এশিয়ায় ধর্ষণের ব্যাপকতা by নাজমুল হোসেন

ভারতের রাজধানীর ১১টি থানায় ২০১৩ সালের আট মাসে দুই হাজার ৮০০ শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে, যা ২০১২ বছরের ওই সময়ের তুলনায় ছয় গুণ বেশি! ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে এক হাজারের বেশি, যা আগের বছরের ওই সময়ের তুলনায় প্রায় আড়াই গুণ বেশি। সেই সাথে দিল্লি পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, শ্লীলতাহানির ঘটনার ৯০ শতাংশই পরিচিতদের কাজ। আবার ন্যাশনাল ক্রাইম রিপোর্ট ব্যুরোর (এনসিআরবি) তথ্য অনুযায়ী ২০১২ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ৪৬৮টি মামলা হয়েছিল। এ ছাড়া ২০১১ সালে ৫৭২টি এবং ২০১০ সালে ৫০৭টি মামলা হয়েছে।
ভারতের নয়াদিল্লিতে চলন্ত বাসে গণধর্ষণের ঘটনায় বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠে। দিল্লির ওই ঘটনা ভারতে নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আনে। ২০১২ সালে ১৬ ডিসেম্বর দিল্লিতে নির্মম গণধর্ষণের শিকার মেডিক্যাল ছাত্রীর মামলার রায় দিয়েছে সে দেশের আদালত। প্রত্যাশিতভাবেই দোষী চারজনকেই ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছে। ‘বিরলের মধ্যে বিরলতর’ ঘটনা উল্লেখ করে চারজনকেই চরমতম সাজা দেয়া হয়েছে। রায় ঘোষণার পরই আদালত কক্ষে উপস্থিত ধর্ষণের শিকার ওই ছাত্রীর পরিবারের সদস্যরা স্বস্তি প্রকাশ করেন। ওই ছাত্রীকে ধর্ষণের পর মারাত্মক অত্যাচার করে গুরুতর আহত অবস্থায় রাস্তায় রেখে যায় ধর্ষকেরা।
একই সাথে ওই ছাত্রীর সাথে থাকা ছেলেবন্ধুকেও মারধর করে চলন্ত বাস থেকে ফেলা দেয়া হয়। এ ঘটনার পর থেকে আদালতের রায় দেয়ার আগপর্যন্ত ভারতজুড়ে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঝড় বয়ে গিয়েছিল। চরমতম শাস্তির দাবিতে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে আদালত চত্বরে যুব-জনতা নিয়মিতভাবে ভিড় জমায়। দণ্ড ঘোষণার দিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রায় প্রকাশের পর বিচারপতি বলেন, পরিকল্পনা করে ঠাণ্ডামাথায় নৃশংসতার চূড়ান্ত পরিচয় দিয়ে এই অপরাধ ঘটানো হয়। তাই মৃত্যুদণ্ডই এর একমাত্র শাস্তি।
এই পরিস্থিতিতে চিন্তার বিষয় হলো এক দিকে দেশকাঁপানো একটি অপরাধের পর এবং তার সর্বোচ্চ শাস্তির পরও যদি এভাবে এই ঘটনা বেড়েই চলে তাহলে তা উদ্বেগজনক। ভারতের অভিভাবকেরা, বিশেষ করে মধ্যবিত্তরা তাদের কন্যাসন্তানদের এখন বাড়ির বাইরে পাঠাতে ভয় পান। এই পরিস্থিতি ভারতের মতো একটি দেশের জন্য উদ্বেগজনক।
দুর্ভাগ্যবশত এ বিষয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর অবস্থাও তেমন ভালো নয়। মেডিক্যাল জার্নাল ল্যানচেট গ্লোবাল হেলথের একটি নতুন গবেষণা জানাচ্ছে বিষয়টি। জরিপে অংশ নেয়া এশিয়ার ছয়টি দেশের প্রতি ১০ জনের একজন জানিয়েছেন, তারা তাদের স্ত্রী নয় এমন কাউকে ধর্ষণ করেছে। এ পরিসংখ্যান প্রতি চারজনে একজন দাঁড়ায়, যখন তাদের স্ত্রী ও মেয়েবন্ধুদের এ তালিকায় যোগ করা হয়। গবেষকেরা এ কাজে বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, চীন, ইন্দোনেশিয়া, পাপুয়া নিউগিনি ও শ্রীলঙ্কার ১০ হাজারেরও বেশি নাগরিকের মধ্যে জরিপ পরিচালনা করেন। জরিপে অংশ নেয়া নাগরিকদের বয়স ছিল ১৮-৪৯।
ধর্ষণ বিষয়ে সরাসরি কোনো প্রশ্ন করা হয়নি তাদের, বরং জানতে চাওয়া হয়েছিল, যৌনমিলনে তারা তাদের স্ত্রী বা মেয়েবন্ধুদের বাইরে অন্য কোনো নারীকে কখনো জোরজবরদস্তি করেছিল কি না। উত্তরগুলো বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ছিল ৪ শতাংশ আর পাপুয়া নিউগিনির ক্ষেত্রে তা ছিল ৪১ শতাংশ। এমনকি প্রতি সাতজন ধর্ষকের মধ্যে একজন প্রথম এ ঘটনাটি ঘটায়, যখন তার বয়স ১৫ বছরেরও কম ছিল। ২০ বছরের নিচেই অর্ধেক পুরুষ এ অপকর্মে যুক্ত হয়েছিল। মাত্র ৫৫ শতাংশের মধ্যে অনুতাপ কাজ করেছিল এবং এক-চতুর্থাংশের কম অভিযুক্ত হয়ে জেল খেটেছিল।
জাতিসঙ্ঘ প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে, এশিয়ায় বেশির ভাগ নারী ধর্ষণের পেছনে দায়ী থাকে তার বন্ধু বা প্রেমিক। এশিয়ার এক-চতুথাংশ পুরুষ বর্তমানে ধর্ষণে অংশগ্রহণ করেন। জরিপে দেখা গেছে প্রেমসংক্রান্ত বিষয়ে নারীরা বেশি ধর্ষণের স্বীকার হচ্ছে। আর এর বিপরীতে এশিয়ায় প্রতি ১০ পুরুষের মধ্যে একজন অপরিচিত নারীকে ধর্ষণ করছে। এই জরিপে ছয়টি দেশের প্রায় ১০ হাজার পুরুষ অংশগ্রহণ করেছে। অবাক করার বিষয় হলো, এই জরিপে দেখা গেছে যারা ধর্ষণ করছে তাদের অর্ধেকের কম স্বীকার করেছে তারা এ রকম কাজ একধিকবার করেছে। এই প্রতিবেদনে দেখা গেছে ধর্ষণের ব্যাপকতা একেক দেশে একেক রকম। পাপুয়া নিউগিনির ১০ জন পুরুষের মধ্যে ছয়জনেরও বেশি নারীদের সাথে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। এর পাশাপাশি কম্বোডিয়া, চীন ও ইন্দোনেশিয়ায় প্রতি পাঁচজনের একজন ধর্ষণের সাথে জড়িত।
ধর্ষণ প্রবণতায় জাতিসঙ্ঘের প্রতিবদন
পাপুয়া নিউগিনির বোগেনভিল উপদ্বীপ : ৬২%
ইন্দোনেশিয়ার শহরাঞ্চলে : ২৬%
ইন্দোনেশিয়ার গ্রামাঞ্চলে : ১৯.৫%
চীনের শহর ও গ্রামাঞ্চলে : ২২.২%
কম্বোডিয়ায় : ২০.৫%
শ্রীলঙ্কায় : ১৪.৫%
দিল্লির বাসে গণধর্ষণের মতো মারাত্মক ঘটনার পর এই জরিপের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল বলে জানান ড. ইম্মা ফুলু। তবে অবাক করার মতো বিষয় হলো এই জরিপে ভারতের কোনো প্রবণতা উল্লেখ করা হয়নি। ছয়টি দেশের ১০ হাজার মানুষের ওপর তার এই গবেষণা চালিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্যটি প্রকাশ করেন।
আফ্রিকান মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিল এশিয়ার যে ছয়টি দেশের ওপর অনুসন্ধান করেছে সেগুলো হলো, বাংলাদেশ, চীন, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও পাপুয়া নিউগিনি। ১০ হাজার মানুষের ওপর জরিপ চালিয়ে এ তথ্য জানায়। গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রতি ১০ জনে একজন পুরুষ সঙ্গিনী নন এমন মহিলাকে ধর্ষণ করেন। জরিপে আরো প্রকাশ করা হয় পুরুষই একাধিক ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়েছেন। যেখানে বাংলাদেশের ১১ শতাংশ পুরুষ ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছেন। সেখানে পাপুয়া নিউগিনিয়ার ধর্ষকের সংখ্যা ৬০ শতাংশ।
এশিয়ার ওপর এ জরিপ চালানো হলেও এখানে সবচেয়ে ধর্ষণকবলিত দেশ হিসেবে আলোচিত ভারতের নাম নেই। অথচ বিশ্বে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম রাষ্ট্র ভারত ধর্ষণের জন্য বেশ সমালোচিত। ভারতীয় ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর প্রতিবেদন অনুযায়ী এখানে প্রতি ২০ মিনিটে একজন নারী ধর্ষিত হয়।
শুধু তা-ই নয় সাম্প্রতিক সময়ে গণধর্ষণের ঘটনাও বেড়ে গেছে ভারতে। এমনকি বিদেশী পর্যটকেরাও বেড়াতে এসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর পরও জরিপে ভারতের নাম না থাকার বিষয়টি বিস্ময়কর।
এই জরিপে ১৮ থেকে ৪৯ বছর বয়সী মোট ১০ হাজার ১৭৮ জন পুরুষ অংশ নেয়। জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে এ অঞ্চলের দেশগুলোতে পরিচালিত এ ধরনের জরিপ এটিই প্রথম। ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত জরিপ চালানো হয়। জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঘনিষ্ঠ সঙ্গী ছিল এমন নারীকে পুরুষ দ্বারা ধর্ষিত হওয়ার ঘটনা এ অঞ্চলে শতকরা ২৪ ভাগ। বাংলাদেশে এ হার ১৩ ভাগ এবং পাপুয়া নিউগিনিতে ৫৯ ভাগ। জরিপে অংশ নেয়া চার ভাগের এক ভাগ পুরুষ স্বীকার করেছেন, তারা কমপক্ষে একজন নারীকে ধর্ষণ করেছেন। আর ধর্ষকদের মধ্যে অর্ধেক স্বীকার করেছেন, তারা একাধিকবার ধর্ষণ করেছেন। প্রশ্নপত্র পদ্ধতির মাধ্যমে এ জরিপ চালানো হয়। তবে প্রশ্নপত্রে ধর্ষণ শব্দটি গোপন রাখা হয়। জরিপে অংশ নেয়া পুরুষদের প্রশ্ন করা হয়, আপনার স্ত্রী অথবা সঙ্গী যৌনসম্পর্ক স্থাপনে রাজি হবে না জেনেও কি আপনি তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেছেন?
অন্য এক প্রশ্নে জানতে চাওয়া হয়, আপনি কি নেশাগ্রস্ত ও মদ্যপ অবস্থায় কোনো নারীর সঙ্গে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করেছেন। হয়তো স্বাভাবিক অবস্থায় তিনি রাজি হতেন না।
কারো অসম্মতিতে বা জোর করে যৌনকর্মে বাধ্য করাকে ধর্ষণের ভিত্তি ধরে জরিপটি পরিচালিত হয়। আশঙ্কার ব্যাপার হলো, ধর্ষণ করেছেন এমন ব্যক্তিদের অর্ধেকের বেশি জানিয়েছেন, তারা বয়ঃসন্ধিক্ষণে এবং ১২ শতাংশ ১৫ বছরের কম বয়সে ওই কাজ করেছেন। বেশির ভাগ পুরুষ বলেছেন, এ কাজের জন্য তাদের কোনো আইনি ব্যবস্থার সম্মুখীন হতে হয়নি।
সবচেয়ে বেশি ধর্ষক মিলেছে পাপুয়া নিউগিনিতে। এ দেশের বোগেনভিল এলাকার ৬২ শতাংশই ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছেন। হয়তো বহু বছরের গৃহযুদ্ধ ও দারিদ্র্যের কারণে দেশটির এ পরিস্থিতি। ১৯৯৮ সালে দেশটিতে যুদ্ধ শেষ হয়। তবে এখনো আইনি ব্যবস্থার চেয়ে সামাজিক সালিসব্যবস্থাকেই বেশি গুরুত্ব দেয় দেশবাসী।
জাতিসঙ্ঘের নারীবিষয়ক অধিদফতরের আঞ্চলিক পরিচালক রবার্ট ক্লার্ক থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে বলেন, ‘অনেক নারীর জন্যই সহিংসতা এক বীভৎস বাস্তবতা। যে সংস্কৃতি পুরুষকে নারীদের ওপর খবরদারি চালানোর সুযোগ করে দেয়, সে টিকে অবশ্যই বদলে দিতে হবে।’ জাতিসঙ্ঘ বলছে, ধর্ষণের প্রবণতা স্থানভেদে কমবেশি হয়। যেসব এলাকায় জরিপ পরিচালিত হয়েছে সেগুলো পুরো দেশের সম্পূর্ণ পরিস্থিতির প্রতিনিধিত্ব করে না।

No comments

Powered by Blogger.