শিক্ষা- উষ্মা নয়, সঠিক পদক্ষেপ চাই by আবুল মোমেন

দেশের শিক্ষার মান নিয়ে শিক্ষিত সমাজের চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠাকে আমি একটি আশাব্যঞ্জক বিষয় বলে মনে করি। এতে সরকারপ্রধান এবং স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী, যিনি বিনয় ও পরমতসহিষ্ণুতার জন্য উচ্চ ভাবমূর্তির অধিকারী, তিনিও কড়া ভাষায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন এবং চলমান ব্যবস্থার সপক্ষে জোরালো সমর্থন ও সন্তুষ্টি ব্যক্ত করেছেন। তবু আশা করব, শিক্ষা নিয়ে দেশের চিন্তাবিদদের সঙ্গে সরকারের বিপরীতমুখী অবস্থান সাময়িক এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তা কেটে যাবে।

অপ্রাসঙ্গিক হবে না মনে করে ব্যক্তিগত কথা তুলছি। ১৯৭৫ সালের রক্তাক্ত ঘটনাবলি আমার আবেগ ও চিন্তার জগতে প্রচণ্ড নাড়া দেয়। মনে হলো ১৯৬২ থেকে রাজপথে যে স্লোগান দিয়ে এসেছি ‘শিক্ষাব্যবস্থা পাল্টাতে হবে’—পাল্টা ব্যবস্থা নিয়ে কি কেউ কাজ করেছি? এ জিজ্ঞাসার উত্তর জানা ছিল না। মূলত তখনকার দমবন্ধ করা পরিবেশ থেকে মুক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে এবং মনের গভীরে উঁকি দেওয়া প্রশ্নটিতে চিন্তার ঘুরপাক নিয়েই কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে শিশুদের জন্য কাজ শুরু করি সেই পঁচাত্তরের শেষ দিক থেকে। পরে ১৯৮০ সালে ফুলকির শাখা হিসেবে সহজপাঠ নামে প্রাথমিক স্কুল চালু করি। সেই থেকে এই কাজে যুক্ত আছি। তখন থেকে মনে আশা ও বিশ্বাস ছিল, কোনো দিন সমমনা কোনো সরকার এলে আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে পরামর্শ দেওয়া যাবে, যেন অন্তত প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে কিছু তৈরি-দৃষ্টান্ত তাঁরা পেতে পারেন।
২.
শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, সমালোচনা নয় পরামর্শ থাকলে তা নিয়ে হাজির হোন। আমাদের মনের সুপ্ত বাসনার কারণে আমরা আওয়ামী লীগের প্রথম আমল থেকেই যোগাযোগের বিষয়ে সচেষ্ট হই। আর দ্বিতীয় পর্বে নাহিদকে শিক্ষামন্ত্রী পেয়ে সবাই খুবই আশান্বিত হয়ে উঠি। তাঁর সঙ্গে দাপ্তরিক যোগাযোগ, প্রস্তাবসহ আবেদন প্রদান, ব্যক্তিগত একান্ত আলাপ ইত্যাদি সবই হয়েছে। কেবল তাঁর সঙ্গে নয়, সরকারি মহলে আরও অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ হয়েছে। সত্যি বলতে কি, একমাত্র সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীকেই পেয়েছি নতুন পরামর্শ বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে।
শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় হয়তো বলবেন তাঁর অসংখ্য ভালো কাজ এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। না, সেগুলো আমার নজরে ও বিবেচনায় আছে এবং বারবার সেগুলোর কথা বলেছি। কিন্তু এসব পরিবর্তনের সীমাবদ্ধতা না বুঝলে শিক্ষার আসল লক্ষ্য আমাদের জন্য অধরা থেকে যাবে।
প্রাথমিকে শতভাগ ভর্তি, বছরের প্রথম দিনে সবার জন্য বিনা মূল্যে বই, চমকপ্রদ ফলাফল সত্ত্বেও বলব শিক্ষার শেষ বিচার তো হলো ছাত্র কী শিখেছে। আমি প্রাক-প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত প্রতিটি শ্রেণিতে পাঠদানের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি উচ্চপর্যায়ের যে চিত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা কাবেরী গায়েন তুলে ধরেছেন, তাতে কোনো অতিরঞ্জন নেই।
সমাধানের পরামর্শ দিতে ও নিতে হলে সমস্যাগুলো ঠিকভাবে শনাক্ত করতে হবে। আমার বরাবর মনে হয়েছে, সমাধানের জন্য যেসব মৌলিক কাজ (পরিবর্তন) হওয়া দরকার তা বুঝলেও বর্তমান সরকারও তাতে হাত দিতে সাহস পাচ্ছে না। এ কথা বললে আশা করি সজ্জন সার্থক (পূর্ববর্তী শিক্ষামন্ত্রীদের তুলনায়) নাহিদ ভাইয়ের অবদানকে খাটো করা হবে না যে তাঁর আমলে শিক্ষায় ব্যাপকভাবে পরিমাণগত উন্নতি হয়েছে। কিন্তু শিক্ষা আদতে চর্চার মাধ্যমে অর্জনের বিষয়, যা শিক্ষক-ছাত্রের শ্রেণিকক্ষের যথার্থ ভূমিকায় সাধিত হয়। এ বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে গেছে। আগের লেখায় বলেছিলাম (১২.০৯.২০১৪) পুরো ব্যবস্থাটা পুরোমাত্রায় পরীক্ষাকেন্দ্রিক হয়ে পড়ায় শৈশব থেকেই একজন শিশু শিক্ষার্থী না হয়ে পরীক্ষার্থীতে পরিণত হচ্ছে। সফল পরীক্ষার্থী তৈরির কারখানায় সচেতন শিক্ষার্থী তৈরি হতে পারছে না। এখানেই সমস্যার শিকড়।
৩.
এ আলোচনা স্কুল-শিক্ষার মধ্যে সীমিত রেখে চটজলদি চলমান ব্যবস্থার সমস্যা বা চ্যালেঞ্জগুলো মনে করে নিতে পারি:
দরিদ্র দেশে স্কুলগামী শিশুর বিপুল সংখ্যা—প্রায় চার কোটি।
শিক্ষার মাধ্যমের ভিত্তিতে স্কুল পর্যায়েই শিশুদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি। (মাদ্রাসা ধরে আদতে ত্রিধাবিভক্তি)
বিভিন্ন ধারার শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দে ব্যাপক তারতম্যের প্রভাবে শিক্ষার একাডেমিক ও সামাজিক উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাপকভাবে বৈষম্য সৃষ্ট হচ্ছে।
পেশা হিসেবে স্কুল শিক্ষকতার মর্যাদা ও আকর্ষণ কমে যাওয়ায় মেধাবী, মননশীল, ব্রতী তরুণেরা এ পেশায় আসছেন না।
•বিপুল ছাত্রকে সীমিত অবকাঠামোয় ধারণ করতে গিয়ে শিক্ষার বহু রকম সংকোচন ঘটেছে—স্কুল সময়ের স্বল্পতা, বড় আকারের শ্রেণিকক্ষে ছাত্র-শিক্ষক সংযোগের ঘাটতি, পরীক্ষার প্রস্তুতির বাইরে অন্য বিষয়কে উপেক্ষা, পরীক্ষার প্রাধান্য ও চাপে স্কুল ছাপিয়ে কোচিং সেন্টারের গুরুত্ব বৃদ্ধি, মুখস্থবিদ্যার প্রবণতা ইত্যাদি।
স্কুল-শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের মূল লক্ষ্য সম্পর্কে সরকারি-বেসরকারি সব মহলে বিভ্রান্তি।
৪.
সমাধানের প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বলা দরকার, বর্তমান সরকার পরিস্থিতির উন্নয়নের বিষয়ে সচেতন বলেই মনে করি এবং সে লক্ষ্যে নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়নসহ নানা রকম উদ্যোগ আয়োজনও চলছে। কিন্তু মূল ব্যাধি নিরাময়ে যে প্রায় বৈপ্লবিক কার্যক্রম প্রয়োজন তা নিতে দ্বিধান্বিত থাকছে। ফলে এ অনেকটা যোগাযোগমন্ত্রীর সড়ক মেরামতি কাজের মতো ফল দিচ্ছে। দুই টাকার কাজে দেড় টাকা
খরচ করলে ফল পাওয়া যায় না, ব্যয়িত দেড় টাকাই বরবাদ হয়।
এবার কাজের কথায় আসা যাক। বলে রাখা ভালো, দৈনিকের পাতায় বিস্তারিত লেখার সুযোগ নেই, সংক্ষেপে কিছু লেখা যায়।
শিক্ষা সংস্কারের কাজটি যেহেতু হবে মৌলিক ও বিপুল, তাই এর পক্ষে বিশেষজ্ঞসহ নাগরিকদের গরিষ্ঠাংশের ঐকমত্য তৈরির কাজটি প্রথম করণীয়। এটি রাজনৈতিক অঙ্গীকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়।
সমাজমানস এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে সবার জন্য মাতৃভাষাকে স্কুল শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাধ্যতামূলক করার মতো বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত এখনই নেওয়া সম্ভব হবে না। তবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এ পর্যায়ে ফেরার জন্য মূলধারার বাংলামাধ্যম স্কুলে আগের মতো দক্ষতার সঙ্গে ইংরেজি শেখার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
বর্তমানে মুখস্থবিদ্যার দৌরাত্ম্যে এবং বাণিজ্যিক বিষয়ের প্রতি সবার আগ্রহাতিশয্যের ফলে আধুনিক মানসগঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানশিক্ষা কাঙ্ক্ষিত মানে হতে পারছে না। হাতে-কলমে শেখার ব্যবস্থাসহ এর খোলনলচে পাল্টাতে হবে।
শিশু-কিশোরের আধিক্যপ্রবণ দেশে পশ্চিমের শিশু-দুর্লভ সমাজের মডেল ব্যবস্থাপনায় প্রযোজ্য হবে না। বরং চীন থেকে শিক্ষা নেওয়া যায়। আমরা প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে প্রাথমিক থেকে ৪০-৬০ জনের শ্রেণি রাখতে পারি (ছাত্রসংখ্যা ৪০-এর বেশি হলে একজন করে সহায়ক শিক্ষক থাকবেন।)
সব স্কুলে ছোট ছোট পাঠাগার ও গবেষণাগার থাকবে আর প্রত্যেক উপজেলায় উপজেলা শিক্ষা দপ্তরের অধীনে এলাকার সব স্কুলে ব্যবহারোপযোগী পাঠাগার ও গবেষণাগার থাকবে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নগরায়ণের ফলে মাঠ ও মুক্ত অঙ্গন কমে যাচ্ছে। ছাত্রদের মাঠে খেলা ও শরীরচর্চার চাহিদা মেটানোর জন্য সারা দেশের মাঠ ও খোলা জায়গার (খাস জমি হলে ভালো হয়) শুমারি করে সেগুলো উপজেলা শিক্ষা দপ্তরের মাধ্যমে সংরক্ষণ ও বিভিন্ন স্কুলের ব্যবহারের সময়সূচি নির্ধারণ করা যায়।
মনে রাখতে হবে শুধু পাঠ্যবই পড়ে, তাও নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করে, কোনোভাবেই শিক্ষিত জাতি নির্মাণ করা যায় না। এ ধরনের খাপছাড়া মুখস্থবিদ্যা বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়। বস্তুত এ কারণেই উচ্চ স্তরের ভর্তি পরীক্ষায় নিম্নস্তরের মেধাবীদের ফল-বিপর্যয় ঘটেছে। তাই প্রত্যেক উপজেলা শিক্ষা দপ্তরের অধীনে একটি শিক্ষা-সংস্কৃতি সমন্বয় বিভাগের মাধ্যমে শিশুদের পাঠের অভ্যাস
গড়ে তুলতে ও সাংস্কৃতিক পাঠে সহায়তা দিতে হবে। সংস্কৃতি শব্দটি এর ব্যাপ্ত অর্থে ব্যবহার করছি, গান-বাজনা-চারুকলার মতো শুধু শিল্পচর্চা অর্থে নয়। সাংস্কৃতিক পাঠ থেকেই তার নীতি ও মূল্যবোধসহ জীবনের মানবিক পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় রসদ মিলবে।
মেধাবী তরুণদের স্কুলশিক্ষকতায় আগ্রহী করে তোলার জন্য দুটি করণীয়—বেতন-ভাতা বৃদ্ধি এবং প্রশাসন ও শিক্ষা বিভাগের বিভিন্ন দপ্তরের বহুমুখী অধস্তনতা থেকে মুক্তি। কম বেতন ও অতিরিক্ত অধীনতা শিক্ষকের মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গে কর্মক্ষমতাও নষ্ট করে দেয়।
বিদ্যাসাগরের আমলের স্কুল বুক সোসাইটির আদলে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যাতিরিক্ত নানা বিষয়ের বই প্রকাশের জন্য একটা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা গঠন করা যায়।
শিক্ষার মানোন্নয়নকে জাতীয় অগ্রাধিকার ঘোষণা করে অবিলম্বে জাতীয় শিক্ষা দশক ঘোষণা করা হোক। এর প্রথম পাঁচ বছর নিবিড়ভাবে স্কুলশিক্ষার মানোন্নয়নে নিবেদিত হবে এবং এ সময় ইউনেসকোর প্রস্তাবের সঙ্গে সংগতি রেখে জিডিপির ৬ শতাংশ এবং জাতীয় বাজেটের অন্তত ২০-২৫ ভাগ এখানে বরাদ্দ দিতে হবে।
শিক্ষার মানোন্নয়নের এই কর্মযজ্ঞের ব্যাপকতা ও গুরুত্ব বিবেচনা করে একে জাতীয় সাংস্কৃতিক বিপ্লব আখ্যা দিয়ে শিক্ষার কাজে দেশের সব উচ্চশিক্ষিত মানুষকে যুক্ত করে রীতিমতো জাতীয় জাগরণ তৈরি করতে হবে। আমরা জানি জাতি বিভক্ত, বহুধাবিভক্ত। আমরা এ-ও জানি র্যাব-পুলিশ-প্রশাসন দিয়ে মানুষকে দমিয়ে রাখা যায়, ঐক্য ও জাগরণ সৃষ্টি করা যায় না, তার পথ হলো পোশাকি পরিচয়ের আড়ালের মানুষগুলোকে নিয়ে ছোট ছোট সামাজিক কাজের সূচনা করা। আমরা সে পথের কথাই বলছি। একটু সাহস করে বলব, এই বিশেষ দশকে জাতীয় বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করার কথা ভাবা উচিত। প্রয়োজনে শিক্ষা করের কথাও ভাবা যায়।
পরিবর্তন যে কেবল সম্ভব তা নয়, পরিবর্তনের পক্ষে বড় রকমের উদ্যোগের এটাই সময়। কারণ দেশের সব স্তরের মানুষের মধ্যে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে, এর গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা হয়েছে এবং ইদানীং শিক্ষার মান নিয়েও মানুষ ভাবিত হচ্ছে। এ খাতে সাধ্যানুযায়ী, এমনকি সাধ্যাতীত ব্যয়েও কুণ্ঠিত হচ্ছে না মানুষ।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.