কূটনীতিকরা সতর্ক- চাপ বাড়ছে by মিজানুর রহমান

৫ই জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন নিয়ে কূটনৈতিক অঙ্গনের হতাশা নতুন কিছু নয়। নির্বাচনের আগে থেকেই বিভিন্ন পর্বে এটির প্রকাশ ঘটিয়েছেন পেশাদার কূটনীতিকরা। তাদের হতাশার বিষয়টি আমলে নিয়ে ‘সমঝোতা হলে আরেকটি নির্বাচন হতে পারে’ মর্মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তরফে একটি ঘোষণা এসেছিল। একতরফাভাবে সরকারি দল নির্বাচনটি সম্পন্ন করলেও নির্বাচনের পরদিন থেকেই নতুন নির্বাচনের দাবি ওঠে। ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন ‘গ্রহণযোগ্য নয় মর্মে বার্তা আসে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন জোটসহ গোটা দুনিয়া থেকে। ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকারের প্রথম কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। দ্রুত নতুন নির্বাচনের তাগিদ দেন পশ্চিমা কূটনীতিকরা। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাটিও স্মরণ করা হয়। সমঝোতার জন্য সংলাপ শুরুর তাগিদ দেন কূটনীতিকরা। জবাবে সরকারের প্রতিনিধিরা নির্বাচনটিকে  ‘সাংবিধানিক ভাবে সঠিক’ বলে দাবি করেন। একই সঙ্গে বিএনপির নেত্বত্বাধীন জোটের আন্দোলন কর্মসূচি তুলে নেয়া এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসাকে নির্বাচনের ইতিবাচক ফল বলে উল্লেখ করেন। সে দিনের দেখানো ‘যুক্তি’ তুলে ধরে গেল এক বছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালিয়েছে সরকার। পূর্বে এ ‘দাওয়াই’ খানিকটা সফল হলেও পশ্চিমা বিশ্বে এটি মোটেও কার্যকর হয়নি বরং নতুন নির্বাচন ও রাজনৈতিক সমঝোতার তাগিদ দিনে দিনে আরও জোরালো হয়েছে। প্রশ্নবিদ্ধ ওই নির্বাচনের বছরপূর্তিতে আবারও সরগরম হয়ে উঠেছে দেশের রাজনীতি। ওই দিনে একটি সমাবেশ করার ঘোষণা দেয়ার পর থেকে বিরোধী জোটের শীর্ষ নেত্রী অবরুদ্ধ। নেতাদের অনেকে কারাগারে। বাইরে যারা আছেন তারাও ‘মুক্ত’ নন। এ অবস্থায় অবরোধের ডাক আসে। শুরুতে এটি রাজধানীতে সীমাবদ্ধ থাকলেও দিনে দিনে এটি গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে যায়। ভিন্ন রকম আন্দোলন শুরু হয় দেশজুড়ে। আন্দোলন দমনে সরকারও তৎপর হয়ে ওঠে। ১১ দিন ধরে দুপক্ষই মাঠে সক্রিয়। যানবাহনে আগুন পড়ছে। যাত্রীরা হতাহত হচ্ছেন। বিরোধী নেতারা চোরাগোপ্তা হামলার শিকার হচ্ছেন।  বাড়ি-গাড়িতে আক্রান্ত হচ্ছেন। অজ্ঞাত অস্ত্রধারীদের গুলিতে গুরুতর আহত হয়ে একজন হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন ক’দিন ধরে। গ্রেপ্তারের ভয়ে প্রথমসারির নেতারা প্রকাশ্যে আসছেন না। মাঠে মিছিল-মিটিং নেই খুব একটা। বেপরোয়া ভাঙচুর নেই। নেই কোন ব্যারিকেডও। শীতের দিনে অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা আন্দোলন চলছে দেশজুড়ে। কিন্তু শাসক দলের বিশেষ করে আন্দোলনকারীদের মোকাবিলায় বিজিবি, র‌্যাব-পুলিশের বাড়তি তৎপরতা আতঙ্ক ও উত্তাপ তৈরি করেছে। এ নিয়ে কূটনীতিক, মানবাধিকার সংবেদনশীল রাষ্ট্র, সংস্থা ও তাদের প্রতিনিধিরা উদ্বিগ্ন। এর খানিকটা প্রকাশও ঘটছে। তবে বেশিরভাগই এখন পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। বৈশ্বিক সম্পর্ক নিয়ে কাজ করা সরকারের প্রতিনিধিরা বলছেন, কূটনীতিকরা এখন অনেক বেশি সতর্ক। বিশেষ যে কোন বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেখানোর ক্ষেত্রে। তবে যে বিষয়ে তারা কথা বলার বা প্রতিক্রিয়া দেখাতে চাইছেন তা একা না বলে সম্মিলিতভাবে বলছেন। অত্যন্ত কড়াবার্তা আসছে কূটনীতিক অঙ্গন থেকে। সমপ্রতি সরকারি আয়োজনে দুটি কূটনৈতিক ব্রিফিং হয়েছে। সে প্রসঙ্গ তুলে বাংলাদেশের এক কূটনীতিক মানবজমিনকে বলেন, এমন পরিস্থিতিতে সরকার নিজে থেকে ব্রিফিং করে। কিন্তু এবার উল্টো ঘটনা ঘটেছে। ইউরোপের ২৮ রাষ্ট্রের জোটের ঢাকাস্থ প্রতিনিধিরা জোটবদ্ধভাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চেয়েছেন। তারা পরিস্থিতি  বোঝা এবং নিজেদের উদ্বেগের কথা জানাতে সুযোগ চেয়েছিলেন। সরকারি মহলে এ নিয়ে আলোচনার পর একটি ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়। ওই দিনে আরেকটি ব্রিফিং হয় রাশিয়া ও ইইউ জোটের বাইরে থাকা ইউরোপের দেশগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে। সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের কথা গুনেছেন এবং সরকারের অবস্থান মৌখিকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। অতীতে এমন পরিস্থিতিতে আয়োজিত কূটনৈতিক বিফ্রিংয়ে মন্ত্রীর তরফে লিখিত বক্তব্য এবং আন্দোলনকারীদের কর্মকাণ্ডের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলেও এবার তার কোনটাই ছিল না।  ইইউ এক বছর আগে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে জাতীয় স্মৃতিসৌধের অনুষ্ঠান বর্জন করেছিল। এবার কূটনৈতিক বিফিং শেষ করে মন্ত্রণালয়ের প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগেই সংস্থাটির ঢাকাস্থ ডেলিগেশন প্রধানের কার্যালয় থেকে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বৈঠকের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। কূটনৈতিক অঙ্গন থেকে কড়া বার্তা আসছে উল্লেখ করে ওই কর্মকতা বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে এরই মধ্যে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন। সরকার বা সরকারের বাইরে যাদের দ্বারাই এ সময় হত্যাকাণ্ড হোক না কেন এর নিরপেক্ষ এবং কার্যকর তদন্ত চয়েছে জাতিসংঘ। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দ্বারা বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের  গ্রেপ্তার এবং আটক যেন স্বেচ্ছাচারী না হয় এবং তাদের পদক্ষেপগুলো যেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের গণ্ডির মধ্যে থাকে সরকারকে তা নিশ্চিত করার তাগিদও দিয়েছে। বিএনপি নেতা ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমানের ওপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাটি কূটনৈতিক অঙ্গনে খুব নাড়া দিয়েছে উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইইউ ও সুইজারল্যান্ড। ঘটনার যথাযথ তদন্ত ও দায়ীদের বিচার চেয়েছেন ঢাকাস্থ বৃটিশ হাইকমিশনার। এ ঘটনায় সরকার সবচেয়ে বেশি কূটনৈতিক চাপে পড়েছে বলে স্বীকার করেন ওই কূটনীতিক।

No comments

Powered by Blogger.