রাজনীতিবিদদের ব্যাংক হিসাব তদারকির নির্দেশ

ব্যাংকিং খাতে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন প্রতিরোধে রাজনৈতিকভাবে আলোচিত ব্যক্তি যেমন- রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান, উচ্চ পর্যায়ের রাজনীতিবিদ, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, বিচার ও সশস্ত্র বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ব্যাংক হিসাব তদারকি করতে হবে নিয়মিত। ব্যাংকের উপযুক্ত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে এই ধরনের ব্যক্তিদের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপন বা ব্যাংক হিসাব খুলতে হবে। রোববার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটি সার্কুলার জারির মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ওই দিনই সার্কুলারটি বাংলাদেশে কার্যরত সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) কাছে পাঠানো হয়েছে। একই সার্কুলার অচিরেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন বাস্তবায়ন ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন প্রতিরোধে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিধিবিধানের সমন্বয় করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এই সার্কুলার জারি করা হয়েছে। এতে রাজনৈতিকভাবে আলোচিত ব্যক্তি, প্রভাবশালী ব্যক্তি ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে বেশ কিছু নতুন বিধিবিধান সংশোধন করা হয়েছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন প্রতিরোধ আইনের আগের বিষয়গুলোও এতে রাখা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিকভাবে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে কাজ করছে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স (এফএটিএফ)। তারা মনে করে, উল্লেখিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে দেশ থেকে মুদ্রা পাচার বা মানি লন্ডারিংয়ের মতো ঘটনাগুলো ঘটতে পারে। এ কারণে ওইসব ব্যক্তিদের মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়নের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ওই সংস্থা থেকে এসব পর্যায়ের ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাব ও সম্পদ নিবিড়ভাবে তদারকি করার নির্দেশনা রয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ওইসব সংস্থার সদস্য সে কারণে এসব নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে। এটা করা না হলে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে এদের সঙ্গে কাজ করা সম্ভব হবে না।
সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠকে ওইসব ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাব বিশেষভাবে তদারকির সিদ্ধান্ত হয়েছে। সার্কুলারে সব ধরনের ব্যাংক হিসাব খোলার ক্ষেত্রে অর্থের উৎস জানানোর বিধান করা হয়েছে। রাজনৈতিক ভাবে আলোচিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাব পরিচালনার ব্যাপারে ব্যাংকগুলোকে বাড়তি কিছু দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এতে বলা হয়, ব্যাংকের গ্রাহক বা হিসাবের প্রকৃত সুবিধাভোগী রাজনৈতিকভাবে আলোচিত ব্যক্তি কিনা তা নির্ধারণের জন্য ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। ব্যাংকের উপযুক্ত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না নিয়ে এই ধরনের ব্যক্তিদের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপন বা হিসাব খোলা যাবে না। রাজনৈতিকভাবে আলোচিত কোনো ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবের অর্থ বা সম্পদের উৎস জানার জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাদের হিসাবের লেনদেন নিয়মিতভাবে তদারকি করতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইনের আওতায় অনিবাসীদের হিসাব খোলার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধিবিধানগুলোও এই ক্ষেত্রে পালন করতে হবে।
সার্কুলারে রাজনৈতিকভাবে আলোচিত ব্যক্তির একটি তালিকাও দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান, সিনিয়র রাজনীতিবিদ, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, বিচার বিভাগ ও সশস্ত্র বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, সরকারি কর্পোরেশনগুলোর সিনিয়র নির্বাহী এবং গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলের কর্মকর্তারা। দেশের প্রভাবশালী ব্যক্তি বলতেও এদের বোঝাবে। এদের পরিবারের সদস্য ও তাদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত ব্যক্তির ক্ষেত্রেও এসব নির্দেশনা প্রযোজ্য হবে। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী বলতে কোনো মধ্যম বা অধস্তন পর্যায়ের ব্যক্তি বিবেচিত হবেন না। কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান ও উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ব্যাংক হিসাব পরিচালনার ক্ষেত্রেও ওইসব বিধান মেনে চলতে হবে। আন্তর্জাতিক সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলতে বোঝাবে- ব্যবস্থাপনা পর্যায়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, পরিচালক, উপ-পরিচালক এবং পর্ষদের সমকক্ষ এমন সদস্য।
সার্কুলারে বলা হয়, ব্যাংকগুলোকে এখন থেকে এই নীতিমালা মেনে চলতে হবে। মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড, দেশে বিদ্যমান আইন, বিধিমালা, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) নির্দেশাবলীর সমন্বয়ে প্রতিটি ব্যাংকের একটি নিজস্ব নীতিমালা থাকবে। এটি ব্যাংকের পর্ষদ বা সর্বোচ্চ ব্যবস্থাপনা কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে। ওই নীতিমালা সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানাতে হবে। ব্যাংকের এমডিকে বছরে একবার ব্যাংকের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতিতে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধের ব্যাপারে অঙ্গীকার করতে হবে। প্রতিটি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কেন্দ্রীয় পরিপালন ইউনিট স্থাপন করতে হবে। কমিটিতে শাখা পর্যায়ে একজন পরিচালক কর্মকর্তা থাকতে হবে। সার্কুলারে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রেও ঝুঁকির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ কারণে এসব লেনদেনের ক্ষেত্রেও ব্যাংকগুলোকে গ্রাহকের তথ্য সংরক্ষণ করার নির্দেশ দিয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.