চেনা পথেই হাঁটছে সরকার by কাজী সুমন



বিরোধী জোটের সম্ভাব্য আন্দোলন কর্মসূচি দমনে  চেনা পথেই হাঁটছে সরকার। আন্দোলন দমনে সরকার কৌশলে আইনি অস্ত্র প্রয়োগ করছে বলে মনে করছেন বিরোধী জোটের নেতারা। গত ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের আগে আন্দোলন মোকাবিলায় সরকার যে কৌশল নিয়েছিল এবারও সরকারের বছরপূর্তি সামনে রেখে বিরোধী জোটের আন্দোলন মোকাবিলায় একই কৌশল নেয়া হয়েছে বলে বিরোধী নেতারা মনে করছেন। এর অংশ হিসেবে দেশব্যাপী শুরু হয়েছে ব্যাপক ধরপাকড়। প্রতি রাতেই সাঁড়াশি অভিযান চালানো হচ্ছে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনসহ ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের বাসায়। মামলার জালে আটকে দেয়া হচ্ছে সিনিয়র নেতা ও নির্বাচিত মেয়রদের। গ্রেপ্তারের পর নেয়া হচ্ছে রিমান্ডেও। প্রতিদিন কোন না কোন মামলায় নতুন চার্জশিট দেয়া হচ্ছে। গ্রেপ্তার এড়াতে ইতিমধ্যেই কৌশলী অবস্থান নিয়েছেন সিনিয়র নেতারা। যদিও বিরোধী জোটের নেতারা জানিয়েছেন, সরকার পুরনো কৌশলে এগোলেও বিরোধী জোটের আন্দোলন স্তব্ধ করতে পারবে না। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি জনসভায় দেয়া বক্তৃতায় ডিসেম্বরের পরই সরকার পতন আন্দোলনের যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন ২০ দলীয় জোটের শীর্ষনেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। কিন্তু গত ১৫ই ডিসেম্বর লন্ডনে বিজয় দিবসের একটি আলোচনা সভায় বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান বঙ্গবন্ধুকে কটাক্ষ্য করেছেন অভিযোগ করে পরদিন থেকেই তার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের হতে থাকে। ১৮ই ডিসেম্বর থেকে ২৮শে ডিসেম্বর পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে অন্তত ৬০টির বেশি মানহানি ও রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি মামলায় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়। ২৪শে ডিসেম্বর ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার আদালতে হাজিরা দেয়াকে কেন্দ্র করে বকশীবাজারে জড়ো হওয়া বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ ও পুলিশ। এ ঘটনায় বিএনপির অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত হলেও উল্টো তাদের বিরুদ্ধেই দুটি মামলা দায়ের করে পুলিশ। মামলায় আসামি করা হয় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল আওয়াল মিন্টু, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি ও ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেল, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আজিজুল বারী হেলাল, বর্তমান সভাপতি রাজীব আহসান, সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসানসহ দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে। এরপর ২৬শে ডিসেম্বর ভোররাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও ২৭শে ডিসেম্বর মধ্যরাতে যুবদল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাদের রিমান্ডেও পাঠানো হয়। একই রাতে আদাবর থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি জামাল হোসেন ও তার ছেলে আসকারী, খিলগাঁও বিএনপির সহ-সভাপতি ফরহাদ হোসেন, বরিশালের স্বেচ্ছাসেবক দলের হাবিবুর রহমান পিন্টু, পটুয়াখালীর শাহাবুদ্দিন, আহসান উল্লাহ পিন্টু, শাহজাহান হাওলাদারকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদিকে বঙ্গবন্ধুকে কটূক্তি করে দেয়া বক্তব্যের জন্য তারেক রহমান ক্ষমা না চাইলে ২৭শে ডিসেম্বর গাজীপুরে খালেদা জিয়ার জনসভা প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছিল ছাত্রলীগ। জনসভা সফল করার সব প্রস্তুতি নেয় বিএনপিও। নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে।  পাল্টাপাল্টি জনসভাকে ঘিরে গত ২৬শে ডিসেম্বর গাজীপুর জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। জনসভা করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে বিএনপি। জনসভা করতে না দেয়ার প্রতিবাদে ২৭শে ডিসেম্বর গাজীপুর জেলায় হরতাল ও সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি বিক্ষোভ কর্মসূচি এবং ২৯শে ডিসেম্বর দেশব্যাপী হরতালের ডাক দেয় ২০ দল। হরতাল কর্মসূচি ঘোষণার পর শুক্রবার রাতেই দুর্বৃত্তরা পুড়িয়ে দেয় গাজীপুরের টঙ্গী থানা বিএনপি কার্যালয়, ভাঙচুর করা হয় বগুড়া জেলা বিএনপি কার্যালয়। এর আগের দিন জ্বালিয়ে দেয়া হয় নেত্রকোনা জেলা বিএনপি কার্যালয়। এরপর হরতালের দিন গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগে গাজীপুর সিটি মেয়র অধ্যাপক এমএ মান্নান ও জেলা বিএনপির সভাপতি ফজলুল হক মিলনসহ ৭৫ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়।  এসব ঘটনায় গত চারদিন ধরে পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান চলছে দেশব্যাপী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ অভিযানে দেশের বিভিন্ন জেলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে অন্তত কয়েক শতাধিক বিএনপি নেতাকর্মীকে। তল্লাশি চালানো হয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগরের আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস, সদস্য সচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক শফিউল বারী বাবু, যুবদল ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক এসএম জাহাঙ্গীর, পল্লবী থানা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক তানভীর আহমেদ, শ্যামপুর থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম, রূপনগর থানা বিএনপি নেতা হাবিবুর রহমান, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হাসান উদ্দিন সরকার ও শ্রমিক দলের গাজীপুর জেলা সভাপতি সালাউদ্দিন সরকার, গাজীপুরের জেলা বিএনপির সিনিয়র সাধারণ সম্পাদক ডা. মাজহারুল আলম মণ্ডল, স্বনির্ভর বিষয়ক সম্পাদক জয়নাল আবেদিন তালুকদার, জেলা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোকলেসুর রহমান, সদর থানা বিএনপির নির্বাহী সদস্য আলাউদ্দিন চৌধুরী ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর তানভীর আহমেদের বাসায়। প্রতিরাতেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তল্লাশিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সিনিয়র নেতাদের মধ্যে। গ্রেপ্তার এড়াতে বিএনপির বেশির ভাগ সিনিয়র নেতা কৌশলে অবস্থান করছেন। এদিকে কয়েকদিন আগে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলায় সম্পূরক চার্জশিট দেয়া হয়েছে সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ও হবিগঞ্জ পৌর মেয়র জি কে গউছসহ ১১ বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে। গতকাল হবিগঞ্জ জেলা আদালতে আত্মসমর্পণ করলে  জি কে গউছের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানো হয়। এসময় বিএনপি নেতাদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থল থেকে ৮ বিএনপি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া গতকাল সিলেট মহানগর জামায়াতের আমীর এহসানুল মাহবুব জুবায়েরকে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত। সম্প্রতি রাজধানীতে একটি আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগ নেতা ও খাদ্যমন্ত্রী এড. কামরুল ইসলাম বলেছেন, বিএনপির একজন নেতাকে গ্রেপ্তারের পরই দলের সিনিয়র নেতারা ডিপফ্রিজে চলে গেছে। আর কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করলে পুরো বিএনপিই ডিপফ্রিজে চলে যাবে। ওদিকে যে কোন মূল্যে গাজীপুরের জনসভা করার ঘোষণা দিয়ে সরকারের বাধার মুখে সরে আসায় হতাশ হয়েছেন বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে তারা এ হতাশা ব্যক্ত করেন। এদিকে সামনে বিরোধী জোটের সভা সমাবেশের ওপর আইনি অস্ত্র প্রয়োগ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। গাজীপুরের সমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর তিনি জানিয়েছেন, খালেদা জিয়াকে দেশের কোথাও আর সমাবেশ করতে দেয়া হবে না। একই ঘোষণা দিয়ে রেখেছে ছাত্রলীগ। এদিকে বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় প্রতি কার্যদিবসেই নেতাদের কোন না কোন মামলায় হাজিরা দিতে হচ্ছে। মামলা-গ্রেপ্তার দিয়ে আন্দোলন দমনে সরকারের পুরনো কৌশল সম্পর্কে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মানবজমিনকে বলেন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমন করার জন্য সব স্বৈরাচার সরকারই নির্যাতন-নিপীড়ন করে। আর এই সরকার তো অবৈধ। তারা অবৈধ ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া হয়েই নির্যাতন-নিপীড়ন করছে। কিন্তু এদেশের মানুষ গণতন্ত্রের জন্য সবসময় সংগ্রাম করেছে। এই সরকারের নিপীড়ন-নির্যাতনে জনগণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে পিছপা হবে না। আগামীতে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তারা তাদের ভোটের অধিকার আদায় করবে। এদিকে বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ অভিযোগ করেন, আন্দোলনের সামান্য আওয়াজেই পতনের ভয়ে টলমল করতে শুরু করেছে সরকার। সেজন্যই নির্দয় দমন-পীড়নের পুরনো কৌশলই নিয়েছে। আন্দোলন দমন করতেই গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত রেখেছে তারা। ওদিকে রাজধানীর বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ডের ছাত্রদলের নেতাদের বাসায় পুলিশি তল্লাশির অভিযোগ করেছেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি রাজীব আহসান।

No comments

Powered by Blogger.