সংলাপ না হওয়ার পরিণতি ভয়াবহ

৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনসূত্রে ক্ষমতায় আসা সরকার ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার অনড় অবস্থান নেয়ার ফলে দেশে এক চরম রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। যদিও ক্ষমতাসীন সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে ওই নির্বাচনের সময় বলা হয়েছিল, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নির্বাচন। এ নির্বাচনের পর সব দলের অংশগ্রহণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য দ্রুত একটি নির্বাচনের আয়োজন করা হবে। নির্বাচনের পর সরকারি দল-জোট এ প্রতিশ্রুতির অবস্থান থেকে সরে যাওয়ায় কার্যত চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সূচনা হয়। আমরা জানি, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দেশে দুই-তৃতীয়াংশ রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি। নির্বাচনে অংশ নেয়া দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি ছাড়া বাকিগুলো নামসর্বস্ব দল। তা ছাড়া জাতীয় পার্টিকে কী উপায়ে কী অপকৌশলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানো হয়েছে, তা-ও এ দেশের সবার জানা। এ নির্বাচনে কার্যত জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়নি। ফলে জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪টিতেই সরকারি জোটের সমর্থক দলের প্রার্থীরা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পান। বাংলাদেশে তো বটেই, এমনকি বিশ্বের অন্য কোনো দেশে এমন নজির নেই, মোট আসনের ৫০ শতাংশ আসনেই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়ার। এর অর্থ নির্বাচনের আগেই ফয়সালা হওয়া, কোন দল ক্ষমতায় আসছে। ফলে বাংলাদেশের ইতিহাসে এ নির্বাচন একটি বড় মাপের বিতর্কিত নির্বাচনই থেকে গেল। একমাত্র ভারত ছাড়া কার্যত আর একটি দেশও এ নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করেনি। বিশ্বের প্রায় সব দেশ এ নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য ও অগণতান্ত্রিক আখ্যায়িত করে দ্রুত সব দলের অংশগ্রহণে আরেকটি নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে আসছে। আর সে জন্য দ্রুত সরকারপক্ষ ও বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষের মধ্যে সংলাপে আসার তাগিদ দিয়ে আসছে। কিন্তু সরকারপক্ষের এক কথাÑ ২০১৯ সালের আগে কোনো নির্বাচন নয়, কোনো সংলাপও নয়।
সরকারবিরোধী ২০ দলীয় জোট ২০১৪ সালজুড়ে বারবার বলে আসছে, দ্রুত একটি দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন আয়োজন করতে। নইলে আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো বিকল্প থাকবে না। সরকারের বাইরে থাকা ২০ দলীয় জোট ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের তাগিদও কার্যত তাই। এমনই প্রেক্ষাপটে গত ৫ জানুয়ারি ২০ দলীয় জোটকে ঢাকায় সমাবেশ করতে না দেয়ায় অব্যাহত অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে, থেকে থেকে হরতাল কর্মসূচি পালন করছে। এবং সংলাপ-সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত এ কর্মসূচি অব্যাহত রাখার কথা বলছে। এ সময় দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সুশীল নাগরিক সমাজসহ বিভিন্ন মহল সংলাপ-সমঝোতায় বসার তাগিদ দিয়ে আসছে। কিন্তু সরকারপক্ষ বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষের সাথে ‘কোনো সংলাপ নয়’ ধরনের অবস্থানেই অনড়। এ দিকে সরকারবিরোধী অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে যানবাহনে পেট্রলবোমায় পুড়ে মরছে সাধারণ মানুষ। একইভাবে ক্রসফায়ারে মারা যাচ্ছে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। পেট্টলবোমায় মানুষ মারার বিষয়ে সরকারপক্ষ ও সরকারবিরোধীপক্ষ পরস্পরকে দায়ী করছে। জনগণ এ ব্যাপারে অন্ধকারে। একই সাথে দেশের ব্যবসাবাণিজ্য ও অর্থনীতি প্রায় অচল। সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীন। এ অবস্থা অবসানে গোটা জাতি ও দেশের বাইরের বিভিন্ন মহল যখন সংলাপের ব্যাপারে সোচ্চার, তখনো সংলাপের ব্যাপারে সরকারের প্রবল অনীহা। এ দিকে দেশে চলমান সঙ্কটকে রাজনৈতিক উল্লেখ করে সমাধানে সংলাপের তাগিদ দিয়ে বিশেষ্টজনেরা বলছেন, সংলাপ না হলে দেশে চরমপন্থার উত্থান ঘটতে পারে। তাই সংলাপের জন্য সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে বলে। আমরাও মনে করি চলমান সঙ্কট একটি বিশুদ্ধ রাজনৈতিক সঙ্কট। রাজনৈতিক সংলাপ-সমঝোতাই এর একমাত্র শান্তিপূর্ণ পথ। অতএব সংলাপ হওয়াটাই কাম্য। কারণ, সংলাপেই সব মহলের মঙ্গল, সংলাপ না হওয়াটা কারো জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না।

No comments

Powered by Blogger.