কালো ধোঁয়া ছেড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল শত্রু বিমান

সিলেট ওসমানী বিমানবন্দর মুক্তিযুদ্ধকালীন সালটিকর বিমানবন্দর হিসেবে পরিচিত ছিল। বিমানে আনা অস্ত্র ও রসদ সেখান থেকেই সরবরাহ করা হতো পাক হানাদারদের। সেদিনের ১২ বছর বয়সী কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল সহযোদ্ধাদের নিয়ে দুর্গম হাওরে ওঁৎ পেতে থেকে গুলি করে উড়িয়ে দেন একটি পরিবহন বিমান। জয় বাংলা পত্রিকা ও আকাশবাণী থেকে ফলাও করে খবরটি প্রচারিত হয়েছিল তখন। কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার টামনি নয়াপাড়া গ্রামের ইসমাইল আজও বেঁচে আছেন। তিনি এখন অষ্টগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রধান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক। বৃহস্পতিবার যুগান্তর কিশোরগঞ্জ ব্যুরো কার্যালয়ে তিনি স্মৃতিচারণ করেন তার যুদ্ধদিনের লোমহর্ষক অনেক কাহিনী। পাঠকদের জন্য কয়েকটি তুলে ধরা হল- “আমার প্রথম মনে পড়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার কথা। ১৯৭১ সালের ১০ মে। পথে গুজাদিয়া বাজারে সমমনা বেশ কয়জনকে পেয়ে যাই। তারাও যুদ্ধে যাবে। বয়সের কারণে আমাকে সঙ্গে নিতে আপত্তি তাদের। কিন্তু আমার মনোবল আর জিদের কাছে ওরা হার মানল। পাকসেনাদের সঙ্গে আমরা প্রথম মুখোমুখি হই টেংরাটিলা যুদ্ধে। পরে তেলিখাল আর্মি ক্যাম্পে আক্রমণ করি। প্রায় রাতেই পাকসেনাদের ক্যাম্পে ‘হিট অ্যান্ড রান’ পদ্ধতিতে ‘হ্যারাসিং’ ফায়ার করতাম আমরা। উকলাঘর আর গুজাকাটা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দুর্গম হাওরের পথে পথে শত্র“ সৈন্যের মোকাবেলা করেছি।
প্রায় এক সপ্তাহ হাওরের ওপরে নৌকা চালিয়ে সবাই পরিশ্রান্ত। এক ঘুমেই কেটে যায় রাত। একদিন যখন ঘুম ভাঙল বেশ বেলা হয়েছে। গ্রামের ভেতরে দুই বাড়িতে রান্না হচ্ছে। গ্রামবাসী স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যবস্থা করেছে। হঠাৎ করে ভোঁ... ভোঁ... শব্দ। শোনামাত্র আমরা অস্ত্র হাতে তৈরি। পাকসেনারা কি আমাদের খবর পেয়ে গেল? গ্রামবাসী জানাল, হাওরের পশ্চিম পাশেই সালুটিকর বিমানবন্দর। মাইল পাঁচেক দূরে। মাসে দু-একবার এই পরিবহন বিমান আসে।
বিমানটি আড়াই চক্কর দিয়ে ধীরে ধীরে অবতরণ করছে। এত কাছ দিয়ে উড়ে গেল যে, আমরা দেখতে পেলাম- বিমানের গায়ে লেখা ৩০.। আমি কমান্ডারকে বললাম, বিমানটা গুলি করলে ক্যামুন হয়। তিনি বললেন, নেমে পড়ছে তো। আমি বললাম, আবার তো উঠব।
কমান্ডার ইয়ামিন হিসাব করে দেখলেন, আমাদের সঙ্গে দুটো এলএমজি আছে। কিছু ট্রেসার রাউন্ডও আছে। এছাড়া রাইফেল তো আছেই। প্ল্যান হল- দুটো এলএমজি নিয়ে উকলাঘর বনের ভেতরে প্রায় ২০০ গজ দূরে পজিশন নেবে। দুটো নৌকা থাকবে দুই পাশে। বাঁশ দিয়ে নৌকা বাঁধা হবে আর দুটো বাঁশের ওপরে এলএমজি দুটো আকাশের দিকে মুখ করে বাঁধা হবে। দুই এলএমজির মাঝ বরাবর থাকবে আর একটি নৌকা। এ নৌকায় থাকবে রাইফেল হাতে চারজন। বাকি সবাই প্রায় ৫০০ গজ এলাকাজুড়ে বাঁশঝাড় ও গুজাকাঁটার ঝোপের ভেতরে পজিশন নেবে।
এখন শুধু প্রতীক্ষা। স্নায়ুর ওপরে প্রচণ্ড চাপ। ঠায় বসে আছি সবাই। এমন সময় ভোঁ... ভোঁ শব্দ। পরিবহন বিমানটি হাওরের পশ্চিম কোনায় গ্রামের ওপরে দেখা গেল। নাক বরাবর আসছে বিমানটি। বেশ নিচু দিয়ে। এসে গেছে একেবারে কাছে। শুরু হলো প্রচণ্ড গুলি। প্রচণ্ড শব্দে উড়ে গেল বিমানটি।
বিমানের শব্দ আর বাতাসের বেগে হাওরের বুকে যেন ঝড় উঠল। নৌকার দুলুনিতে গুজাকাঁটার খোঁচা খেয়ে অনেকের শরীর রক্তাক্ত। কিন্তু সবকিছু ভুলে আমরা সবাই তাকিয়ে আছি আকাশের দিকে। কেউ জানে না বিমানে গুলি লেগেছে কিনা। হঠাৎ আকাশে দেখা গেল বিমানের লেজের দিক থেকে চিকন কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে। একটু পরেই চিকন ধোঁয়াটি মোটা কালো ধোঁয়ার রূপ নিল এবং ভকভক করে বেরোতে লাগল। গগনবিদারী ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হল হাওর জনপদ। চক্কর নিয়ে বিমানবন্দরের দিকে মুখ করার চেষ্টা করছে বিমানটি। কিন্তু পারছে না। কাটা ঘুড়ির মতো বিমানটি এদিক-ওদিক দুলছে প্রচণ্ড বেগে। সে দৃশ্য দেখে গ্রাম থেকে ভেসে আসছে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। সালুটিকর বিমানঘাঁটি থেকে পাকসেনারা অজানা শত্র“র উদ্দেশ্যে শুরু করে দিল প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ। বেশ কিছু দূরে হাওরের দক্ষিণ প্রান্তে নাক নিচু করে চাষাজমির মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সেটি।”
ইসমাইল বলেন, ‘দীর্ঘ ৪৩ বছর পর মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচার শুরু হওয়ায় আমি খুশি হয়েছি। কিন্তু সেসব ভয়ংকর মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল নায়কেরা এখনও অধরা থেকে গেছে। এদের সবাইকে বিচারের আওতায় এনে বিচার কাজ সম্পন্ন হলেই আমরা খুশি হব। শহীদদের আত্মাও তৃপ্ত হবে।’

No comments

Powered by Blogger.