ইফেকটিভ টিচিং স্কিল

প্রখ্যাত রবীন্দ্রগবেষক উর্দুভাষী প্রাজ্ঞ পণ্ডিত আবু সায়ীদ আইয়ুব সাহিত্যের মূল্য বিবেচনা করে ‘সাহিত্যের চরম ও উপকরণ মূল্য’ শিরোনামে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছেন গত শতকের সাতের দশকে। প্রবন্ধের শিরোনামেই সাহিত্যের মূল্য নির্ধারণের ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। তার বিবেচনায় সাহিত্য বা গ্রন্থের মূল্য দুই রকম : ‘উপকরণ মূল্য’ এবং ‘চরম মূল্য’। আবু সায়ীদ আইয়ুব উপকরণ মূল্য বলতে বুঝিয়েছেন ব্যবহারিক মূল্যকে ইংরেজিতে যাকে বলা যায় ‘ইউটিলিটি ভ্যালু’ আর চরম মূল্য মানে চূড়ান্ত মূল্য বা ‘ফাইনাল ভ্যালু’। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ক্ষুধা লাগলে আমরা আহার করি। আহার করলে তাৎক্ষণিক ক্ষুধা নিবৃত্ত হয়, সমূহ প্রয়োজন মেটে এবং শরীর-মন প্রশান্তি লাভ করে। এই প্রয়োজন মেটানোর মূল্যই আহারের উপকরণ মূল্য, ব্যবহারিক মূল্য বা ‘ইউটিলিটি ভ্যালু’। কিন্তু ক্ষুধা মেটানোই আহার গ্রহণের শেষ কথা নয়। এর আরও মূল্য আছে, যাকে চরম বা চূড়ান্ত মূল্য বা ‘ফাইনাল ভ্যালু’ বলা যায়। আর তা হল খাদ্যের জারক রস, যা আমাদের জীবন ধারণ করতে অর্থাৎ বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। খাদ্যের এই মূল্য চোখে দেখা যায় না বটে, তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে এই মূল্যই হল খাদ্যের আসল বা মুখ্য মূল্য। আবু সায়ীদ আইয়ুব সাহিত্যের মূল্য বিষয়টিকে এভাবেই দেখেছেন। কোনো গ্রন্থ পাঠ করে সমূহ প্রয়োজন মেটানো যায়, যেমন পরীক্ষা পাসের জন্য বই পড়া। এমন পাঠ স্বাভাবিকভাবেই পরীক্ষা পাসের প্রয়োজন মেটায় আবার এই পাঠের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান মেধাকে বিকশিত করতে সাহায্য করে, যা তাকে জ্ঞানী বা প্রজ্ঞাবান করে তোলে। আবার এমন গ্রন্থও আছে যা পাঠে সমূহ প্রয়োজন মেটে বটে, কিন্তু পাঠক মস্তিষ্কে কোনো স্থায়ী প্রভাব ফেলে না, ফেলতে পারে না।
আমাদের আলোচ্য গ্রন্থ ‘ইফেকটিভ টিচিং স্কিল’। গ্রন্থ-শিরোনামেই বুঝা যায়, একটি বিশেষ পেশা বা বৃত্তির কার্যকরী উৎকর্ষ সাধন বা অর্জনবিষয়ক গ্রন্থ এটি। আর সেই পেশা বা বৃত্তি হল শিক্ষকতা। গ্রন্থের শুরুতে ‘সম্পাদকের কথা’ শিরোনামে অতি সংক্ষিপ্ত বয়ানের শুরুতেই সম্পাদক লিখেছেন, ‘মানব সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই শিক্ষকতা একটি মহৎ পেশা। উদ্দেশ্য অর্জনের জন্যে শিক্ষকতার কার্যকারিতা অপরিহার্য। কেবল পুঁথিগত বিদ্যা দিয়ে কার্যকর শিক্ষকতা সম্ভব নয়। প্রয়োজন কিছু পদ্ধতি এবং কৌশলের; যা অবলম্বন করে একজন শিক্ষক কার্যকর শিক্ষা প্রদানে পারঙ্গম হয়ে উঠতে পারেন।
এই ‘শিক্ষকতায় কার্যকরী দক্ষতা অর্জন’ গ্রন্থে আমি এইসব পদ্ধতি ও কৌশল নিয়ে আলোচনা করেছি। আশা করি কর্মরত শিক্ষকরা তাদের পেশাকে আরও কার্যকর করার প্রয়োজনে নিজেকে অধিক যোগ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন।’
এই বক্তব্যে লেখক/সম্পাদকের অভিপ্রায় সুস্পষ্ট। তিনি মনে করেন, মানুষ গড়ার কারিগর বলে খ্যাত শিক্ষককে অবশ্যই পরিপূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করে তার ওপর বর্তিত দায়িত্ব পালন করতে হবে। পালন করতে হবে সুচারুরূপে। প্রকৃত শিক্ষকতায় কোনো ফাঁক বা ফাঁকির স্থান নেই। শিক্ষকতায় নিয়োজিত ব্যক্তিকে হয়ে উঠতে হবে চারদিক দিয়ে চৌকস। আর তা অর্জন করতে নানা কলাকৌশল প্রয়োগের কোনো বিকল্প নেই। এমন কলাকৌশলের বিশাল এক সমাহার বর্তমান ‘শিক্ষকতায় কার্যকরী দক্ষতা অর্জন’ গ্রন্থ। কেবল সমাহার বা উপস্থাপনা নয়, এসবের সুষ্ঠু ও সার্থক প্রয়োগ পদ্ধতির বাস্তব রীতি-নীতি-পদ্ধতি অলোচিত হয়েছে এই গ্রন্থে। মানুষ প্রাজ্ঞ বা ওস্তাদ হয়ে জন্মগ্রহণ করেন না; তা তাকে অর্জন করতে হয়। আর এই অর্জনে প্রচেষ্টা, চর্চা বা পাঠের কোনো বিকল্প নেই।
কিন্তু কী পড়বে? কোথায় পাওয়া যাবে সে পাঠের বা চর্চার দিকনির্দেশনা? এসবেরই উত্তর পাওয়া যাবে ‘শিক্ষকতায় কার্যকরী দক্ষতা অর্জন’ গ্রন্থে। ১৮টি অধ্যায়ে ৯১টি উপ-অধ্যায়ে বিন্যস্ত হয়েছে গ্রন্থের মূল বিষয় অর্থাৎ ‘শিক্ষকতায় কার্যকরী দক্ষতা অর্জন’ বিষয়ক আলোচনা। এর মধ্যে ৬.২. কীভাবে অভিভাবকদের সম্পৃক্ত করা যায়, ৬.১৪. শিক্ষার্থীর সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন, ৭.১. শিক্ষক একজন সংগঠক, ৮.৫. কীভাবে ভুল না করে পারা যায়, ৮.১৫. শিক্ষার্থীর সম্মান অর্জন, ৯.১. শ্রেণীকক্ষে প্রথম দিন : কী করতে হবে, ১৫.২. ও ১৫.৩. শিক্ষার্থীদের পড়ার এবং লেখার অভ্যাস গড়ে তোলা ইত্যাদি বিষয়গুলো পাঠকের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণের দাবি রাখে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিক্ষাকর্মে নিয়োজিত নির্বাহীদের দক্ষতা অর্জনের উপায়। পরিশিষ্টে আরও সংযুক্ত হয়েছে কার্যকরী শিক্ষাদান, পেশাগত উন্নয়ন এবং নেতৃত্ব বিষয়ে আলোচনা।
লেখক/সম্পাদক ড. এম এ হান্নান ফিরোজ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সুচারুরূপে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোকে উপস্থাপন করেছেন এই গ্রন্থে। সহজেই অনুমান করা যায় ব্যক্তিগত বাস্তব অভিজ্ঞতারই প্রতিফলন এই গ্রন্থ। তিনি নিজে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ণধার সে অর্থে উচ্চশিক্ষাকে মূল ধরেই তার এই প্রয়াস। কিন্তু গ্রন্থটিতে শিক্ষকতার মূল বিষয় উপস্থাপিত হওয়ায় এর কার্যকারিতা কেবল উচ্চশিক্ষার সীমানায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, হয়ে উঠেছে সব স্তরের সব পর্যায়ের শিক্ষকতার সার্বক্ষণিক সঙ্গী।
একটি বিশেষ বিষয়, অর্থাৎ শিক্ষকতার উৎকর্ষ সাধনের উদ্দেশ্যে গ্রন্থটি সম্পাদিত ও প্রকাশিত হলেও এটি আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব মহলের কাছে। আবার সাধারণ পাঠকের কাছেও এর গুরুত্ব কম নয়। আর একবার পাঠেই এর গুরুত্ব বা মূল্য শেষ হয়ে যায় না। বিষয়গুলো ধারণ করলে যে কোনো মানুষের জ্ঞানের সীমাকে ব্যাপক ও বিস্তৃত করবে। যার মধ্য দিয়ে যে কোনো মানুষ তার সামনে চলার পথকে সুপ্রস্থ দেখতে পারেন।
তাই গ্রন্থের মূল্য বিচারে একে ব্যবহারিক মূল্য অর্থাৎ ‘ইউটিলিটি ভ্যালু’ থেকে চরম মূল্য অর্থাৎ ‘আলটিমেট ভ্যালু’তে উন্নীত করেছে।
বদিউর রহমান
ইফেকটিভ টিচিং স্কিল
সম্পাদনা : অধ্যাপক ড. এম এ হান্নান ফিরোজ
প্রকাশক ।। মাহবুবুর রহমান বাবু
বইপত্র প্রকাশন
পৃষ্ঠা ।। ১৯২ দাম ।। ৫০০ টাকা

No comments

Powered by Blogger.