জার্মানিকে নিয়ে সব সংশয় কেটে গেছে by সরাফ আহমেদ

গত জুলাই মাসে আটলান্টিকের ওপারে সুদূর রিও ডি জেনিরোর মারাকানা স্টেডিয়ামে জার্মান ফুটবল দল যখন ১৯৯০ সালের পর চতুর্থবারের মতো আবার ফুটবলে বিশ্ব শিরোপা জয় করল—মনে হয়েছিল পরের দিন জার্মানিজুড়ে আনন্দের ঢেউ উথলে পড়বে। ১৩ জুলাই রোববার জার্মানির স্থানীয় সময় গভীর রাতের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আনন্দ ওই রাতেই ভোর অবধি সীমাবদ্ধ রইল। পরের দিন আবার সেই স্বাভাবিক জীবনযাত্রা—কোনো ছুটি নয়, সংবাদপত্রগুলোয় বিশেষ ক্রোড়পত্র নয়, ব্রাজিল থেকে বার্লিনে ফেরত আসা খেলোয়াড়দের সংবর্ধনা দেওয়া ছাড়া দেশজুড়ে আলাদা কোনো হইহুল্লোড় বা ফুটবলভক্তদের আনন্দ মিছিলও দেখা গেল না, বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কারণে আলাদা কোনো স্যুভেনিরও বাজারে এল না।
জার্মান জাতি তাদের অতীত ইতিহাসের তাড়না থেকেই, অতি উচ্ছ্বাস বা আগ্রাসী ভূমিকা পরিত্যাগ করে সংযম, ত্যাগ, শ্রম ও সমন্বিত ঐক্যপ্রয়াসী হয়েছে। ২৪ বছর আগে জার্মান জাতির পুনঃঐক্য ঘটলেও, ইউরোপীয় ও বিশ্ব রাজনীতিতে সতর্ক আর সাবধানে পথচলার ব্যাপারটি জার্মান রাজনীতিকের মধ্যে রয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, ৪৫ বছর পুঁজিবাদী আর সমাজতান্ত্রিক শিবিরে বিভক্ত হয়ে যাওয়া এবং জার্মান জাতির পুনরেকত্রীকরণের ২৪ বছর পার হয়ে গেলেও, জার্মান জাতির গত শত বছরে দুটি মহাযুদ্ধ এবং জার্মান জাতির বিভক্তি ও ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যাওয়ার প্রয়াস নিয়ে নানা একাডেমিক বিশ্লেষণ গবেষণা ও বইপত্র প্রকাশিত হচ্ছে।
সম্প্রতি বার্লিনের বিখ্যাত ফ্রি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক গের্ট ইয়োখিম গ্লেসনার তাঁর জার্মান ও ইউরোপীয় রাজনীতি এবং নিরাপত্তা ও মানবাধিকার শীর্ষক গবেষণামূলক বইয়ে লিখেছেন, ‘জার্মানির পুনরেকত্রীকরণের সময়টিতে তার প্রতিবেশীরা বাঁকা চোখে দেখলেও গত ২৪ বছরের ইউরোপীয় রাজনীতিতে জার্মানিকে নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলো ও বিশ্বের সংশয়টা অনেকটাই কেটেছে৷ তবে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় ইউরোপীয় ও বিশ্ব রাজনীতিতে জার্মানির ভূমিকা বা কর্তৃত্ব কী হওয়া উচিত, তখন অনেকেই ব্যাপারটি এড়িয়ে যান।’ ১৯৮৯ সালে রক্ষণশীল ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবী রজার স্কুটন লন্ডনের সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় লিখেছিলেন, ‘ডোন্ট ট্রাস্ট দ্য জার্মান’, তিনি তাঁর প্রবন্ধে যৌক্তিক কারণ উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘ইউরোপীয় রাজনীতিতে জার্মান ঐক্য ভবিষ্যতে আবার সংকট ডেকে আনবে।’
যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপীয় সমাজব্যবস্থা দেখে ষাটের দশকে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বিখ্যাত জার্মান সাহিত্যিক পাউল টমাসম্যান বলেছিলেন, ইতিহাসকে ভুলে নয়, ইতিহাসের সত্যটাকে মূল্যায়ন করে ইতিহাসের পুরোনো খোলস থেকে জার্মানদের বেরিয়ে আসার ব্যাপারটিই মুখ্য, মানবিকতা আর প্রতিবেশীদের সহানুভূতি আদায় করেই জার্মান জাতিকে এগোতে হবে।
বিশ্ব রাজনীতিতে ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী মিত্র শক্তির সমীহ আদায় করে জার্মানি পুনঃঐক্যের ২৪ বছর কাটলেও দুই ধরনের সামাজিক, রাজনীতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে একই কাঠামোতে সমন্বিত করার কাজটিও ছিল বেশ কঠিন।
২৪ বছর আগে মধ্য ইউরোপীয় ভূখণ্ডে, পূর্ব জার্মানি আর পশ্চিম জার্মানি নামের দুই দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা থেকেই এই পুনরেকত্রীভূত দেশের পূর্বের পাঁচটি আর পশ্চিমের ১১টি রাজ্য নিয়ে আবার গঠিত হলো জার্মানি।
প্রায় ২৫ বছরের কাছাকাছি সময়ে যুক্ত জার্মানির জনগণ কেমন আছে বা জার্মান জাতির সামাজিক-অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে নানা সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, দেশটির দুই অংশের অর্থনৈতিক বৈষম্য, চাকরির সুযোগ, যোগাযোগব্যবস্থার ক্রমেই উন্নতি ঘটছে, তবে অর্থনৈতিক উন্নয়নে পূর্বের অংশ, পশ্চিমের তুলনায় এখনো ২৫ ভাগ পিছিয়ে রয়েছে। সাবেক পূর্ব জার্মানির কাঠামো পশ্চিমা ধাঁচে গড়ে তুলতে যে অঢেল অর্থের প্রয়োজন হয়েছে, তা জোগান দিতে সেই ১৯৯১ সাল থেকে সংহতি ভ্যাট চালু রয়েছে, যা ২০১৯ সাল পর্যন্ত চালু থাকার কথা রয়েছে। জার্মানির ৭৫ শতাংশ মানুষ মনে করেন, ঐক্যবদ্ধ জার্মানির সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল।
দুই ধরনের সমাজতান্ত্রিক আর ধনবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে এক করে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি ছিল দুরূহ। পূর্ব জার্মানিতে সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের অর্থনীতির প্রচলন রইলেও তা ছিল পূর্ব ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্য সেরা অর্থনীতি, যদিও পুঁজিবাদের সমর্থকেরা তা মানেন না। আর পশ্চিমের অর্থনীতি পুঁজিবাদী শ্রেণির হলেও, সেখানে মানবিকতা ছিল। পশ্চিম জার্মানিতে একধরনের সামাজিক অর্থনৈতিক বাজারকাঠামো ছিল। সমাজতান্ত্রিক দেশ না হয়েও মানুষের মৌলিক চাহিদা যেমন আবাস, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, জ্বালানি—এসব সেবামূলক গ্যারান্টির নিশ্চয়তা ছিল আর সেই একই ধাঁচে ২৪ বছর ধরে এগিয়ে যাচ্ছে ঐক্যবদ্ধ জার্মানির সামাজিক নিশ্চয়তামূলক অর্থনীতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর জার্মানির অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিকেরা যে সামাজিক অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপন করেন, ওই সামাজিক বাজার অর্থনীতি নানা ধকল বা পুনঃঐক্য জার্মানির অর্থায়ন সামাল দিয়ে ইউরোভুক্ত দেশগুলোর সফল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর ১৮তম জার্মান পার্লামেন্ট নির্বাচনে বড় কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ার কারণে বড় দলগুলো নির্বাচন-পূর্ব বাগ্বিতণ্ডা ভুলে জোট সরকার গঠন করে দেশ চালাচ্ছে। অবশ্য জার্মান রাজনীতিতে এই ঘটনা নতুন নয়। ১৯৬৬ সালের পর ২০০৫, আর এবার ২০১৩ সাল—এই নিয়ে তৃতীয়বার জার্মানির দুই জনপ্রিয় দল খ্রিষ্টিয়ান গণতান্ত্রিক দল ও সামাজিক গণতান্ত্রিক দল, ছোট দল ব্যাভেরিয়া রাজ্যের খ্রিষ্টিয়ান সামাজিক ইউনিয়নকে নিয়ে মহাজোট সরকার গঠিত হয়েছে এবং গত একটি বছর সাফল্যের সঙ্গেই তারা দেশ পরিচালনা করছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী নতুন প্রজন্মের রাজনীতিকেরা জার্মান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে পরিবর্তন এনেছেন, তা হলো বিভক্তি আর অনৈক্যকে পাশে সরিয়ে রেখে অভ্যন্তরীণ ও উপমহাদেশীয় ঐক্য সংহতির জন্য সমন্বিতভাবে কাজ করা। আর এই রাজনৈতিক সংস্কৃতিই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে জার্মানিকে। যুদ্ধ, হত্যালীলা, জবরদখল থেকে বের হয়ে এসে নতুন প্রত্যাশায় সবাইকে সমন্বিত করে অগ্রসরমাণ এই জাতি ভবিষ্যতে বিশ্বের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে।
সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মান প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.