প্রদীপগুলো জ্বলে উঠুক by ড. মুসতাক আহমেদ

উত্তর জনপদের জনগণের অনেক দিনের দাবি হিসেবে ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। এটি রংপুর বিভাগের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামে যাত্রা শুরু করে ২০০৯ সালে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের স্মরণে নাম পরিবর্তিত হয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। রংপুর বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষায় এ বিশ্ববিদ্যালয় অসামান্য অবদান রাখছে। বর্তমানে বিভিন্ন বিভাগে প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থী এখানে অধ্যয়ন করছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে চলতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়টি। বিগত প্রায় এক বছর বিভিন্ন সমস্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। পদোন্নতির দাবি জানিয়ে কয়েক মাস ধরেই আন্দোলনে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
দশ শিক্ষকের পদত্যাগের মাধ্যমে দুটি হলের প্রভোস্ট, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, দুটি অনুষদের ডিন এবং ১১টি বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের পদ শূন্য হয়। আবারও সংকট ঘনীভূত হয় রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। একদিকে সব প্রশাসনিক পদ থেকে শিক্ষকদের পদত্যাগ, অন্যদিকে উপাচার্য ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাওয়ায় সংকটে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষকদের আন্দোলন আর প্রশাসনিক পদ থেকে পদত্যাগের কারণে সৃষ্ট জটিলতায় রেজিস্ট্রারকে দায়িত্ব দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়েন উপাচার্য।
মাঝে চাকরি স্থায়ীকরণ ও বেতন-ভাতার দাবিতে দ্বিতীয় দিনের মতো রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করে রাখে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী। এসব ঘটনা আমাদের জানা। শুধু তাই নয়, বিগত বছরগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হল অন্তর্ভুক্তির নতুন হল ফি বাড়ানো হয়। অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার ফিও ৩৫-৫০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। ফি বাড়ানোর প্রতিবাদে আন্দোলন হয়েছে।
সত্যিই এটা একটা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা! রংপুর তথা উত্তরাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের আশা-আকাঙ্ক্ষা, দাবি ও আন্দোলনের ফসল একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের জন্য অনশন শুরু হয়েছে ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদোন্নতি হবে এটাই স্বাভাবিক। পদোন্নতি আমাদের চাকরিজীবীদের অধিকার। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বঞ্চিত হচ্ছেন এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।
আমরণ অনশন, একাডেমিক-প্রশাসনিক ভবনে তালা, আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ, উপাচার্যের পলায়ন এসব সুখকর ইঙ্গিত নয়। শিক্ষকদের পদোন্নতি সাধারণ রীতি। এতে করে প্রশাসনে শৃঙ্খলা থাকে। অথচ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পদোন্নতি না দিয়ে উপাচার্য মহোদয় যেন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছেন নিজ উদ্যোগে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অধিকার আদায়ের জন্য আমরণ অনশন করবেন, ভালো দেখায় না। অধিকার আদায়ের একটি অথরিটি হচ্ছে শিক্ষক সমিতি। বেগম রোকেয়াতে আজ স্বয়ং শিক্ষক সমিতি অধিকার আদায়ের জন্য যখন আন্দোলন করে যাচ্ছে, তখন চ্যান্সেলর, শিক্ষামন্ত্রীর নীরব থাকা যুক্তিযুক্ত হবে না।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর আইন ২০০৯ এটি পরিচালনার একটি শক্ত আইন। এটি ২০০৯ সালের ২৯ নম্বর আইন। এর ১১ (৮) ধারায় পরিষ্কারভাবে বলা আছে, 'ভাইস চ্যান্সেলর বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য দায়ী থাকবেন।' এই ধর্মের কাহিনী কে শোনে? আজ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো শৃঙ্খলা নেই, বিরাজ করছে অশান্তি। নেই একাডেমিক কর্মকাণ্ড। বলার প্রয়োজন নেই, আইন অনুযায়ী বিদ্যমান অবস্থার জন্য দায়ী কে!
উত্তরবঙ্গের মঙ্গাপীড়িত মানুষের উচ্চশিক্ষায় এগিয়ে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা বর্তমান সরকারের অঙ্গীকার ছিল। সরকার আমাদের স্বপ্নপূরণ করেছে। কিন্তু আমরা এতই হতভাগা যে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনো ভালো অভিভাবক পেলাম না। তাই বললে ইচ্ছা করে বেগম রোকেয়াতে প্রদীপ জ্বলুক, আসুক আলোকিত অভিভাবক।
সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাবি

No comments

Powered by Blogger.