উদ্ধারে দৈন্যদশা by নুরুজ্জামান লাবু

একেবারেই দৈন্যদশা। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাব। নেই কোন সমন্বয়। দক্ষতা নেই সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার। মিডিয়ার বাড়াবাড়িও চোখে পড়ার মতো। যার যার মতো করে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা। আবেগ দিয়ে পরিচালিত হয় অনেক কিছুই। বড় ধরনের কোন দুর্যোগের মুহূর্তে এ হাল আমাদের উদ্ধারকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর। সর্বশেষ রাজধানী ঢাকার শাজাহানপুরের একটি গভীর নলকূপের পাইপের ভেতরে পড়ে যাওয়া শিশুকে উদ্ধারে এই দৈন্যদশা প্রত্যক্ষ করা গেছে। এর আগে রানাপ্লাজা ধসসহ বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ড ও অন্যান্য দুর্যোগেও এমন দৃশ্য দেখা গেছে বহুবার। কিন্তু অবস্থার উন্নতি হয়নি এতটুকু। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্যোগ মোকাবিলায় আরও বেশি কৌশলী হতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। আধুনিক যন্ত্রপাতি মজুত করতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে দুর্যোগ মোকাবিলায় অনেক বেশি বেগ পেতে হবে। পাশাপাশি মানবসৃষ্ট দুর্যোগ যতটা পারা যায় কমিয়ে আনতে হবে। এজন্য মানুষকে সচেতন করার কোন বিকল্প নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজেস্টার মেনেজমেন্টের পরিচালক ড. মাহবুবা নাসরীন বলেন, আমরা আসলে পূর্বের কোন ঘটনা থেকে কোন শিক্ষাই নেই না। তা না হলে কিছুদিন আগে রানা প্লাজার মতো এত বড় ঘটনার পরও শাজাহানপুরের ঘটনায় বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয় দেখা যায়নি। এছাড়া কমিউনিটিরও একটি দায়িত্ব থাকে যে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ যেন না ঘটে তার জন্য আগে থেকেই সতর্ক থাকা। তিনি বলেন, দুর্যোগের পর কোনভাবেই প্রশিক্ষিত নয় এমন কাউকে দিয়ে উদ্ধার কাজ করানো উচিত নয়, তাহলে লাভের চেয়ে অনেক সময় ক্ষতি হয়ে যায়। বিশেজ্ঞরা বলছেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ের কথা সবসময়ই বলা হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় না। দেশের বেশির ভাগ দুযর্গ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কাজ করে ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিসে আরও বেশি প্রশিক্ষিত লোকবল ও যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে প্রস্তুত রাখা উচিত। একই সঙ্গে যেহেতু ফায়ার সার্ভিসের লোকজন বেশির ভাগ দুর্যোগে উদ্ধার তৎপরতা চালায়, এজন্য তাদের সঙ্গে অন্য সবার যথাযথ সমন্বয় থাকা উচিত। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সমন্বয়হীনতা দেখা যায়। পূর্বের বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রানা প্লাজা ধসের সময়ও দেখা গেছে কৌতূহলী মানুষের ভিড় সঠিকভাবে সামলাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এমনকি প্রশিক্ষিত নয়, এমন লোকজন কাজের চাইতে উদ্ধারে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। বড় দুর্যোগে স্বেচ্ছাসেবকদের কাজে লাগাতে হবে তা তা সঠিক উপায়ে। যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ঘটনা-দুর্ঘটনা বা দুর্যোগে মিডিয়া তা কভার করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এমনভাবে তা কভার করতে হবে যাতে উদ্ধার তৎপরাতায় কোন বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। নির্দিষ্ট দূরুত্বে থেকে সম্প্রচার করতে হবে। বিভিন্ন দেশের দুর্যোগ উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলেন, দুর্যোগে উদ্ধারকাজে ব্যাঘাত ঘটে এমন স্থানে মিডিয়াকে কোনভাবেই প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। এছাড়া একজন মুখপাত্র ঠিক করে দিতে হবে যিনি ঘণ্টায় ঘণ্টায় উদ্ধার তৎপরতার অগ্রগতি কৌতূহলী মানুষ ও মিডিয়াকে জানাবেন। শাজাহানপুরের পাইপের ভেতরে পড়ে যাওয়া শিশুটিকে তুলতে ফায়ার সার্ভিসের ব্যর্থতা উল্লেখ করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্টরা বলেন, ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ এই ক্ষেত্রে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় রেখে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে রিবন দিয়ে সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা উচিত ছিল। যারা প্রকৃতই এসব কাজে দক্ষতাসম্পন্ন  তাদের কেবল ফায়ারের সঙ্গে কাজে সহযোগী হিসেবে নেয়া যেতে পারে। সংশ্লিষ্টরা বলেন, ফায়ার সার্ভিসেরও দুর্ঘটনায় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত ও সমন্বয়ের অভাব দেখা গেছে। তারা প্রকৌশলী কিংবা কনস্ট্রাকশনের কাজ করেছে এমন লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। এমনকি  শিশুটিকে উদ্ধারে কারা নেতৃত্ব দিচ্ছে তা বোঝা যায়নি। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদেরও নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে উদ্ধার তৎপরতা মনিটরিং করা উচিত ছিল। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, রাজনৈতিক নেতার তাদের দলবল নিয়ে ঘটনার এত নিকটে চলে যান যে, তাদের জন্যও উদ্ধার কাজ ব্যাহত হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অন্যতম বাধা হলো সাধারণ মানুষের ভিড়। কৌতূহলী মানুষের ভিড়ের কারণে অনেক সময় উদ্ধার সরঞ্জামাদি যথাস্থানে পৌঁছানো বা উদ্ধার কাজে ব্যাঘাত ঘটে। ঘটনার পরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেও তাদের দায়সারা দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। উল্টো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্যই কৌতূহলী জনতার মতো আচরণ করে থাকে। পুলিশের সাবেক মহাপদিরর্শক মোহাম্মদ নূরুল হুদা বলছিলেন, এটা প্রফেশনালিজমের অভাব। যদি এটা করা যায় যে, কোন ঘটনার পরপরই তার চারপাশে যথেষ্ট পরিমাণ জায়গা রেখে রিবন দিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে রাখা যায়, তাহলে উদ্ধার তৎপরতায় গতি আসে। উদ্ধারকর্মীরা নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারেন। এটা চালু করতে পারলে ধীরে ধীরে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে যাবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বেশির ভাগ লোকজনের আসলে কাজকর্ম নেই। কৌতূহলও বেশি। তাই কোন ঘটনা-দুর্ঘটনা দেখলেই দাঁড়িয়ে পড়ে। অন্য  দেশে সাধারণত এমনটি দেখা যায় না।

No comments

Powered by Blogger.