‘নারীরা অর্থনৈতিকভাবেও বৈষম্যের শিকার’

শুধু সামাজিক নয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও নারীরা বৈষম্যের শিকার। বর্তমানে নারী যে কাজ করে, তার মাত্র চার ভাগের এক ভাগ জাতীয় আয়ে যোগ হয়। একজন গড়ে প্রতিদিন ১২ দশমিক ১টি কাজ করে, যা জাতীয় আয়ে যোগ হয় না। এসব কাজের বার্ষিক মূল্য মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৮৭ দশমিক ১ শতাংশের সমান। গতকাল রাজধানীর স্থানীয় একটি হোটেলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন আয়োজিত জরিপ রিপোর্ট প্রকাশের অনুষ্ঠানে এ তথ্য জানানো হয়। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল বলেন, বিয়ের ক্ষেত্রে নারীদের বয়সসীমা কমছে না। সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম, বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনসহ দেশের বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ, নারীনেত্রী এবং সমাজবিজ্ঞানীরা।  অনুষ্ঠানে জানানো হয়, পুরুষের তুলনায় নারীর ৩ গুণ সময় জাতীয় আয়ে যোগ হয় না। একজন প্রতিদিন হিসাবের বাইরে ৭ দশমিক ৭ ঘণ্টা কাজ করে। সংখ্যার বিবেচনায় এ ধরনের কাজ ১২ দশমিক ১টি।  গ্রাম শহর দুই জায়গাতেই এ ব্যবধান রয়েছে।
সিপিডির জরিপ অনুসারে নারীদের যে সব কাজ জাতীয় আয়ে যোগ হয় না, তার বার্ষিক মূল্য জিডিপির ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে সাধারণ মূল্য পদ্ধতি অনুসারে যা জিডিপির ৮৭ দশমিক ২ শতাংশ।  পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ নারী। তাই এদের বাদ দিয়ে সরকার বা অর্থনীতি কোন কিছুই সফল হতে পারে না। তিনি বলেন, নারীদের ক্ষেত্রে অনেক ধরনের বৈষম্য রয়েছে। একদিনে তা সমাধান হবে না। এ জন্য সময় লাগবে। তিনি আরও বলেন, সরকার নারীর বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। পর্যায়ে ক্রমে এগুলোর কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। তবে সরকারের পাশাপাশি সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।  এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নারীদের বিয়ের বয়সসীমা কমিয়ে আনার বিষয়টি বাজারে শোনা যাচ্ছে। তবে সরকার এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেবে না। অর্থাৎ বিয়ের ক্ষেত্রে নারীর বয়সসীমা আগের মতো থাকবে।  মীর্জ্জা আজিজ বলেন, দেশের সবাই স্বীকার করবে, নারীর সব কাজের স্বীকৃতি নেই। জাতীয় আয়ে অবদানের স্বীকৃতি দিতে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে নারীর মজুরিভিত্তিক  অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে যে সব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তা সবার আগে দূর করা জরুরি। তিনি বলেন, সরকার নারীকে মাতৃত্বকালীন ৬ মাস ছুটি দেয়। কিন্তু অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এখনও তা কার্যকর করেনি। ফলে ওই সব প্রতিষ্ঠানকে বাধ্য করার জন্য সরকারের উদ্যোগ নেয়া উচিত। এছাড়া নারীর ক্ষেত্রে সহিংসতা বন্ধে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। অন্য বক্তারা বলেন, সমাজে বিভিন্ন সময়ে নারীরা চাকরিতে বাধার সম্মুখীন হয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা আসে পরিবার থেকে। এছাড়াও কুসংস্কারের কারণে নারীরা কাজ করতে পারে না। আর চাকরিতে বেতন পেলেও তা নিজের ইচ্ছায় খরচ করতে পারে না। এক্ষেত্রে পরিবারের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়।
সুপারিশ: নারীকে যথাযথ মূল্যায়নে সিপিডির পক্ষ থেকে এ সময়ে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জাতীয় আয়ের হিসাব ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে নারীর অবৈতনিক কাজের মূল্য অন্তর্ভুক্ত করা। এ ক্ষেত্রে মূল্যায়নের পদ্ধতি ঠিক করতে সরকার অর্থনীতিবিদ, পরিসংখ্যানবিদ, জেন্ডার বিশেষজ্ঞ, অ্যাডভোকেসি গ্রুপসহ সব পক্ষের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করতে হবে। শ্রম বাজারে নারীর পারিশ্রামিক তুলনামূলকভাবে কম। তাই এ বৈষম্য কমাতে সরকারের পক্ষ থেকে আইন করা উচিত।
যেভাবে জরিপ পরিচালনা করা হয়: সিপিডির গবেষণায় দেশের ১৫ বছরের উপরে ১৩ হাজার ৬৪০ জন ব্যক্তির কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮ হাজার ৩২০ জন নারী এবং ৫ হাজার ৩২০ জন পুরুষ। জরিপ হয় ৫ হাজার ৬৭০টি। ২০১৪ সালের মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে এ জরিপ সম্পন্ন করা হয়। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের নির্ধারিত বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। পরবর্তীকালে তা জাতিসংঘের মূল্যায়ন পদ্ধতিতে কাজের মূল্য বের করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.