অভিযান আতঙ্কে গ্রাম ছাড়ছে মানুষ

যৌথবাহিনীর অভিযান অব্যাহত রয়েছে চাঁপাই নবাবগঞ্জে। অভিযানে নতুন যোগ হয়েছে ঢাকা থেকে পুলিশের বিশেষ যান ‘এপিসি’। গ্রামের মানুষের কাছে আরও আতঙ্ক ও ভয় ছড়িয়ে দিয়েছে এই ‘এপিসি’ গাড়ি। টানা ৩ দিন যৌথবাহিনীর অভিযান চলার সময় হঠাৎ করেই গতকাল সকালে শিবগঞ্জ থানার সামনে চোখে পড়ে এপিসি গাড়ি। মুহূর্তেই খবর ছড়িয়ে পড়ে পুরো উপজেলায়। খবর পেয়ে সকাল থেকেই শিবগঞ্জ পৌর এলাকার রসুলপুর, মহদিপুর, শিবগঞ্জ বাজার, কানসাট বাজার, বিশেষ করে শ্যামপুর এলাকার বাজিতপুর, হাদিনগর, বাবুপুর, চামাবাজার, শরৎনগর, শাহবাজপুর ইউনিয়নের ধোবড়া বাজার, মুসলিমপুর, নলডুবরি ও বালিয়াদিঘী এলাকা প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছে। দুপুরে ওই সব এলাকা ঘুরে দেখা যায়, যৌথবাহিনীর ভয়ে ও নতুন এপিসি গাড়ির আতঙ্কে  ঘর ছাড়ছে সাধারণ মানুষ। তাদের সম্বল লেপ, কাঁথা, থালা-বাসন ও প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র নিয়ে চলে যাচ্ছেন তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে। মুসলিমপুর এলাকার সুবেদ আলী বলেন, বাবা রে... হামরা কে মারার লাইগ্যা পুলিশ নাকি কি গাড়ি আইন্যাছে? যাকে পাইবে তাকেই গুলি কইরা মাইর‌্যা ফেলবে। ওই ভয়ে বাড়ি থাইক্যা চইল্যা যাছি। যখন অবস্থা ভাল হবে তখন বাড়িতে আসবো। সরজমিন ওই সব এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এরকম দৃশ্য। রাস্তা-ঘাটে পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাব ছাড়া সাধারণ মানুষকে দেখা যায় না বললেই  চলে। ব্যস্ত এলাকা কানসাট, ধোবড়া, চামাবাজার,  সোনামসজিদ এলাকা প্রায় এক রকম জনশূন্য। নেই গাড়ি-ঘোড়ার শব্দ। কিছু বাড়ি-ঘরে নারীরা থাকলেও অতি প্রয়োজন ছাড়া তারা রাস্তায় বের হচ্ছেন না। আবার বের হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ির শব্দে আতঙ্কে ছোটাছুটি করছে এদিক ওদিক। চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলা বিএনপির  সভাপতি অধ্যাপক মো. শাহজাহান মিঞা অভিযোগ করে বলেন, শান্তিপ্রিয় শিবগঞ্জের মানুষের ওপর প্রশাসন সাতক্ষীরা স্টাইলে দমন-পীড়ন, নিযার্তন শুরু করেছে, অনেক বাড়ি-ঘরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটাচ্ছে। আর তাদের সঙ্গে মুখোশ পরে যোগ দিচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। তাদের নিযার্তনের ভয়ে প্রায় ৮/১০ হাজার নেতাকর্মী ঘরে থাকতে পারছেন না। গ্রেপ্তার ও নির্যাতন এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তারা। পুলিশের করা একের পর এক মিথ্যা মামলায় তারা আসামি হওয়ায় ও অব্যাহত নিযার্তন চলায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অপরদিকে শিবগঞ্জের এক উপজেলা জামায়াত নেতা অভিযোগ করে বলেন, গাড়িতে আগুন, মানুষ হত্যার অভিযোগ এনে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। যাদের নামে সুনির্দিষ্ট মামলা হয়নি তারাও আতঙ্কে আছেন ‘অজ্ঞাত আসামির’ মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার। ৬/৭ হাজার নেতাকর্মী এ পর্যন্ত ভয়ে আত্ম গোপনে চলে গেছে। গত ৫ই  জানুয়ারির পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৯টি রাজনৈতিন মামলা করা হয়েছে শিবগঞ্জ থানায়। এতে প্রায় ১ হাজার ব্যক্তির নাম উল্লেখসহ আসামি করা হয়েছে আরও ৪/৫ হাজার নেতাকর্মীকে। তাদের মধ্যে অনেকেই গ্রেপ্তার এড়াতে চলে গেছে আত্মগোপনে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম না প্রকাশ করার শর্তে জামায়াতের এক উপজেলা নেতা বলেন, মানববন্ধনের মতো নিরীহ কর্মসূচিতে পুলিশ গুলি চালাচ্ছে। রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নামে দিনে রাতে মামলা হচ্ছেই। এমন ঘটনা আমরা দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে দেখিনি। এ ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। তিনি বলেন, আন্দোলন দমনে থানার আওয়ামী লীগ নেতাদের মাধ্যমে নাম সংগ্রহ করে মামলায় আসামি করা হয়েছে। দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
এদিকে, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের আগে থেকেই শিবগঞ্জে জামায়াতের নেতাকর্মীরা রয়েছেন বেশি আতঙ্কে। একাধিকবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মাওলানা মো. কেরামত আলীকে। এদিকে গ্রামের মধ্যে দু’টি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করায় গ্রামগুলোর বাসিন্দাদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ও হতাশা বিরাজ করেছে। গতকাল সকালে কানসাট সলেমান ডিগ্রি কলেজ ও শাহবাজপুর ডিগ্রি কলেজে এই দু’টি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। চাঁপাই নবাবগঞ্জ সহকারী  পুলিশ সুপার (সার্কেল) মতিউর রহমান জানান, ক্যাম্প দু’টিতে যৌথবাহিনীর ৫০ সদস্য করে মোট ১০০ সদস্য অবস্থান করবে। তিনি আরও জানান, এতে সাধারণ মানুষের আতঙ্কের কিছু নেই। তাদের সঠিক নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করেই এই সিদ্ধান্ত। সাধারণ মানুষ যেন দুষ্কৃতকারী, সন্ত্রাস ও বোমাবাজদের হাত থেকে বাঁচতে পাড়ে সেজন্যই পুলিশের পক্ষ থেকে এ পদক্ষেপ। এলাকায় যারা সন্ত্রাস সৃষ্টি করে মানুষের যানমালের ক্ষতি করে তাদের বিরুদ্ধে যৌথবাহিনীর এই অভিযান। যতক্ষণ পর্যন্ত ওই সব এলাকা সন্ত্রাস মুক্ত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পিছ পা হবে না। তিনি সাধারণ নিরীহ মানুষকে আতঙ্কিত না হয়ে নিজ নিজ অবস্থানে থাকার জন্য অহ্বান জানান। শিবগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ এমএম ময়নুল ইসলাম জানান, টানা ৩দিন যৌথবাহিনীর অভিযানে প্রায় ১৫ জনকে আটক করা হয়েছে। তাদের মধ্যে মো. মতিউর রহমান নামে ছাত্রদলের শ্যামপুর ইউনিয়ন শাখার সহসভাপতি র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে।

No comments

Powered by Blogger.