ভটভটি অথবা সোনার বিস্কুট by শোয়ায়েব মুহাম্মদ

চার খাঁচা লাউ নিয়ে ভটভটি কাঠগড় বাজারে উঠলে পুলিশ থানায় নিয়ে যায়। ভটভটি মানে ইঞ্জিন ট্রাক্টরের পেছনে ভ্যানগাড়ি। লাউয়ের সঙ্গে ছিল করিম। পুলিশ ভ্যানগাড়ি আটকালে সে লাউ নামিয়ে ভটভটি মালিক মবিনকে ফোন করে। বলে, ‘থানাঅলা হাটে ভটভটি ধরছে।’ খবর পেয়েই মবিন দোকান বন্ধ করে থানায় যাওয়ার রিকশা নেয়।
কাঠগড় বাজার থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার পশ্চিমে স্বাধীনহাট। নামে হাট, আসলে বাজার। তাতে মবিনের মুদি দোকান। দোকানের পাশাপাশি এবার ইলেকশনের আগে থেকে জোরেশোরে পার্টি করছে। রিকশায় উঠে সে তার পরিচিত সাব-ইন্সপেক্টর শওকতকে ফোন করে। দু-তিনবার রিং হয় কিন্তু কেউ ধরে না। মবিনের ভেতর অসহিষ্ণুতা বাড়ে। সে বারবার রিং করে।
পনেরো গন্ডা জমিতে আমন ধান কাটা চলছে। পুলিশে আটক ভটভটিটির বাজারে লাউ নামিয়ে জমি থেকে কাটা ধান নিয়ে আসার কথা। থানা থেকে ভটভটি ছাড়াতে না পারলে কাটা ধান জমিনে কাটা পড়ে থাকবে।
এসআইকে না পেয়ে মবিন করিমকে ফোন করে। টাউনের ব্যাপারী আজ হাটে নেমেছে বেশি। লাউয়ের বাজার গরম। খাঁচা নামানোর সঙ্গে সঙ্গে সব বেচা হয়ে গেছে। মবিন করিমকে জিজ্ঞেস করে, ‘আটক ভটভটি বাজারে, নাকি থানায় নিয়ে গেছে?’
হাটে মাছ বেচতে এলে লোকেরা আসে ফিটফাট হয়ে আর তরকারি নিয়ে আসা লোকদের চুলে চিরুনির আঁচড়ও থাকে না। ভোরে জমিনে গিয়ে মাল তোলা, মাল তুলে পানিতে ধুয়ে গোছগাছ করতে করতে নিজের পরিপাটির কথা খেয়ালও থাকে না। করিমের চুলকাটা দরকার তিন হাট ধরে। ড্রাইভারসহ ভটভটি থানায় নিয়ে গেলে করিম সেলুনে ঢোকে। গত হাটবারেও নিয়ত ছিল চুল কাটার। কিন্তু আনা তরকারি গরম গরম বিক্রি হয়ে গেলে সেলুনে না ঢুকে ঢুকেছিল পাশের সিনেমা হলে। শো বারোটা থেকে তিনটা।
সিনেমা হলে এ সপ্তাহেও নতুন পোস্টার। খেতে ধান কাটা চলছে আর থানায় আটক ভটভটি ছাড়ানোর জন্য মালিক ব্যস্ত থাকবে। সে জন্য চুল কেটে তাড়াতাড়ি ফিরে যাবে ভাবে। চুল কাটতে সেলুনে ঢুকেছে—এ সময়েই মবিন ফোন করে। করিম বলে, ‘ভটভটি ড্রাইভারসহ নিয়ে গেছে থানায়।’
মবিন তাকে ভ্যান ভাড়া করে ধানগুলো নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে বলে। আর বলে, চেয়ারম্যানকে সে ফোনে পাচ্ছে না। যাওয়ার সময় যাতে চেয়ারম্যান বাড়ি হয়ে যায় আর বাড়ি থাকলে তাকে যেন থানায় ভটভটি আটকের খবর দেয়।
চুল কাটা শেষ করে খালি খাঁচা চারটে বেঁধে করিম চেয়ারম্যান বাড়ির দিকে রওনা দেয়। হাট থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পশ্চিমে চেয়ারম্যানের কাছারি। কিছুদূর গেলেই দেখা হয় আসানের ভ্যানগাড়ির সঙ্গে। আসান আর করিম এক গ্রামের। আসান রিহার্সাল করছে নাটকে—অশ্রু দিয়ে লেখা। ঐতিহাসিক নাটক। প্রতিবছর অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে ধান কাটার পর গ্রামে নাটক হয়। এ বছরও হচ্ছে। আসানের পার্ট গোরা চাঁদের। এশার পর প্রতিদিন রিহার্সাল হয় বাবুল সওদাগরের দোকানের পেছনে। আসান করিমকে দেখে একটা সংলাপ দেয়: ‘হ্যাঁ, বাঁচতে আমাদের হবেই। হাবশি শাসনের কশাঘাতে সাত কোটি বাঙালির আজ ঘুম ভেঙেছে, বাঙালির আকাশে আজ মেঘমুক্তির লগ্ন। রাম রহিম এলে তোমরা বলে দিয়ো, গোরা চাঁদ সব দিয়ে গেছে, নিয়ে গেছে শুধু বুকভরা আশার আলো। তারা যেন হিন্দু-মোসলমান এক হয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে কণ্ঠ মিলিয়ে ঘোষণা করে, আমরা হিন্দু নই, মুসলমান নই, আমরা বাঙালি।’ আসানের কথা বলা আর হাত নাড়ানোর ঢং দেখে করিম হাসে। আসান ভ্যানগাড়ি চালায় আবার শীত মৌসুমে অনেক দূর দূর কাপ্তাই, চন্দ্রঘোনা, রাউজান গিয়ে নাটকের পার্ট করে। এক নাইট চার শ টাকা। রাস্তার পাশে পড়ে বাঁধাকপি খেত। খেতের সবুজে করিমের চোখ জুড়ায়। বলে, ‘কপ্পি খেতের বাহাদুরি বোরনে।’ খেতের দুটো আল পরেই চেয়ারম্যান বাড়ির রাস্তা। করিম ভ্যান দাঁড় করিয়ে চেয়ারম্যান বাড়িতে যায় আর মবিনের ভটভটি আটকের বৃত্তান্ত বলে। চেয়ারম্যান তখন তৈরি হচ্ছিল পরিষদে যাওয়ার জন্য। করিমের বৃত্তান্ত শুনে বলে, ‘ঠিক আছে। আই থানাত ফোন করমু।’ মোবিনের দোকান ইউনিয়ন পরিষদের সামনে। একই পার্টির লোক বলে অন্তরঙ্গতা আছে চেয়ারম্যানের সঙ্গে।
২. মবিন থানার কাছাকাছি পৌঁছলে দেখে, থানায় আজ আমন ধান শুকানোর নিকানো উঠোনের সাজগোজ। সবকিছু ফিটফাট পরিষ্কার করা। এক পাশে তার ভটভটিসহ আরও কয়েকটি ভটভটি দাঁড় করানো। থানার সামনে পৌঁছে মবিন এসআই শওকতকে আবার ফোন করে। বারবার রিং বেজে চলে, কারও সাড়া পাওয়া যায় না। থানায় ঢুকে ডিউটি রুম দেখে, ওসির রুম দেখে। সব জায়গা খালি। কাউকে না পেয়ে মবিন মূল দরজার সিপাহিকে জিজ্ঞেস করে, ‘শওকত সাহেব থানায় আছে নাকি?’ সিপাই বলে, ‘আজ এসপি সাহেব আসছে। স্যারেরা সবাই ব্যস্ত।’ থানায় কাউকে না পেয়ে মবিন আসে বাজারে। রাস্তার দুই পাশে গৃহস্থেরা সবজি নিয়ে বসেছে। কাঠগড় বাজার আদতে সবজির হাট। চলে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত। সবজির বাজার বলে হাটের দিন ভটভটি আসে বেশি। লাউ, শিম, ফুলকপি, জাত বেগুন বোঝাই ভটভটি। মবিনরা আগে মাল আনত রিকশায়, তারপর ভ্যানগাড়িতে। এখন সবাই মাল আনে ভটভটিতে। ভটভটি এলে পুলিশকে বকশিশ দিলে ছেড়ে দেয়, কিন্তু আজ ধরেছে। মবিন থানায় ভটভটি পেলেও ড্রাইভারকে দেখে না। মবিন ড্রাইভার আর এসআইকে হাটে খোঁজে। হাট থেকে কিছু দূরে অস্থায়ী চা-দোকানে ড্রাইভারকে পায়। মবিনদের গ্রামের কয়েকজনও তরকারি বেচে দোকানে এসে বসেছে। ভটভটি আটকের খবর গ্রামেও পৌঁছে গেছে। ভটভটি করে তরকারি আনা চাষারা ভটভটি হাট থেকে কিছু দূরে রেখে তরকারি নিয়ে আসছে। তার গ্রামের খেতওয়ালাদের সঙ্গে কথা বলছে, এ সময় এসআই শওকতকে দেখে মবিন। কাঠগড় বাজার থেকে থানার দিকে ফিরছে। এসআইকে দেখে মবিন স্যার স্যার বলে দৌড়ে যায়। শওকত থামলে মবিন বলে, ‘স্যার, থানা আমার ভটভটি আটকাইছে।’ আজ ডিসি সাহেব থানায় আসবে। রাস্তা খারাপ তাই হাটবার মানে কাঠগড় বাজারে যানজট। তাতেও কিছু হতো না। প্রতি হাটবারেই সকালে গৃহস্থের তরকারি আনা রিকশা, ভ্যানগাড়ি, ভটভটিতে আর বিকেলে সেই সবজি দূর দূর শহরে নেওয়ার ট্রাকে কাঠগড় বাজারে যানজট থাকে। ঝামেলা তৈরি করেছে কাগজওয়ালারা। গত সপ্তাহে জেলা সদরের প্রধান দৈনিকের প্রধান খবর ছিল, ভটভটিতে কাঠগড় বাজারে যানজট। তাই ডিসি সাহেব আসার আগেই বাজার থেকে সব ভটভটি আটক চলছে। মবিন শওকতকে তার ভটভটি আটকেছে বললে, এসআই বলে কোনো কিছু করার নাই। আজ কোনো তদবির চলবে না। ডিসি সাব বাজারে ভটভটি দেখলে খবর আছে। এবার ইলেকশন আর গ্রামের সালিস বিচারসূত্রে পুলিশের সঙ্গে পরিচয়ে কাজ হলো না দেখে মবিন ভাবে, এবার এমপিকে ফোন করবে।
৩. চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে করিম ভ্যানগাড়িতে ফিরে এলে আসান তাকে একটা বিস্কুট দেখায়। মাঘ মাসে ফোটা গাঁদা ফুল রং। করিম আসানকে জিজ্ঞেস করে, ‘সোনার?’ তার গলায় অবিশ্বাস আর বিস্ময়। আসান বিস্কুট পাওয়ার বৃত্তান্ত বলে। বলে, গতকাল ঘাটঘরের লাস্ট ট্রিপ মেরে খালি রিকশা জেলেপাড়ার টেকে এলে রাস্তার ওপর লেখা কাগজসহ বিস্কুটটা পায়। করিম জিজ্ঞেস করে, ‘সোনার দোকানে দেখাইছ?’
আসান বলে, কাঠগড় বাজারের বণিকেরা তার চেনা। এ রকম বিস্কুট দেখালে নানা রূপ সন্দেহ করবে। তাই কাল থেকে ভাবছে, আপন কারও সঙ্গে সলা করবে। আসানের বক্তব্য করিমকে খুব তাড়িত করে। করিম ভাবে, আসানের বিস্কুট সে কিনে নেবে। তার কাছে লাউ বেচা টাকা আছে আর আছে এগারো শ মডেলের নকিয়া সেট। এগুলোর বদলে বিস্কুট নিলে কাঠগড় বাজারে বণিকদের কাছে বেচে পরে মোবাইল আর মবিনের টাকা দিয়ে দেবে। করিম বলে, ‘আসান ভাই, তোয়ার যন এত ঝামেলা, বিস্কুট আঁর কাছে বেচি দ।’ আসান রাজি হয় না। বলে, ‘কী দিবি?’ করিম মোবাইল আর লাউ বেচা বারো শ টাকা দেবে জানায়। রাস্তার পাশে কুমড়ো খেত। খেতের প্রতি তাবায় রোদ ঠেকানোর জন্য শুকনো খেজুর ডাল লাগানো। আসান খেতের পাশে ভ্যান রাখে। মোবাইল আর টাকা নিয়ে বিস্কুট বের করে দেয়। করিম বিস্কুট হাতে নিয়ে নেড়ে-চেড়ে দেখে। দেখে মনে হয় আসল সোনার।
৪. এমপি সাহেব কাঠগড় বাজারে জনসংযোগ সেরে নির্বাচনী ক্যাম্পে বসে বলেছিলেন, ‘এখন অথবা নির্বাচনে যদি জিতি, কোনো সুবিধা-অসুবিধা সংকোচ ছাড়া জানাবেন। এই নেন আমার মোবাইল নাম্বার।’ মবিন ছিল কাঠগড় নির্বাচনী ক্যাম্পের প্রধান। ভোটে জেতার পর মালা নিয়ে রাতেই ছুটেছিল এমপি সাহেবের বাড়ি। তার ভেতর অদ্ভুত আনন্দ হচ্ছিল। সমগ্র আসন একত্রে হয়তো মার্কার প্রার্থী জিতেছে। কিন্তু প্রতি কেন্দ্রে আলাদা কষ্টে মবিনরা নিজস্ব বিজয় তৈরি করেছে। ভোটের রাতে এমপির বাড়িতে এমপিকে মালা পরাতে গিয়ে মবিন কেঁদে ফেলে। এখন তার শেষ ভরসা পরিচিত পুলিশ অফিসার আটকানো ভটভটি ফেরত অসম্ভব বললে, মবিনের এমপি সাহেবের কথা মনে পড়ে। ভটভটি না হলে খেতের ধান, তরকারি আর দোকানের মুদি বাজার আনায় মুশকিলে পড়বে। মবিন এমপি সাহেবকে ফোন করে। বলে, ‘আঁই মবিন, স্যার। কাঠগড় বাজারের তোন।’ ওপাশে স্লোগান, হট্টগোল, অনেক কণ্ঠ শোনা যায়। এমপি লাইন কেটে দেয়। মবিন আবার ফোন করে। বলে, ‘আঁর ভটভটি পুলিশে লৈ গেছে গৈ স্যার।’ জেলার সবচেয়ে বড় মাঠে তখন নির্বাচনে জেতা মন্ত্রী-এমপিদের সংবর্ধনা চলছিল। এমপি আবারও লাইন কেটে দেন। মবিন কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে আবার ফোন করে। বারবার ফোন পেয়ে এমপি থানায় ফোন করে।
৫. আসান থেকে বিস্কুট কিনে পরদিন সকাল সকাল করিম হাজির হয় কাঠগড় বাজারে। বণিকেরা দোকান খুলে তন্ত্রমন্ত্রের পর সবে চায়ের অর্ডার দিয়েছে। আগে থেকে আলগা পরিচয় ছিল, করিম বি বি জুয়েলার্সে বিস্কুটটা দেখায়। করিম কাঠগড় বাজারে এলে থানা থেকে পুলিশ যায় মবিনের বাড়িতে। কাল ডিসি আসায় ঝামেলায় ছিল বলে লোকাল এমপির হুকুম পালন করতে পারেনি। সকালেই এমপির হুকুম পালন করতে পুলিশ রওনা হয়েছে। লোকাল এমপি জেলার বড় জনসভার মাঠ থেকে কাল ফোনে নালিশ করেছে, কাঠগড় বাজারের মবিন নামে একজন তাকে বারবার বিরক্ত করছে। পুলিশ যেন থানায় নিয়ে একটু টাইট দেয়। রোদ একটু তাতলে মবিনকে পুলিশ থানায় নিয়ে আসার সময় করিমকে বি বি জুয়েলার্স জানায়, তার আনা সোনার বিস্কুট জাল।

No comments

Powered by Blogger.