প্রতিমন্ত্রীর ‘পলাতক’ বিয়ে–তত্ত্ব by সোহরাব হাসান

আমাদের মন্ত্রীরা বচনে যতটা পারদর্শী, কাজে ততটা পারদর্শী হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সরকার পরিচালনা করতে এতটা পেরেশান হতে হতো না। ইন্দিরা গান্ধীর আমলে ভারতের মন্ত্রিসভা সম্পর্কে যে কথাটি চালু ছিল, তার পুনরাবৃত্তি করতে চাই না এবং করাটা মন্ত্রিসভার কোনো পুরুষ সদস্যের জন্য সম্মানজনকও নয়। আমাদের অধিকাংশ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী তাঁদের মন্ত্রণালয়ের কাজকর্ম সম্পর্কে ধারণা রাখেন না। প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করতেই সদা ব্যস্ত থাকেন। তিনি ভুল বললেও বাহ্ বেশ বেশ বলে শোরগোল তোলেন।
প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে গার্ল সামিট থেকে এসে বললেন, মেয়েদের বিয়ের বয়স কমানোর বিষয়টি ভাবা যেতে পারে। বিশ্বের অনেক দেশেই নাকি ১৬ বছরে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। আর মন্ত্রীরা সোল্লাসে তার সমর্থনে নেমে পড়লেন। এমনকি মহিলাবিষয়ক প্রতিমন্ত্রীও এর পক্ষে নানা যুক্তি দেখাতে থাকলেন। মন্ত্রিসভার বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক রাজনীতিক হিসেবে যতটা না পরিচিত, তার চেয়ে বেশি খ্যাতিমান ব্যবসায়ী হিসেবে। সে কারণেই সম্ভবত ভদ্রলোক স্বাস্থ্য বিষয়ে কথাবার্তা বলতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেছেন। গত বৃহস্পতিবার সিরডাপ মিলনায়তনে জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাতে পাঁচ বছর মেয়াদি উন্নয়ন কর্মসূচির মধ্যমেয়াদি পর্যালোচনা করতে গিয়ে প্রতিমন্ত্রী মেয়েদের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে নতুন তত্ত্ব হাজির করলেন। তিনি বলেছেন, ‘অল্প বয়সী মেয়েরা আজকাল আকছার পালিয়ে বিয়ে করছে, সে জন্যই বিয়ের বয়স কমানোর কথা ভাবা হচ্ছে।’
আর কোনো কারণে নয়, অল্প বয়সে মেয়েরা পালিয়ে বিয়ে করছে, এ কারণে পালিয়ে যাওয়ার আগেই তাদের বিয়ে দিতে হবে। এই হলো প্রতিমন্ত্রীর মোক্ষম যুক্তি। যেন বিয়ের বয়স কমালেই দেশ বাল্যবিবাহ নামের অভিশাপ থেকে মুক্তি হবে। কী সহজ সমাধান!
বর্তমানে আইনত ১৮ বছরের নিচে কোনো মেয়ে এবং ২১ বছরের নিচে কোনো ছেলে বিয়ে করতে পারেন না।
আলোচনাটি ছিল জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাতের উন্নয়ন নিয়ে। আর প্রতিমন্ত্রী বললেন মেয়েদের পালিয়ে বিয়ে করার কথা। নিজের তত্ত্বের সমর্থনে জাহিদ মালেক আরও যেসব কথা বলেছেন, তা যেমন স্ববিরোধী, তেমনি হাস্যকর।
তাঁর এসব কথায় সেই বহুল কথিত গল্পটিই মনে পড়ল। এক ছাত্র পরীক্ষার হলে গিয়ে দেখে রচনা কমন পড়েনি। সে পড়ে গিয়েছে গরুর রচনা, এসেছে নদী। অগত্যা ছাত্রটি গরুকে নদীতে নামিয়ে দিয়েছে। এবং গরু আরামে নদীতে সাঁতরাচ্ছে। প্রতিমন্ত্রী জানেন না যে জনসংখ্যা ও পুষ্টি সমস্যার সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার সম্পর্ক না থাকলেও অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ের সম্পর্কটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অল্প বা অপরিণত বয়সে বিয়ে হলে মা ও সন্তান দুজনই অপুষ্টির শিকার হন। তাঁদের নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দেয়।
জাহিদ মালেক কোথায় পেলেন যে বাংলাদেশের মেয়েরা আকছার পালিয়ে বিয়ে করছে? লাখেও একটি হবে না। তাঁর দাবি, স্কুলগুলোয় মেয়েদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে, এমনকি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেয়েদের হার এখন বেশি।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েরা বেশি হারে যাচ্ছেন বলেই কি প্রতিমন্ত্রী বিয়ের বয়স কমিয়ে তাঁদের পড়াশোনা বন্ধ করতে চাইছেন? একজন ছাত্র বা ছাত্রীকে মেডিকেল কলেজে পড়তে হয় এইচএসসি পাস করার পর, যা ১৬ বছরের আগে সম্ভব নয়। তাহলে তিনি কি আকছার পালিয়ে যাওয়া ঠেকাতে তাদের কলেজে আসার আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসাতে চান?
সরকার একদিকে এইচএসসি পর্যন্ত মেয়েদের পড়াশোনা ফ্রি করে দিয়েছে, অন্যদিকে যাতে কলেজে যাওয়ার বয়সের আগেই তাদের বিয়ের আইন করার উদ্যোগ নিচ্ছে। বিষয়টি কি স্ববিরোধী নয়? বর্তমানে মেয়েদের বিয়ের নিম্নতম বয়স ১৮ বছর হলেও অনেক অভিভাবক বয়স বাড়িয়ে ১৫–১৬ বছর বয়সী মেয়েকেও বিয়ে দিচ্ছেন। প্রতিমন্ত্রীর ভাবনাটি বাস্তবে রূপ পেলে তখন সেটিই আইনসম্মত হয়ে যাবে। মানুষ সামনে এগোয়, আর আমাদের সরকারগুলো পেছনে যেতেই পছন্দ করে। জামায়াতের নেতারাও যে ফতোয়া দেওয়ার সাহস পাননি, সেই ফতোয়াই দিচ্ছেন আওয়ামী লীগ সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী!
মেয়েদের বিয়ের বয়স কমালে দেশে নারীর ক্ষমতায়ন হবে না, তবে অপরিণত মা এবং অপুষ্ট সন্তানের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে।
প্রতিমন্ত্রী আরেকটি উদ্ভট কথা বলেছেন। অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার জন্য নাকি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি প্রচণ্ড চাপ আছে। শেখ হাসিনা সাড়ে ১০ বছর ধরে সরকার পরিচালনা করছেন। কেউ কখনো মেয়েদের বিয়ের বয়স কমানোর জন্য তাঁর কাছে দাবি তোলেনি। বরং সরকার বাল্যবিবাহ রোধ কমাতে না পেরেই বাড়তি চাপ অনুভব করছে।
প্রতিমন্ত্রীর জানা উচিত যে আকছার পালিয়ে যাওয়া নয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে অনেক সময় অভিভাবকেরা মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দিতে বাধ্য হন। প্রথমত, দারিদ্র্যের কারণে গরিব বাবা-মা মেয়েদের পড়াতে পারেন না এবং অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেন। দ্বিতীয়ত, পাড়ার বখাটে এবং রাজনৈতিক মাস্তানদের (এরা সাধারণত ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক হয়) হাতে নিগৃহীত হওয়ার ভয়ে তাদের বিয়ে দিতে বাধ্য হন।
প্রতিমন্ত্রী মহোদয় যদি পালিয়ে যাওয়া তত্ত্ব না দিয়ে মেয়েদের সামাজিক নিরাপত্তার কথা বলতেন, দেশবাসী আশ্বস্ত হতো।
ইতিমধ্যে মহিলা পরিষদসহ বেশ কিছু নারী সংগঠন মেয়েদের বিয়ের বয়স কমানোর বিরোধিতা করেছে। বিরোধিতা করেছে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও। লেখক-গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ এই প্রথম আলোতেই একটি লেখায় সরকারের পশ্চাৎপদ চিন্তার একটি মোক্ষম জবাব দিয়েছেন।
অতএব, বিয়ের বয়স কমানোর মতো আত্মঘাতী চিন্তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলুন। আমাদের অবশ্যই বাল্যবিবাহ শূনে্যর কোঠায় নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু সেটি মেয়েদের বয়স কমিয়ে বা পালিয়ে যাওয়া তত্ত্ব দিয়ে নয়।
প্রতিমন্ত্রী মহোদয়, দয়া করে গরুর রচনাকে নদীতে নিয়ে যাবেন না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabo3@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.