আজকের প্রজন্মের নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ by শাহ আবদুল হান্নান

আমি গত শতাব্দীর ষাটের দশকের ছাত্র। সময়ের পরিবর্তনে নিশ্চয়ই সমস্যা বা পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়; কিন্তু গত ২০ বছরে এমন কিছু পরিবর্তন এসেছে, যা আগের কোনো প্রজন্ম মোকাবেলা করেছে বলে মনে হয় না। এখন যারা ১৮ বা তার কম বয়সের, তারা মোবাইল ও ইন্টারনেট প্রযুক্তির ভয়াবহ নৈতিকতা বিধ্বংসী উপাদানের শিকার। মোবাইলে নানা গোপন ছবি ধারণ এবং কথাবার্তা রেকর্ড করার সুযোগ রয়েছে, যা অনেক সময় অন্য ব্যক্তি জানতে পারে না। তা ছাড়া কিছু কোম্পানি এমন সময়ে কল চার্জ কমিয়ে দেয়, যার ফলে এ বয়সের ছেলেমেয়েরা প্রায় সারা রাত মোবাইলে কথা বলে তাদের বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে। ফলে তাদের কান নষ্ট হয়, ঘুম নষ্ট হয়, লেখাপড়া নষ্ট হয়, ভালো করে পরের দিন কাস করা হয় না। এ ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনা, যার সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।
তেমনিভাবে আগের প্রজন্ম ইন্টারনেট প্রযুক্তির ভালো বা মন্দের সম্মুখীন হয়নি। এ প্রযুক্তির কল্যাণের শেষ নেই। সেগুলো বর্ণনার স্থান এটা নয়; কিন্তু এর অন্য দিকটি হচ্ছে, এ প্রযুক্তির মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি এবং নগ্ন যৌনতার অস্বাভাবিক এবং সীমাহীন বিস্তার হচ্ছে। ঘরে ঘরে বিশেষ করে সাইবার ক্যাফের মাধ্যমে।
বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত এ প্রযুক্তি সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো এই ভয়াবহ বিকৃতি প্রতিরোধের কোনো কার্যকর প্রচেষ্টা করছে বলে আমার জানা নেই। আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে এই যে, যখন ইন্টারনেটে কাজ করি তখন সময়ে সময়ে বিকৃত যৌন দৃশ্যাবলি স্ক্রিনে চলে আসে। এসব বন্ধ করা কঠিন নয়। এসব ক্ষেত্রে যেভাবেই হোক বিভিন্ন দেশের সরকারকে এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে ভাবতে হবে এবং বসতে হবে যেন এটা বন্ধ করা যায়। আমরা এটুকু জানি যে, কোনো কোনো দেশ এ ক্ষেত্রে সফল হয়েছে।
আজকের প্রজন্ম আরো বিভিন্ন ধরনের নতুন মাত্রার অস্বাভাবিকতার সম্মুখীন। যেমনÑ আজকাল কিছু ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠান সুপারস্টার বা এ ধরনের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে হাজার হাজার কিশোরীকে বিভিন্ন ধরনের সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় নিয়োজিত করছে। যদিও তারা এগুলোকে সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা বলছে না। এসবের আসল উদ্দেশ্য পুঁজিবাদের মূলনীতি অনুযায়ী এসব কোম্পানির মুনাফা বৃদ্ধি করা। তাতে নৈতিকতার কী হলো সেটা কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। এসব প্রতিযোগিতার উপস্থাপিকা এবং অংশগ্রহণকারীরা অনেক সময় এমন পোশাক পরেন, যা আমাদের কালচারে মোটেই সঙ্গত বলা চলে না। তাদের উগ্র সাজসজ্জা থাকে, অনেক সময় পোশাক টাইট হয়, ওড়না থাকে না, কামিজ ছোট হয় এবং উগ্র রঙচঙের হয়। এগুলো প্রকৃতপক্ষে আমাদের উঠতি বংশধরদের শিক্ষা বা রুচি বা যোগ্যতা কোনোভাবেই বৃদ্ধি করছে না।
বর্তমান বস্তুবাদী সভ্যতার প্রভাবেই বলব যে, এ বয়সের ছেলেমেয়েরা নৈতিকতার ক্ষেত্রে তাদের যা কর্তব্য তা তারা ধরে রাখতে পারছে না। তারাও ভোগবাদী হয়ে যাচ্ছে। একটি উদাহরণ দিইÑ আমারই এক ভাগ্নি, যে হলে থাকে, তার সাথে আলাপ করতে গিয়ে জানতে পারলাম যে, ছুটির দিনগুলোতে এ বয়সের মেয়েরা বিশেষ করে সাজসজ্জা, ঘুরে বেড়ানো এবং পার্লারে গিয়ে বেশি সময় ব্যয় করে। সে বলল, কোনো ভালো অনুষ্ঠানের দাওয়াত দিলে তারা বলে, এতে কী হবে। এ ক’দিনের দুনিয়াতে ভোগ করাইতো উচিত। এ সুযোগতো আর আসবে না। তার এ কথা বিশ্বব্যাপী সেকুলার চিন্তা এবং পরিস্থিতির ভয়াবহতাই প্রমাণ করে।
আমার নিবেদন যে, এই প্রজন্মই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভবিষ্যৎ মানবতা তাদেরই সন্তানসন্ততি হবে। এটা অভিভাবকদের জন্য একান্ত জরুরি যে, তারা এই প্রজন্মকে রক্ষায় যথাযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। অমুসলিমদের ক্ষেত্রে কী কী পদক্ষেপ হওয়া উচিত তা তাদেরই ধর্মীয় বা আদর্শিক নেতারা ঠিক করবেন; কিন্তু মুসলিম উম্মাহর ক্ষেত্রে আমি বলতে চাই যে, অভিভাবকদের দায়িত্ব হচ্ছেÑ
১. ৮-১০ বছর বয়সের মধ্যে রাসূল সা:-এর জীবনী অন্তত জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ছেলে এবং মেয়েকে পড়িয়ে দেয়া। রাসূল সা:-এর জীবনী হচ্ছে সর্বোত্তম আদর্শ। এটা ভালো করে না পড়ে কখনোই উত্তম নৈতিকতা অর্জন করা সম্ভব নয়।
২. তেমনিভাবে অন্তত আবু বকর রা:, ওমর রা:, উসমান রা:, আলী রা:, খাদিজা রা:, ফাতেমা রা: ও আয়েশা রা:-এর জীবনী ১১-১২ বছর বয়সের মধ্যে পড়ানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এদের সমকক্ষ মানুষ পৃথিবীতে হয়নি।
৩. অন্তত খেলাফতে রাশেদার ইতিহাস পড়ানোর ব্যবস্থা করা, যাতে তারা আদর্শ শাসনের নমুনা বুঝতে পারে এবং তাদের অতীত ঐতিহ্য জানতে পারে।
৪. তেমনিভাবে এ বয়সের ছেলেমেয়েকে তাদের দেশে ইসলামের আগমন ও বিস্তার এবং মুসলিম শাসনের ইতিহাস পড়িয়ে দেয়া, যাতে তারা তাদের স্থানীয় ঐতিহ্য জানতে পারে।
৫. তাদের অল্প বয়সে অন্তত কুরআন পাকের কিছু অংশের অতি সুন্দর শুদ্ধ তিলাওয়াত শেখানো, যাতে কুরআনের সুরের যে সৌন্দর্য, যে মাধুর্য তা তাদের অন্তরকে প্রভাবিত করে। একই সাথে কুরআনের যতটুকু সম্ভব অর্থ পড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা।
৬. সর্বশেষ হচ্ছে তাদেরকে শুরু থেকেই শালীন পোশাকের দিকে উদ্বুদ্ধ করা। পৃথিবীতে যত নোংরামি হচ্ছে তার একটি কারণ অশালীন পোশাক।
আমি মুসলিম উম্মাহর সরকার, নেতা, আলেম, চিন্তাবিদ, কবি, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক নেতা, রাজনৈতিক ব্যক্তি, ইমাম ও খতিব সবার কাছে আবেদন করি, এ বিষয়টি আপনারা গভীরভাবে বিবেচনা করুন এবং এ ব্যাপারে কার্যকর স্থানীয়, সামাজিক ও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিন।
লেখক : সাবেক সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

No comments

Powered by Blogger.