‘উদ্যোগহীনতায় দুর্নীতি বেড়েছে’

সরকারের উদ্যোগ-হীনতায়ই দুর্নীতি বেড়েছে বলে মনে করেন দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশিষ্টজনরা। তাদের মতে, রাজনৈতিক সদিচ্ছার পাশাপাশি শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকায় দুর্নীতি উৎসাহিত হয়েছে। সরকারের প্রচেষ্টায় দুর্বলতা ও আইনগতভাবে ত্বরিত ব্যবস্থা না নেয়ায় দুর্নীতির সূচকে দুই ধাপ অবনতি হয়েছে। অবস্থা একই ভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে এ অবস্থানের আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশিষ্টজনরা। গত বুধবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল সারাবিশ্বে একযোগে দুর্নীতির ধারণাসূচক প্রকাশ করে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশে গত এক বছরে দুর্নীতি বেড়েছে। সূচকে অবনতি হওয়ায় নিম্ন ক্রমের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান হয়েছে ১৪তম। আগের বছর এ অবস্থান ছিল ১৬তম। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের দুই ধাপ অবনতি হয়েছে। বড় কথা হলো আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে, যেটা আমরা পারিনি। তাছাড়া, রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। যেখানে যেখানে দুর্নীতি হয় সেখানে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার এবং এর পরিধি বাড়াতে হবে। আইনিভাবে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে হবে। এসব না হওয়ায় দুর্নীতিতে উৎসাহ যুগিয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে তাদের ব্যাপারে দলমত নির্বিশেষে ও নিরপেক্ষভাবে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এছাড়া ‘অনেকেই বলে থাকেন সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা বাড়ানো হলেও তারা দুর্নীতি করছে’- এ বিষয়ে তিনি বলেন, কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা বাড়িয়ে কি লাভ- যদি নৈতিকতা তৈরি করতে না পারি? নৈতিক বোধ সৃষ্টিতে সরকারকে প্রশিক্ষণমূলক কাজ হাতে নিতে হবে। অন্যদিকে যারা দোষী তারা শাস্তির আওতায় আসছে না। ফলে ঘুষ-দুর্নীতি বহু গুণে বেড়েই চলেছে দিনকে দিন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, দেশে ঘুষ-দুর্নীতির আদৌ কোন উন্নতি হয়নি। এ নিয়ে সরকার ও সমাজের কোন উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না। আর এটা দীর্ঘ দিনের সমস্যা। সরকার ও সামাজিক উদ্যোগ ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)-এর প্রতিবেদন নিয়ে বলার কিছু নেই। তাদের প্রতিবেদন সূচকেই সব উঠে এসেছে। এতে বাংলাদেশ দুর্নীতির সূচকে দুই ধাপ অবনতি হয়েছে। এর মূল কারণ সরকারের প্রচেষ্টায় দুর্বলতা ছিল। তাছাড়া, সরকারের মৌখিক যে কার্যক্রম তা বাস্তবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। ফলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। আর দুর্নীতি বাড়ছে। বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, গত ১ বছরে দুর্নীতি বিশেষত এমপিদের হলফনামা, ব্যাংকের জালিয়াতি থেকে শুরু করে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ও অসৎ লেনদেনসহ এ সংক্রান্ত সংবাদ জনসম্মুখে এত এসেছে-দুর্নীতি থেকে দুদকের দায় মুক্তির হিড়িক দেখে আমার মনে হয়েছিল টিআইয়ের ধারণা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থা আরও নিচে নামবে। সেই প্রেক্ষাপটে আরও দু’ধাপ নিচে নামার রিপোর্ট খুব খারাপ বলবো না। তবে এই ধারা বজায় থাকলে শিগগিরই দুর্নীতিতে প্রথম স্থান আমরা পুনরুদ্ধার করতে পারবো। তিনি বলেন, একদিকে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে স্পষ্টতই দুর্নীতি বাড়ছে। একদিকে গণতন্ত্র ও উন্নতি। পাশাপাশি দুর্নীতি। এ দু’টো একসঙ্গে চলতে পারে না। দুর্নীতি যেহেতু বাড়ছে, সেহেতু গণতন্ত্র ও উন্নতি বাড়ছে-এটা বলা যাবে না। যারা এটা বলে তারা সম্ভবত জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করছে। বুধবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে টিআই’র বৈশ্বিক দুর্নীতির ধারণা সূচক প্রকাশের সময় টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের দুর্নীতির সূচক দেশে দুর্নীতির প্রকট রূপেরই ইঙ্গিত করে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নে আরও কঠোর ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় হওয়ায় দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। দুর্নীতির সূচক (সিপিআই) ফেব্রুয়ারি ২০১১ সাল থেকে আগস্ট ২০১৪ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে তথ্য সংগ্রহ করে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.