ইন্দ্রা গ্রামের ফাতেমা by নূর ইসলাম

’৭১-এ লড়াই করেছেন ফাতেমা বেগম। জীবন আর যৌবন উৎসর্গ করেছেন দেশমাতৃকার জন্য। সহ্য করেছেন পাকিস্তানি সেনাদের অসহনীয় নির্যাতন। হায়েনার দল নারী জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ লুটে নিয়েছে দিনের পর দিন। কিন্তু দেশের স্বাধীনতার সুখ ভোগ করার অতৃপ্ত আশা নিয়ে সেসব নির্যাতন আর যন্ত্রণা নীরবে সহ্য করেছেন। অশীতিপর এই যোদ্ধার জীবনের শেষ ইচ্ছা মৃত্যুর আগে তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ সাহেবের বেটি হাসিনার সঙ্গে দেখা করে তার অব্যক্ত কিছু কথা তাকে বলবেন। তার স্বপ্ন মৃত্যুর পর নিজের নামের একখ- জমিতে যেন তাকে দাফন করা হয়। তার নিজস্ব জমি নেই, এ কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন এ বীরকন্যা। তিনি বলেন, কষ্ট হয় যখন দেখি স্বাধীনতা বিরোধীরা রাতারাতি স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি হয়ে ওঠে। ক্ষমতা দখল করে অগাধ সম্পদের মালিক হয়ে তাদেরকে বীরাঙ্গনা বলে ঠাট্টা-তামাশা করে। দেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবসে যখন তাদের মূল্যায়ন করার কোন লোক থাকে না, সবাই ব্যস্ত থাকেন ’৭১-এর পরাজিত শকুন ও তাদের দালালদের নিয়ে, তখন মনে হয় যুদ্ধের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এখনো সুদূর পরাহত। যশোর শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার পূর্ব- উত্তরের গ্রাম ইন্দ্রা। বর্তমানে এটি যশোরের বাঘারপাড়া থানার অন্তর্গত। বাঘারপাড়া শহর থেকে ৩ কিলোমিটার উত্তরে নারিকেল বাড়িয়া সড়ক ধরে এগুলেই ফাতেমার বাড়ি। পাকা রাস্তার ধারের সেই বাড়িটি দেখলেই পল্লী কবি জসীম উদ্‌দীনের সেই বিখ্যাত কবিতার কয়েকটি চরণ মনে পড়ে যায়। ‘আসমানীদের দেখতে যদি তোমরা সবে চাও, রহিম উদ্দিনের ছোট্ট বাড়ি রসুল পুরে যাও। বাড়ি তো বাঁশের বেড়া ভেন্না পাতার ছানি, একটু খানি বৃষ্টি হলে গড়িয়ে পড়ে পানি।’ এই অমর কবিতার সঙ্গে ফাতেমার ঘরের অপূর্ব এক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বেড়ার ঘর আর কলা পাতার ছানি দেয়া সেই ছোট্ট একটি ঘরে বাস করছেন ’৭১-এর বীর কন্যা ফাতেমা খাতুন। এই গ্রামের কৃষক মীর সৈয়দ আলীর মেয়ে তিনি। ১৯৭১ সালে তিনি ১৭ বছরের টগবগে কিশোরী। সুশ্রী ফাতেমা খাতুন যেমন ছিলেন  সুন্দরী তেমনি লম্বা। ফর্সা তার গায়ের রং। অভাব-অনটন আর দারিদ্রের কারণে পিতা সৈয়দ আলী ফাতেমাকে লেখাপড়া শেখাতে পারেননি। বিবাহযোগ্য মেয়েকে নিয়ে পিতার দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। দেশে যুদ্ধ বেধে গেছে। ইন্দ্রা গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা সিদ্দিক মুক্তিযুদ্ধে নাম লিখিয়েছে। সে এলাকার তরুণ সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে ইন্দ্রা স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি অস্থায়ী প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খুলেছেন। সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা লে. মতিউর নড়াইল থেকে এসে ওই ক্যাম্পের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করছেন। সিদ্দিক মামার সঙ্গে স্কুলছাত্রী হালিমা ওই ক্যাম্পে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মকা- দেখে। এভাবে বেশ কিছুদিন চলার পর খবর পৌঁছে যায় বাঘারপাড়ার পাক সেনাদের কাছে। মে মাসের প্রথম দিকে পাকবাহিনী ইন্দ্রা স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে হামলা চালায়। গোটা গ্রামে তারা তা-ব চালিয়ে সিদ্দিকের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগেভাগে খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাশের শ্রীরামপুর গ্রামে অবস্থান নেয়। এই মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে হালিমা ও তার অপর দুই বান্ধবী ফাতেমা আর রোকেয়াও শ্রীরামপুর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যায়। দেশের জন্য যুদ্ধকারী মুক্তি সেনাদের সেবা-যত্ন করার পাশাপাশি তারা এই ক্যাম্পের অধিনায়ক লে. মতিউর রহমানের কাছে ছোট ছোট অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। জুন মাসের শেষের দিকে শ্রীরামপুরে পাক সেনারা অভিযান চালায়। এখানে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের জম্পেশ লড়াই হয়। এই যুদ্ধে  সামছুর রহমান, বজলুর রহমান আর রতন পাক সেনাদের গুলিতে শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে মালঞ্চ গ্রামে আশ্রয় নেয়। ৩ দিন পর পাক সেনারা মালঞ্চ গ্রাম ঘিরে ফেলে। শুরু হয় যুদ্ধ। প্রায় ৩ ঘন্টা সম্মুখ লড়াই করে মুক্তিযোদ্ধারা ফের পিছু হটে শেখের বাথান গ্রামে আশ্রয় নেয়। এই যুদ্ধে গোলাম সরোয়ার নামে এক মুক্তিযোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। পরদিন সকালে পাকসেনারা শেখেরবাথান গ্রামে আক্রমণ চালালে মুক্তিযোদ্ধারা ফের অবস্থান পাল্টে শ্রীরামপুর স্কুলে অবস্থান নেন। জুন মাসের মাঝামাঝি ফের এই ক্যাম্পে হামলা চালায় পাক সেনারা। এভাবে মে জুন মাসে পাক সেনাদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি ছোট-বড় যুদ্ধ হয় এ এলাকায়। একপর্যায়ে সোলায়মান, আয়েনউদ্দিন, হাসান আলী, হোসেন আলী, কাওছার আলীসহ আরও অনেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে চলে যান। তাদের সঙ্গে ফাতেমাসহ তার অন্য ২ সাথী রোকেয়া আর হালিমা যেতে চাইলেও মেয়ে বলে তাদেরকে সঙ্গে নেয়া হয়নি। একপর্যায়ে সিদ্দিক মামা ও তার অন্য সহযোদ্ধাদের সঙ্গে ফাতেমা ও তার অপর ২ সহযোগী পার্শ্ববর্তী বিরামপুরে আশ্রয় নেন।  জুন মাসের শেষের দিকে পাক আর্মিরা ফের বিরামপুর গ্রাম ঘিরে ফেলে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে থাকে। একপর্যায়ে পাক সেনারা কোরবান, সোহরাব, ফাতেমা, হালিমা আর রোকেয়াকে ধরে ফেলে। তাদের চোখ মুখ বেঁধে বাঘারপাড়া সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ক্যাম্পের পাশে সোহরাব আর কোরবানকে গুলি করে হত্যা করে তারা। আর ফাতেমাসহ তিন নারী যোদ্ধাকে ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়। এখানে ২/৩ দিন আটকে রাখার পর তাদেরকে যশোর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে একটি কক্ষে আটকে রেখে চালানো হয় চরম নির্যাতন। যুদ্ধ করার অপরাধে তাদের বিরুদ্ধে কঠিন কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করা হতো। সপ্তাহে ১/২ দিনের বেশি খাবার দেয়া হতো না। চালানো হতো শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। পাক সেনাদের ইনফরমার হিসেবে কাজ করার অফারও দেয়া হয় তাদরেকে। বলা হয় পাক সেনাদের হয়ে কাজ করলে তাদের মুক্ত করে দেয়া হবে। কিন্তু শত নির্যাতন আর গঞ্জনা সহ্য করে তারা অপেক্ষার গ্রহর গুনতে থাকে কবে দেশ স্বাধীন হবে। এভাবে তারা তিন নারী দীর্ঘ ৬ মাস যশোর ক্যান্টনমেন্টে আটকা ছিলেন। ৭ই ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হলে পাক সেনারা ক্যান্টনমেন্ট ফেলে পালিয়ে যায়। সে সময় মুক্তি সেনারা ক্যান্টনমেন্টের দখল নেন। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা এই ৩ সহকর্মীসহ আরও অনেক বন্দি যোদ্ধাকে উদ্ধার করেন। এর পরের ইতিহাস আরও করুন। স্বাধীনতার ২৮ বছর পর ১৯৯৯ সালে ফাতেমা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি লাভ করেন। কিন্তু কি দুর্ভাগ্য তিনি এখন সেই স্বীকৃতির কোন সনদ পাননি। প্রতি মাসে তিনি সরকারি সহায়তা হিসেবে ৫ হাজার টাকা ছাড়া আর কোন অনুদান পাননি।

No comments

Powered by Blogger.