়। কেউ আদালতে অপরাধী হিসেবে প্রমাণিত হওয়ার আগে সে দোষী হিসেবে গণ্য নয়। আর নিরপরাধ ব্যক্তির সাথে তো অসদাচরণ করাই অন্যায়। কর্তৃপক্ষ যেন ভুলে না যায়, আইন মেনেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমরা আশা করব, নিছক সন্দেহবশত পুলিশ গুলি করার অভিযোগগুলোর বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত হবে অবিলম্বে এবং সে মোতাবেক আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে দোষীদের বিরুদ্ধে; অন্যথায় আগামী দিনে আরো বড় অঘটন ঘটে যাওয়া বিচিত্র নয়।

No comments

Powered by Blogger.