দুই কারণে জিহাদের মৃত্যু

পাইপের মধ্যে পানিতে পড়ে মৃত্যু হয়েছে শিশু জিহাদের। গতকাল ফরেনসিক রিপোর্ট হাতে পেয়ে এ তথ্য জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। পাইপে পড়ে মাথায়ও আঘাত পেয়েছিল জিহাদ। এদিকে এলাকাবাসী বিক্ষোভ করতে পারেন- এ আশঙ্কায় সেই রেলওয়ে কলোনিতে লাশ নিতে দেয়া হয়নি। কড়া পুলিশ প্রহরায় লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। লাশ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছার পর এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। নির্মম এ ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের বিচার দাবি করে স্লোগান দেন গ্রামবাসী। এদিকে, শাহজাহানপুরে নিহতের প্রথম জানাজা হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। এজন্য প্রশাসনকে দায়ী করছেন স্থানীয়রা। শেষ পর্যন্ত কঠোর পুলিশ প্রহরায় তার লাশ গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়েছে। তার আগে নিহতের লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। পাইপে পড়ার দুই ঘণ্টার মধ্যেই পানিতে ডুবে জিহাদের মৃত্যু হয়েছে বলে তার লাশের ময়না তদন্তকারী চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। গতকাল সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। ময়না তদন্ত শেষে ফরেনসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. হাবিবুজ্জামান চৌধুরী জানান, জিহাদ মাথায় আঘাত পেয়েছিল। তবে পানিতে পড়েই তার মৃত্যু হয়েছে। পাইপের ভেতরে পড়ার দুই ঘণ্টার মধ্যেই সে মারা যায় বলে তাদের ধারণা। হাবিবুজ্জামান বলেন, আমরা জিহাদের মাথায় আঘাতের চিহ্ন পেয়েছি। তবে আমাদের ধারণা পানিতে ডুবে তার মৃত্যু হয়েছে। পাইপে পড়ার দুই ঘণ্টার মধ্যে তার মৃত্যু হয়েছে। তিনি বলেন, জিহাদ যদি পানিতে পড়ে না যেতো তাহলে হয়তো তাকে বাঁচানো সম্ভব হতো। তিনি জানান, পাইপের ভেতরে পড়ার সময় সে মাথা ও শরীরে আঘাত পেলেও এতে তার মৃত্যু হয়নি। ময়না তদন্তের আগে তিন সদস্যের একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়। বোর্ডের সদস্যরা হলেন ঢামেকের ফরেনসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. হাবিবুজ্জামান চৌধুরী, একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আ খ ম শফিউজ্জামান আবুল খায়ের ও প্রভাষক প্রদীপ কুমার বিশ্বাস। তারাই জিহাদের লাশের ময়না তদন্ত করেন। ময়না তদন্ত শেষে জিহাদের লাশ তার স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তারা লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার নাগেরপাড়া ইউনিয়নের পূর্বেরচর গ্রামের উদ্দেশে যাত্রা করেন। দুপুরে শাহজাহানপুরে রেলওয়ে কলোনির ওই ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে মানুষের ভিড়। সেখানে যাতে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে এজন্য পুলিশ মোতায়েন করা রয়েছে। স্থানীয়রা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, নিহত শিশু জিহাদের প্রথম জানাজা শাহজাহানপুরের রেলওয়ে কলোনির মৈত্রী সংঘের মাঠে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পুলিশের বাধার কারণে তা হয়নি। এ বিষয়ে জিহাদের মামা সালাহউদ্দিন বলেন, বাধার কারণে লাশ শাহজাহানপুরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। বিক্ষোভ এড়াতে কঠোর পুলিশ প্রহরায় লাশটি গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে প্রশাসন। ঘটনাস্থলে পরিত্যক্ত পাইপের পাশে মানুষের ভিড়। পাশে এ রকম আরও অনেক পাইপ। উন্মুক্ত এসব পাইপের উপরে পাথর রেখে তা ঢেকে রাখা হয়েছে। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, রেলওয়ের দায়সারা কাজের কারণে পাইপগুলো এ অবস্থায় পড়ে আছে। জিহাদের মৃত্যুর পরও তাদের টনক নড়েনি। যে কারণে পাশের পরিত্যক্ত পাইপগুলো উন্মুক্ত অবস্থায় আছে। জিহাদের মৃত্যুর পর আতঙ্কে আছেন আশপাশের বাসিন্দারা। ঘটনাস্থলের পাশেই ৪১ নম্বর রেলওয়ের কলোনির দ্বিতীয় তলায় মা, বাবা ও ভাইবোনের সঙ্গে থাকতো জিহাদ। সেখানে গেলে কথা হয় একই বাসার বাসিন্দা ফাতেমা বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, জিহাদের জন্য বই কিনেছিলেন তার পিতা নাসির ফকির। জিহাদ ছিল মেধাবী। স্কুলে যাওয়ার বয়স না হলেও বাসায় সে লেখাপড়া করতো। ছড়া, কবিতা পড়তো সে। চঞ্চল জিহাদ পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখতো। জিহাদের এমন মৃত্যু তারা কেউ মেনে নিতে পারছেন না।
জিহাদের মৃত্যুতে মামলা: জিহাদের মৃত্যুর ঘটনায় দু’জনকে আসামি করে মামলা করেছেন তার পিতা নাসির ফকির। মামলার দুই আসামি হচ্ছেন শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনিতে পানির পাম্প বসানোর দায়িত্বে থাকা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান জেএসআর-এর মালিক আবদুস সালাম এবং রেলওয়ের জ্যেষ্ঠ উপসহকারী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম। মামলায় আরও সাত-আটজনকে আসামি করা হয়েছে। ফৌজদারি আইনে করা এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলায় জিহাদের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। শাহজাহানপুর থানার উপপরিদর্শক মাসুদ রানা জানান, গতকাল রাত ১টায় জিহাদের পিতা নাসির ফকির এ মামলা করেন। গত শুক্রবার বিকালে পাইপে জিহাদ পড়ে যাওয়ার পর রাতেই ওই প্রকল্পের কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলমকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। সেই সঙ্গে গভীর নলকূপ স্থাপন প্রকল্পের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মেসার্স এসআর হাউজকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়।
ব্যর্থতা তদন্তে হাইকোর্টে রিট: শিশু জিহাদের জীবিত উদ্ধারের ঘটনায় সরকারি সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা তদন্তে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়েছে। রিট আবেদনে শিশু জিহাদের পরিবারের জন্য আর্থিক ক্ষতিপূরণের ঘোষণা চাওয়া হয়েছে। কমিটিতে জিহাদের মরদেহ উদ্ধারকারী স্বেচ্ছাসেবী লোকদেরও অন্তর্ভুক্ত করার আবেদন জানানো হয়েছে। গঠিত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে জিহাদকে উদ্ধারে গাফিলতিতে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও চাওয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাইনুল হকের পক্ষে ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল গতকাল এ রিট আবেদন করেন। রিট আবেদনে জিহাদের পিতাকে ১২ ঘণ্টা পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ঘটনায় দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের আইজি ও ডিএমপি কমিশনারকে নির্দেশ দিতে আদালতের প্রতি নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীর যে সব এলাকায় ম্যানহোলের ঢাকনা নেই সেগুলো দ্রুত স্থাপনের জন্য ডিসিসি ও ওয়াসাকে নির্দেশ দিতে আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
লাশ দাফন
শরীয়তপুর প্রতিনিধি জানান, বিকাল সোয়া ৫টায় নাগেরপাড়া বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নিহত জিহাদের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে পূর্বেরচর নিজ বাড়িতে তার লাশ দাফন করা হয়। তার আগে গতকাল সকাল থেকেই সাদা পোশাকের দু’জন পুলিশ আক্কেল আলী ও মিজানুর রহমান জিহাদদের বাড়িতে অবস্থান করে। সকাল থেকে নাগেরপাড়া বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাইকিং করে জিহাদের লাশ আসার খবর জানিয়ে দেয়া হয়। লাশ পৌঁছানোর পর স্থানীয়রা দোষীদের বিচার দাবি করে বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভের কারণে তাড়াহুড়া করে জিহাদের লাশ দাফন করা হয়। মাইক্রোযোগে জিহাদের লাশ পূর্বেরচর গ্রামে পৌঁছে বিকাল ৫টায়। তার আগে নিহতের লাশ ডামুড্যা উপজেলার সিধলকুড়া গ্রামে তার নানাবাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কিছু সময় রাখার পর লাশ তাদের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। লাশ নিয়ে বাড়ি পৌঁছানোর পর হাজার হাজার উৎসুক জনতা জিহাদকে এক নজর দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন। শিশু জিহাদের মৃত্যুর ঘটনায় স্থানীয়রা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। জিহাদের দাদা আবদুল আজিজ ফকির ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকারের সদিচ্ছা থাকলে আমার নাতিকে জীবিত উদ্ধার করা যেতো। জিহাদের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশ জিহাদের পিতা ও তার পরিবারকে হয়রানি করেছে। আমি এর বিচার চাই। সেখানে শুরু হয় শোকের মাতম। জেলা প্রশাসক রামচন্দ্র দাস, সহকারী পুলিশ সুপার সুমন দেব, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুন্নাহার বেগম ওসি মোফাজ্জেল হোসেনসহ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং হাজার হাজার লোকজন এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান জিহাদের পিতা নাসির ফকির ১০ বছর আগে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে শরীয়তপুর থেকে ঢাকায় আসেন। তিনি মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের একজন প্রহরী। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকতেন শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনিতে। নাসির ফকিরের  তিন সন্তানের মধ্যে জিহাদ ছিল সবার ছোট। জিহাদের বড়বোন স্বর্ণা ঢাকার একটি স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত। মেজ সন্তান জিসান এখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি। শনিবার বিকালে ঢাকার শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির মৈত্রী সংঘ মাঠের পাশে ওয়াসার পরিত্যক্ত পানির পাম্পের পাইপের ৬০০ ফুট গভীরে পড়ে যায় চার বছরের শিশু জিহাদ। খবর পেয়ে উদ্ধার অভিযান শুরু করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। দীর্ঘ ২৩ ঘণ্টা শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে ব্যর্থ হওয়ার পর শনিবার বিকাল ৩টায় স্থানীয় স্বেচ্ছাবেকরা পাইপের ভেতর থেকে জিহাদের নিথর দেহ উদ্ধার করেন।
সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে: নির্যাতন নয় বরং সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে জিহাদের পিতা নাসির ফকিরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার। তিনি বলেন, নাসির ফকিরকে সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আন্তরিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে যদি কোন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, তাহলে তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে। গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জঙ্গিবিরোধী বিষয়ক এক সভা শেষে তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। এ সময় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন। প্রতিমন্ত্রী আইজিপি’র বক্তব্যে একমত পোষণ করে বলেন, যদি নাসির ফকিরকে আটক করে নির্যাতন করা হয়, তবে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। ১২ ঘণ্টা ধরে জিহাদের পিতাকে আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করার কারণ জানতে চাইলে আইজিপি বলেন, যখন শিশু জিহাদকে পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন খোঁজখবর নেয়ার জন্য তার পিতা নাসির ফকিরকে থানায় নিয়ে রহস্য উন্মোচনের জন্য আন্তরিকতাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, পুরো বিষয়েই আন্তরিক ছিলাম। আন্তরিক ছিলাম বলেই সারারাত বসেছিলাম। ভেবেছি, বসে থাকলে উদ্ধার কাজটি দ্রুত হবে।

No comments

Powered by Blogger.