মিলানে আসেম, পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমানকাণ্ড ও বাংলাদেশ by সাদেক খান

যুদ্ধ যুদ্ধ রব এখন চার দিকে। তবে গণবিধ্বংসী যুদ্ধ এখনো বৈশ্বিক মাত্রায় কিংবা ব্যাপক আকারে শুরু হয়নি। কেবল খণ্ড খণ্ড বিধ্বংসী যুদ্ধ ও অনিয়মিত নাশকতা সমান্তরালভাবে তিন মহাদেশে তথা ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। তাতে সরাসরি উত্তর আটলান্টিক জোটের প নিয়ে যোগ দিয়েছে দণি গোলার্ধের চতুর্থ মহাদেশ অস্ট্রেলেশিয়া। চার মহাদেশব্যাপী যুদ্ধলিপ্ততার এই ভয়ঙ্কর বাস্তবতার উপলব্ধি তাড়া করে ফিরেছে ইতালির মিলান নগরীতে দুই দিনের এশিয়া-ইউরোপ মিটিং বা আসেম অধিবেশনে সমবেত বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও যোগ দিয়েছেন আসেমের ওই দশম অধিবেশনে। তার সাথে একান্ত সাাৎ হয়েছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের। একান্ত সাাৎ হয়েছে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের সাথেও। ভাববিনিময়, সৌজন্যের আদান-প্রদান ঘটেছে। ওই আসেম অধিবেশনের পুরো সময়জুড়ে কিন্তু একটা উদ্বেগ ইউরোপ ও ইউরোপীয় রাশিয়া কিংবা এশিয়ার মধ্যপ্রাচ্যে তেলসমৃদ্ধ আরব রাষ্ট্রগুলোকে বিচলিত করে রেখেছে। তার প্রতিফলন ঘটেছে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে জার্মান চ্যান্সেলর মার্কেলের দীর্ঘ বৈঠক এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য নেতার সাথে রুশ নেতৃবৃন্দের সংলাপে। বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের চিন্তা-চেতনায় তার কোনো সংক্রমণ হয়নি। তাদের নজরে পড়েনি মিলানে সমাগত ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দের কাতরতা। রাশিয়ার বিরুদ্ধে, ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এক নয়া লৌহবলয় রচনায় শামিল হয়েছে ইউরোপ। তার জেরে জ্বালানি-অনিশ্চয়তা, বাজার সঙ্কোচন ইত্যাদির কারণে অস্থির ইউরোপীয় জনপরিবেশ। আইএসআইএল বা ইরাক ও লেভান্তের ইসলামি রাষ্ট্রের জিহাদে যোগদানকারী ইউরোপীয় মুসলিম স্বেচ্ছাসেবকেরা দেশে ফিরে নাশকতায় লিপ্ত হবে কি না, বহিরাগমনের সবগুলো পথে কঠোর পাহারার নিরাপত্তাবলয় বহাল করে তাদের দেশে ফেরা কিভাবে বন্ধ করা যায়, তা নিয়ে রয়েছে ইউরোপীয় নেতাদের দুশ্চিন্তা। গৃহযুদ্ধে বিরতি সত্ত্বেও অদ্যাবধি পূর্ব ইউক্রেনে বন্ধ হয়নি স্থানে স্থানে রকেট আক্রমণ, কিয়েভ সরকারের দখলে থাকা একটি বিমানঘাঁটি থেকে কামানের গোলা ছোড়া। ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রেহাই পাচ্ছে না জনবসতিগুলো। ইরাকের বাগদাদের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে আইএসআইএল বা ইসলামি রাষ্ট্রের ঘোষিত খেলাফত। সিরিয়া-তুরস্ক সীমান্তে কুর্দি পেশমেরগা যোদ্ধারা ন্যাটো-মার্কিন বিমান হামলার ছত্রছায়ায় খেলাফতের অভিযান কিছুটা ঠেকিয়ে দিতে সম হলেও ইরাক ও সিরিয়ায় ক্রমে বেড়েই চলেছে ইসলামি রাষ্ট্রের পরিধি। এসব নিয়ে সেসব দেশের মানুষের আওয়াজ নেতাদের আলোচনা শুনেও যেন শুনতে পাননি আসেমে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল। শুধু বলে গেছেন, এ দেশের বাক্যবাগীশ মতাসীনদের কেতাবি মূল্যবোধ ও স্বপ্নের ভবিষ্যতের কথা, যে কথার সাথে তাদের কাজের কোনো মিল নেই, আর স্বদেশে তাদের জুলুম-দুরাচারও ক্রমবর্ধমান।
তবে ইরাক ও লেভান্তের ইসলামি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘প্রজন্মব্যাপী’ যুদ্ধের জন্য যে জোট বা কোয়ালিশন মার্কিন নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে তাতে বাংলাদেশ যোগ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে সঠিক পথেই চলেছে। বাংলাদেশ বলেছে, জাতিসঙ্ঘ সনদের আওতায় পরিচালিত শান্তিরা বা শান্তিপ্রতিষ্ঠা কিংবা আগ্রাসন প্রতিরোধের যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনো ধরনের যুদ্ধে বাংলাদেশ লিপ্ত হবে না।
বস্তুত চীনের ‘শান্তিপূর্ণ জাগৃতি’-এর নীতি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে চীনের সাথে ‘সহযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা’-এর নীতির প্রভাবে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধিসহায়ক যে স্থিতিস্থাপকতা এখনো বজায় রয়েছে, তার সুবিধাভোগী হয়েই এ দেশ অনগ্রসরতা ও দারিদ্র্যের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে, ক্রমে একটা প্রতিযোগিতাম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। শাসনব্যবস্থায় দুর্নীতি-দুরাচার জুলুমবাজি সত্ত্বেও জনশক্তি, শ্রম ও উদ্যোগবলে অর্থনৈতিক বিকাশের একটা অভ্যন্তরীণ গতিবেগ ও বৈদেশিক বাণিজ্য-সম্পর্ক তৈরি করতে সম হয়েছে বাংলাদেশ। তার ধারাবাহিকতা রার জন্য আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সঙ্ঘাতমুক্ত অবস্থান এ দেশের একান্ত প্রয়োজন। একইভাবে প্রয়োজন দেশাভ্যন্তরে সুশাসন, জননিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। অশান্তি সৃষ্টিকারী বৈদেশিক হুমকি বা কারসাজি আর অভ্যন্তরীণ দুরাচার বা নৈরাজ্য উভয়ের বিরুদ্ধেই এদেশবাসীকে সতর্ক থাকতে হবে।
তবে আঞ্চলিক যুদ্ধাবস্থা এড়াতে পারলেও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের ধ্বংসাত্মক আঘাত কি এড়াতে পারছি আমরা?
২ অক্টোবর এ দেশের সীমান্তের ওপারে পশ্চিমবঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যার মাওবাদী করিডোরের কাছে বর্ধমানে খাগড়াগড়ের একটি বাড়িতে বোমা বিস্ফোরণে দু’জনের মৃত্যু ও একজন জখম হওয়ার ফলে সেখানে আর বীরভূমে গুপ্তসন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সন্ধান পায় ভারতীয় পুলিশ। ওই গোষ্ঠী বাংলাদেশের ‘অবদমিত নাশক দল’ জেএমবির (জামা’আতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ) সম্পৃক্ততাপুষ্ট বলে দাবি করেছে ভারতীয় গোয়েন্দারা। ভারতীয় পত্রপত্রিকার খবর : সেখানে বাংলাদেশ থেকে কিছু জঙ্গি মুসলিম মৌলবাদী গিয়ে একটি দালানবাড়িতে বোমা বানাচ্ছিলেন। বোমা বানানোর সময় সেখানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। ফলে মারা যান দু’জন বোমা নির্মাণকারী ও আহত হন আরো কয়েকজন। যে দালানবাড়িটিতে বোমা বানানো হচ্ছিল, বোমা বিস্ফোরণের ফলে তার কোনো অংশ ভেঙে যায়নি। (উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গে নকশালপন্থীরা অনেক শক্তিশালী বোমা বানাতে জানে। সেসব বোমা বিস্ফোরণে দালানকোঠা ভেঙে পড়ে, সাঁকো, রেললাইন উড়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের ‘জঙ্গি মুসলিম মৌলবাদীদের’ তৈরি পটকার সাথে তার তুলনা হয় না। যেমনÑ ভারতে ছত্তিশগড় রাজ্যে নকশালপন্থীরা স্থলমাইন ব্যবহার করছে, যা কেবল সেনাবাহিনীর লোকেরাই ব্যবহার করতে পারে।)
পূজার ছুটি (বাংলাদেশ বকরি ঈদ ও দুর্গাপূজা মিলিয়ে লম্বা ছুটি) থাকায় ঘটনাটি নিয়ে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের উপাদান পাকিয়ে তুলতে একটু সময় লেগেছে। তা ছাড়া এক ঢিলে দুই পাখি মারার সুযোগ হাতে পেয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টির র কারিগরেরা প্রথমে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ ও রাজ্য সরকারকে তদন্তের বাহাদুরিতে ভুল করার সময় দিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের টাস্কফোর্স, অ্যান্টিটেরোরিস্ট স্কোয়াড ও সিআইডি নিহত শাকিল ও আহত হাসানের দুই স্ত্রীকে অকুস্থল থেকে গ্রেফতার করে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী তারা নিকটবর্তী বাদশাহি রোডের একটি পোড়োবাড়িতে ৮ অক্টোবর তল্লাশি চালিয়ে কিছু আলামত পেয়ে বাড়িটি সিলগালা করে। ইতোমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সরকারবিরোধী দলগুলোর তরফে আওয়াজ ওঠে জাতীয় গোয়েন্দা এজেন্সির হাতে তদন্তভার দেয়ার জন্য। সন্দেহ ব্যক্ত করা হয়, তৃণমূল কর্মীদের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, রাজ্য পুলিশ আলামত নষ্ট করতে পারে।
তার আগে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ ও বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির দেয়া খবর : রাজ্যের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে জঙ্গি তালিমের জন্য প্রায় ৬৫টি শিবির গড়েছে (ভারতের) নিষিদ্ধ সংগঠন সিমি। বাংলাদেশের মৌলবাদীরা এবং (পাকিস্তানের) আইএসআই ওই জঙ্গিশিবিরগুলোকে প্রত্যভাবে মদদ জোগাচ্ছে বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন। এ সম্পর্কে গোয়েন্দা রিপোর্ট পাওয়ার পর ভারতের জাতীয় তদন্ত এজেন্সি (এনআইএ) কেন্দ্রের নির্দেশে খোঁজখবর শুরু করেছে। শুধু এই রাজ্য নয়, ত্রিপুরা ও অসম সীমান্তেও সিমি এ ধরনের জঙ্গি তালিমশিবির তৈরি করেছে। বর্ধমান বিস্ফোরণ-কাণ্ডের তদন্তে নেমে সিআইডি সিমির যোগসাজশের হদিস পেয়েছে। সিআইডি এবং রাজ্য পুলিশের অফিসাররা মনে করছেন, সিমি বর্ধমানের ওই বাড়িতে বসে যেমন অত্যাধুনিক বিস্ফোরক তৈরি করেছে, তেমনি সীমান্তবর্তী নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহ ও দণি দিনাজপুর জেলায় বড় ধরনের জাল বিস্তার করেছে। এই চার জেলার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশী জঙ্গিরা ভারতে ঢুকে পড়ছে। রাজ্যের কয়েকজন লিংকম্যান অস্ত্র ও বিস্ফোরক বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে দিচ্ছে। কয়েকজন বাংলাদেশী আবার ভুয়া তথ্য দিয়ে এই দেশের ভোটার তালিকায় নাম তুলেছে ও সচিত্র পরিচয়পত্রও তৈরি করেছে। শুধু নদিয়া জেলায় এ রকম ২৭টি জঙ্গি ঘাঁটি তৈরি হয়েছে। এ ছাড়াও মালদহ, মুর্শিদাবাদ ও দণি দিনাজপুর জেলায় এ রকম গোপন ক্যাম্পসহ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় মোট ৬৫টি জঙ্গি ঘাঁটির খবর পাওয়া গেছে। রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরের নির্দেশ মোতাবেক উত্তর চব্বিশপরগনা, নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ তল্লাশি চালানো শুরু করেছে। কেন্দ্রের নির্দেশে এনআইএ-ও পৃথকভাবে তদন্ত শুরু করেছে।
৭ অক্টোবর কলকাতা থেকে আরো খবর : বর্ধমানে বিস্ফোরণ-কাণ্ডের সাথে বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদিনের (জুম) সংস্রবের আরো সুস্পষ্ট প্রমাণ
তদন্তকারীদের হাতে এসেছে। গোয়েন্দারা নিশ্চিত, চলতি বছরে ফেব্র“য়ারি মাসের ২৩ তারিখ বাংলাদেশের ময়মনসিংহের ত্রিশাল এলাকায় পুলিশ খুন করে দুই জুম নেতাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল যে দলটি, তারাই ঘাঁটি গেড়েছিল বর্ধমানে। তার আগে এ দলটিই মুর্শিদাবাদের লালবাগ এলাকায় সাময়িক আস্তানা গেড়ে ‘জিহাদি’ নিয়োগের কাজ চালাচ্ছিল। বিস্ফোরক জোগাড় করা, বোমা বানানো এবং সেই ‘কনসাইনমেন্ট’ বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য ক্যারিয়ার নিয়োগের কাজও শুরু করেছে তারা। নিয়োগের এই কাজ পরিচালিত হয়েছে বর্ধমান-কাণ্ডে নাম জড়ানো কৌসরের মাধ্যমে। খাগড়াগড়ের ওই বাড়িতে বহিরাগতদের নিয়মিত আনাগোনা ছিল। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনই বিশেষ করে কৌসর, রসিক ও ফারুক নামে তিনজন বাংলাদেশে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’।
১১ অক্টোবর ভারতে অফিস-আদালত খোলার পরপরই অনলাইনে খবর : পশ্চিমবঙ্গ সরকার অনিচ্ছা সত্ত্বেও ১০ অক্টোবর কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার (এনআইএ) হাতে বর্ধমান-কাণ্ডের তদন্তভার তুলে দিলো। জামা’আতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) প্রতিনিধিরা মুর্শিদাবাদ, নদিয়া ও বর্ধমানসহ নানা এলাকায় ধর্মীয় শিাপ্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে এপার বাংলায় ঘাঁটি গাড়তে শুরু করেছিল। সিবিআইয়ের নজরে এখন ১৯ নম্বর দরগা রোডের বাড়ি, যেখানে নিষিদ্ধ সিমির মূল ঠিকানা ছিল, এখন একটি প্রকাশনা সংস্থার অফিস।
বর্ধমানের খাগড়াগড়ে ওই বিস্ফোরণে বাংলাদেশী বোমা কারিগর শামিম শাকিল আহমেদ ও স্বপন মণ্ডল নামে দু’জন নিহত হন। নিহত দু’জনসহ পুরো দলটি বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদী সংগঠন জেএমবির সদস্য। বিস্ফোরণে আহত আবদুল হাকিম এর বেশি তথ্য দিতে রাজি হননি। শাকিলের স্ত্রী রুমি বিবি জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, দলটি লেদ মেশিনের সাহায্যে অস্ত্র বানানোর চেষ্টা করছিল। বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যাওয়া মোবাইল ফোনের আইএমআই রেকর্ডে রকেট লঞ্চারের ডিজাইনের ছবি ও পেণাস্ত্রের ডিজাইন পাওয়া গেছে।
তারপর ১৬ অক্টোবর বিশেষ খবর : বর্ধমানের বাদশাহি রোডে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সিলগালা করা বাড়িটি থেকেই পায়খানায় লুকানো ৩০টি গ্রেনেড-জাতীয় হাতেগড়া তাজা বোমা উদ্ধার করেছে এনএইএ, এনএসজির যৌথ বিশেষজ্ঞ দল ও তাদের বিস্ফোরক ঘ্রাণ সন্ধানী কুকুরবাহিনী। পশ্চিমবঙ্গের গোয়েন্দারা সেসব খুঁজে পায়নি বা ভালো করে খুঁজে দেখেনি। নজরদারিতে রাখা আরেকটি মাদরাসায় অভিযান চালায়নি পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ, যদিও জব্দ করা একটি পেনড্রাইভে সেখানে জঙ্গি প্রশিণের ভিডিও চিত্রের তথ্য তাদের হাতে এসেছিল।
এর পর ১৭ অক্টোবর থেকে শুরু হলো ভারতের, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়ায় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সূত্রে ফাঁস করা
তদন্তের খবর দিয়ে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধাস্ত্রের নানা বোমাবার্তার প্রস্রবণ। যেমন অনলাইনে এলো : বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পর একের পর এক তল্লাশি অভিযান চালিয়ে পাওয়া যাচ্ছে প্রচুর পরিমাণে গ্রেনেড ও বিস্ফোরক। এসব গ্রেনেড ও বিস্ফোরক বাংলাদেশ ও আসামের জঙ্গিদের কাছেও পাঠানোর জন্য তৈরি করা হয়েছিল বিস্ফোরণে নিহত শাকিল গাজীর তত্ত্বাবধানে। এসব গ্রেনেড ও বিস্ফোরক মজুদ করে রাখা হয়েছিল বিভিন্ন জঙ্গিডেরায়। বর্ধমানে বিস্ফোরণের ঘটনাস্থল থেকে ৫০০ মিটার দূরে বাদশাহি রোডে একটি বাড়ি থেকে এনআইএ গোয়েন্দা ও এনএসজির কমান্ডোরা উদ্ধার করেছিল ৪০টি গ্রেনেড এবং ২৫ বস্তা বিস্ফোরক। এ বাড়িটিতে থাকত মন্টু শেখ ও তার ছেলে রেজাউল শেখ। বিস্ফোরকগুলো লুকানো ছিল বাথরুমের একটি গোপন স্থানে। গোয়েন্দাদের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, এ বিপুল বিস্ফোরক কি সাধারণ মানুষের ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য রাখা হয়েছিল, নাকি সেনাদের ওপর আক্রমণের জন্য। যৌথবাহিনীর সদস্যরা কুকুর ও বোম স্কোয়াডকে সাথে নিয়ে তল্লাশিতে নেমে যেভাবে বিস্ফোরক পাচ্ছে তাতে তাদের ধারণা, বর্ধমান ও সংলগ্ন এলাকায় আরো গ্রেনেড ও বিস্ফোরক মজুদ রাখা হয়েছে। রেজাউল শেখ ও তার পরিবার বিস্ফোরণের দিন থেকেই লাপাত্তা।
পত্রিকার খবর : মাওবাদী নারীবাহিনীর কথা এত দিন জানা ছিল। এবার ধরা পড়ল পশ্চিমবঙ্গে একটি জিহাদি প্রমীলা বাহিনীর অস্তিত্ব। ঘটনায় নিহত শাকিল আহমেদের স্ত্রী রাজিয়া বিবি এবং জখম আব্দুল হাকিমের স্ত্রী আলিমা বিবি দু’জনই ওই নারী বাহিনীর সদস্য। বাকিরা এখনো অধরা।
এনআইএর দাবি : বাহিনী গঠন ও যাবতীয় প্রশিণের প্রধান দায়িত্বে ছিল আয়েশা বিবি, যে কিনা বর্ধমানের মঙ্গলকোটের কৃষ্ণবাটী গ্রামের বাসিন্দা মৌলানা ইউসুফ শেখের স্ত্রী। খাগড়াগড়-কাণ্ড যে আন্তর্জাতিক জঙ্গিজালকে প্রকাশ্যে এনেছে, পশ্চিমবঙ্গে তার চাঁই হলো ইউসুফ। জিহাদিদের অন্যতম আঁতুড় হিসেবে চিহ্নিত শিমুলিয়া মাদরাসার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ইউসুফ আপাতত ফেরার। আয়েশাও পালিয়েছে।
বাংলাদেশের জেএমবি ও ভারতের জমিয়তুল মুজাহিদিনকে মেলাতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে ওসামা বিন লাদেনের আলকায়েদা। আলকায়েদার বর্তমান প্রধান আয়মান আল জাওয়াহিরির লেখা সাত পাতার যে চিঠিটি ২০০৯-এ ফাঁস হয়, তাতে জিহাদে মহিলাদের শামিল হওয়ার আহ্বান রয়েছে।
আফগানিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত হানার ল্েয আলকায়েদাই গড়েছিল প্রমীলা জঙ্গিবাহিনী ‘বোরখা ব্রিগেড’। আত্মঘাতী নারীজঙ্গির মারণ হানার দৃষ্টান্তও রয়েছে ভারতে। এলটিটিইর এমন এক হামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধীকে প্রাণ দিতে হয়।
রাজিয়া, আলিমা ছাড়াও জিন্নাতুর বিবি, জরিনা বিবি, রুম্পা খাতুন ও খালেদা বিবি বীরভূমের এই চার তরুণী শিমুলিয়া ও মকিমনগর মাদরাসায় জঙ্গি তালিম নিয়েছিল বলে
তদন্তকারীদের সন্দেহ। চারজনই অবশ্য ফেরার। তাদের খোঁজ করতে রাজ্যে আরো মহিলা অফিসার ও কনস্টেবল আনছে এনআইএ। ‘মাওবাদী নেত্রী জাগরি বাস্কে, সুচিত্রা মাহাতো, শোভা মান্ডিরা দু-তিন বছর আগে মূল স্রোতে ফিরেছে ঠিকই; কিন্তু এখন ঘুম কেড়েছে আয়েশারা।’ মন্তব্য এক আইবি-কর্তার।
পত্রিকায় আরো খবর মালদহ থেকে : কালিয়াচকের বাঁশবাগানে মিলল ১৬টি বলবোমা। শক্তপোক্ত প্লাস্টিকের বলের কিছুটা কেটে কমলা রঙের বিস্ফোরক ঠাসা। রয়েছে ছোট পেরেক, পাথরকুচি, বল বিয়ারিং, ধারাল লোহার টুকরোও। সেসব পুরে আঠা দিয়ে ফের বলটি জোড়া হয়েছে। সব মিলিয়ে আনুমানিক ওজন প্রায় ৫০০ গ্রাম। এমনই ১৬টি ‘বলবোমা’ শুক্রবার উদ্ধার হলো মালদহে। তার জেরে ফের তদন্তে গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে মালদহ জেলা পুলিশের বিরুদ্ধে। কারণ, যে শিকের বাড়ির বাগানে বড় মাপের প্লাস্টিকের জেরিকেনে বোমাগুলো রাখা ছিল, পুলিশ তাকে রাত পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করেনি।
১৮ অক্টোবরের ভারতীয় পত্রপত্রিকায় জবর খবর : যে ধরনের রাসায়নিক বিস্ফোরক বর্ধমানে উদ্ধার হয়েছে, তার সাথে শ্রীলঙ্কায় মুছে যাওয়া তামিল জঙ্গি সংগঠন এলটিটিইর (লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম) ব্যবহার করা বিস্ফোরকের মিল খুঁজে পেয়ে কপালে ভাঁজ পড়েছে ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ডের (এনএসজি) বোমা বিশেষজ্ঞদের; কিন্তু এখন তো আর এলটিটিইর অস্তিত্বই নেই। কোথা থেকে উঠে এলো এদের নাম? এনএসজির সাবেক কর্তা এবং বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘ভুলে যাবেন না, সম্প্রতি ছত্তিশগড়ে মাওবাদীদের বিস্ফোরণের ঘটনাতেও এলটিটিইর ছাপ পেয়েছে স্বরাষ্ট্র দফতর। সংগঠন হিসেবে এলটিটিইর এখন আর অস্তিত্ব না থাকলেও যে পাকা মাথার যুবকেরা এলটিটিইর জন্য বিস্ফোরক বানাত, তারা রয়েই গেছে।’
ভারতীয় গোয়েন্দাদের আশঙ্কা, একসময় এলটিটিইর হয়ে কাজ করা এই যুবকেরাই এখন মোটা টাকার বিনিময়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন, মাওবাদী বা (পাকিস্তানের) লস্করের মতো জঙ্গিদের বিস্ফোরক তৈরির প্রশিণ দিচ্ছে। বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণে নিহত শাকিল বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সদস্য ছিল (নিহত দ্বিতীয় ব্যক্তির নাম শোভন মণ্ডল, নাগরিকত্ব ভারতীয়, অমুসলিম)। গোয়েন্দাদের আশঙ্কা, সম্প্রতি এই সংগঠনও হয়তো মোটা টাকা দিয়ে এলটিটিইর বিস্ফোরক বানানোর কারিগরি আয়ত্ত করেছে। কয়েক দিনের তল্লাশিতে বর্ধমানের খাগড়াগড় ও শিমুলিয়া থেকে পাওয়া গেছে বেশ কিছু রাসায়নিক। এগুলোর সবই উচ্চমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক বানাতে কাজে লাগে। এই রাসায়নিক দেখেই বিস্মিত ভারতের গোয়েন্দারা। ভারতের জাতীয় গোয়েন্দা এজেন্সি এনআইএর বক্তব্য, সামান্য নড়াচড়াতেই ফেটে যেতে পারে এই বিস্ফোরক। যে কারণে, মঙ্গলবার খাগড়াগড়ের দোতলায় উঠে রাজ্য পুলিশ ও সিআইডির কাছ থেকে সব জিনিস বুঝে নিলেও ওই বিস্ফোরক সরিয়ে নেয়ার ঝুঁকি নেয়নি তারা। এর পরই বর্ধমানে ডেকে আনা হয়েছে এনএসজির বোমা বিশেষজ্ঞদের। রাসায়নিকগুলো দেখে তারা বলছেন, এ ধরনের রাসায়নিক দিয়ে একসময় বিস্ফোরক তৈরি করত এলটিটিই। গোয়েন্দাদের একাংশের মতে, সম্প্রতি বিস্ফোরক বানানোর কিছু কৌশল ইন্টারনেট মারফত শেখার চেষ্টা করছিল শাকিলরা। খাগড়াগড়-শিমুলিয়ায় তল্লাশি চালিয়ে পাওয়া তথ্যপ্রমাণ সে রকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে ই-মেইল মারফত সেগুলো তাদের কাছে পাঠানো হয়ে থাকতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে। পিকরিক এসিডের মতো বিস্ফোরক যে ইন্টারনেট দেখে বানানো সম্ভব নয়, সে কথাও মানছেন বিশেষজ্ঞরা।
একসময়ে সার থেকে আইইডি তৈরি হতো। সেই আইইডির ব্যবহার শুরু করে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি। তারাই বিস্ফোরক হিসেবে নাইট্রিক এসিড ব্যবহার শুরু করে। এখন বিস্ফোরক বানানোর জন্য অত্যাধুনিক রাসায়নিক লেড অ্যাজাইড বা পিকরিক এসিড ব্যবহার করা হচ্ছে। ভারতীয় গোয়েন্দারাই বলছেন, ‘ভয়ঙ্কর সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। এক দিকে বিস্ফোরক বানানোয় এলটিটিইর এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, সাথে আইএসআই-হুজি জঙ্গিদের টাকা ও নেটওয়ার্ক, জামা’আতদের আত্মবিসর্জনের সঙ্কল্প এবং সর্বশেষে রাজনৈতিক নেতাদের মদদ।’
এখানে ‘রাজনৈতিক নেতাদের মদদ’ বলতে অবশ্য ইঙ্গিত করা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে মতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে। তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুসলিম ভোটে আর নকশাল জঙ্গিদের মদদ দিয়ে মতায় এসেছেন, এমনই ধুয়া তুলেছে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি ও বামফ্রন্ট। তথা সম্ভাব্য নাশকতার জন্য বোমা তৈরিতে হতাহতের ঘটনা নিয়ে মতার লড়াইয়ের জাল ফাঁদা আর দোষারোপের রাজনীতি শুরু হয়েছে। সেই জালের ফাঁদে বাংলাদেশকেও জড়িয়ে ফেলার বাকায়দা সুযোগ রেখেছে ভারতীয় গোয়েন্দারা। বাংলাদেশবিদ্বেষী নানা ধরনের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধাস্ত্র বহু দিন ধরেই মিডিয়ার মাধ্যমে শানিয়ে চলেছে ভারতশক্তির র সংস্থা। বর্ধমান-কাণ্ডের যুদ্ধাস্ত্রটি এই পর্যায়ে পশ্চিমবঙ্গের মমতা সরকারকে বেকায়দায় ফেলার কাজে কম-বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে বলেই মনে হয়। তবে তার কামানের নল দণি এশিয়ায় আল জাওয়াহিরি ঘোষিত আলকায়েদা চক্রান্তের দোহাই দিয়ে ভূরাজনৈতিক স্বার্থে বাংলাদেশের দিকে যেকোনো সময় যে ঘোরানো হতে পারে, সে কথা বলার অপো রাখে না।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.