হুন্ডির পাচারকৃত কালো টাকা কি হালাল? by আলী ইদ্‌রিস

গত ২২শে অক্টোবর ইস্টার্ন ব্যাংকের আয়কর পকেট গাইড প্রকাশনা অনুষ্ঠানে এনবিআরএর চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘মালয়েশিয়া ও কানাডার মতো দেশে যারা বাড়ি কিনেছেন, তারা ঠিকমতো আয়কর দিয়েছেন কিনা সেটি খুঁজে দেখবে এনবিআর।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘বিদেশে বাড়ি কেনা দোষের কিছু না। কারও টাকা থাকলে তিনি অবশ্যই বাড়ি কিনতে পারেন। তবে দেশ থেকে টাকা নিয়ে সেখানে বাড়ি কিনলে তার আয়কর সরকারকে দিতে হবে।’ (প্র: আ: ২৩/১০/১৪)। এনবিআর চেয়ারম্যানের ভাষ্য মতে, বিদেশে বাড়ি কেনার জন্য বৈধভাবে বৈদেশিক মুদ্রা নেয়া যায়, অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন দিয়ে থাকে। কিন্তু আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান অনুসারে মূলধন ফেরত, আমদানি, লভ্যাংশ, শিক্ষা, চিকিৎসা, ভ্রমণ ও আরও কিছু খাত ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক বাড়ি কেনার জন্য দেশের বাইরে বৈদেশিক মুদ্রা নেয়ার অনুমোদন দেয় না। যদি দিয়ে থাকে তাহলে অনুমোদন দেয়ার সময় আয়কর সার্টিফিকেট চায়নি কেন। এনবিআর চেয়ারম্যান আরও বলেছেন, ‘বৈধ-অবৈধ দু’ভাবেই দেশের টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে, এটি হলো বাস্তবতা। সেটা আমরা ঠেকাতে না পারলেও এসব টাকার কর আদায় করে রাজস্ব বাড়াতে পারি।’ তার মতে, মনে হচ্ছে কর আদায় করেই পাচারকারীদের দায়মুক্তি দিয়ে ছেড়ে দেয়া যায়। এটা অবিচার এবং এ জাতীয় কার্যক্রম পুরান ও নতুন উভয় পাচারকারীদের আরও উৎসাহিত করবে। অবৈধভাবে দেশের অর্থপাচার করা মানি লন্ডারিং আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আগে পাচারকৃত অর্থ কৌশলে দেশে ফেরত আনতে হবে। এর পরই কর দেয়ার প্রশ্ন ওঠে। বাংলাদেশের অর্থপাচারকারীরা এখন কালো টাকা নিয়ে অভিজাত শ্রেণীর কাতারে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ভিয়েতনামের পর পৃথিবীর বড় বড় ধনীর সঙ্গে এ দেশের কালো টাকা সুইস ব্যাংকের ভল্টে জমা পড়েছে। মিডিয়ার রিপোর্ট অনুসারে ২০১২ সাল পর্যন্ত সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের আমানত ১,৯০৮ কোটি টাকা ছিল। ২০১৩ সালে সে অর্থ ৩,১৬২ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এ অর্থপাচারকৃত মোট অর্থের ১.৫ শতাংশ। স্বাধীনতার পর গত ৪ দশকে ২ লাখ কোটিরও অধিক অর্থ পাচার হয়েছে। এসব অর্থ পৃথিবীর বিভিন্ন ব্যাংকে গচ্চিত এবং বাকিটা বিদেশে বাড়ি, গাড়ি শিল্প-কারখানা ইত্যাদিতে বিনিয়োগ হয়েছে। ইউএনডিপি’র এক প্রতিবেদন মতে, বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার হওয়া দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান দ্বিতীয়। প্রথম স্থানে রয়েছে আইভরিকোস্ট। অর্থপাচার একটি অবৈধ বা অনৈতিক কাজ হলেও কোন দেশে পাচারকারী নেই এমন গ্যারান্টি দেয়া অসম্ভব। বিনা কারণে, উৎসুক্যবশত বা হবি হিসাবেও কেউ কেউ সুইস ব্যাংকে টাকা রাখে। কিন্তু বদনাম সুইস ব্যাংকের হলেও অন্যান্য দেশে যেমন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, এসব দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধিকল্পে বিভিন্ন আকর্ষণীয় স্ক্রিমের আওতায় বৈদেশিক বিনিয়োগ আহ্বান করা হয়। ওইসব দেশে প্রবাসী ও অভিবাসী ছাড়াও অসংখ্য বাংলাদেশীদের বাড়ি, গাড়ি, শেয়ার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়ে গেছে। শুধু মালয়েশিয়াই ২,৯২৩ জন বাংলাদেশী সেকেন্ড হোম কিনে অনুমানিক ৫,০০০ কোটি টাকা পাচার করেছেন। বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে তারা এই লাখ লাখ ডলার কিভাবে বিদেশে বিনিয়োগ করলেন বা ব্যাংকে জমা করলেন সেটা অনুসন্ধানের বিষয়। ব্যাংকের মাধ্যমে আইন অনুযায়ী বিদেশে বিনিয়োগ করার সুযোগ সীমিত, তাই হুন্ডি বা অন্য চ্যানেলে এসব অর্থপাচার হয়েছে, যা মানি লন্ডারিং আইনে অপরাধ। বড় বড় দেশে অর্থপাচার চল্লিশ বছর ধরে চলছে। একইভাবে স্বাধীনতার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য দেশে অভিবাসন ও ব্যবসা স্কিমে হাজার হাজার বাংলাদেশী কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে সুবিধাগুলো গ্রহণ করেছেন। ওই টাকা আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে গেল, না পাচার হলো মানি লন্ডারিং আইন, এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কিনা, সবই খতিয়ে দেখার বিষয়। ইউএনডিপি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী গত চার দশকে ২ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে, অঙ্কটি ক্ষুদ্র বলে মনে হয়। পাচারকৃত অর্থ আরও অনেক বেশি হওয়া উচিত। নৈতিকতার ব্যাপারটা বাদ দিলে অর্থপাচারের কারণ হলো : দুর্নীতি, আত্মসাৎ, ব্যবসার মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক অর্থ বিদেশে রেখে দেয়ার প্রবণতা, দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক অস্থিরতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, লাভজনক বিনিয়োগের ক্ষেত্রের অভাব, সুশাসনের অভাব বা আইনশৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতি ইত্যাদি। উপরিউক্ত যে কোন কারণেই হোক, পাচারকারীদের এ অর্থ এক সময়ে দেশে ফেরত আনা উচিত। কিন্তু এখানেই সমস্যা। পাচারকৃত অর্থ খুব কম ক্ষেত্রেই দেশে ফেরত আসে। কারণ পাচার করতে যেমন ঝুঁকি নিতে হয়, ফেরত আনাও তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ। তাই পাচারকারীরা দু’বার ঝুঁকি নিতে চায় না। তা ছাড়া দেশপ্রেমের অভাব বা দেশের আয়কর আইন, মানি লন্ডারিং আইনের জরিমানা বা শাস্তির ভয়ে কেউ ওই টাকা ফেরত আনতে চায় না। অন্যদিকে এ টাকা উদ্ধার করাও সহজ নয়। সুইস ব্যাংক বাংলাদেশকে তথ্য দিতে চায় না। বাংলাদেশ বর্তমানে অর্থপাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক জোট ‘এগমন্ট’ গ্রুপের সদস্য হওয়ায় তথ্য পেতে সহায়ক হবে। তথাপি পুরোপুরি তথ্য কখনও পাওয়া যাবে না। তবে আইনিযুদ্ধ চালিয়ে কৃতকার্য হওয়া দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। তাই পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের প্রচেষ্টা হবে, ওই টাকা যাতে সহজে দেশে ফেরত আসতে পারে সে উদ্দেশ্যে অন্যান্য দেশের মতো কিছু স্কিম বা বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া উচিত। কালো টাকা সাদা করার মতো পাচারকৃত টাকা জরিমানা দিয়ে নির্দিষ্ট শিল্পে বা অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করার সুযোগ দেয়া যেতে পারে। পাচার যাতে না হয় তার প্রতিকার করা যেমন সরকারের দায়িত্ব, তেমনি কালো টাকার মতো পাচারকৃত টাকারও সৎকার করা সরকারের কর্তব্য। আমাদের হৃদয়ে নৈতিক উন্নতি ও দেশপ্রেম জাগ্রত না হওয়া পর্যন্ত অর্থপাচার হবেই, কিন্তু কৌশলে সে অর্থ ফিরিয়ে আনাই কৃতিত্ব। তাই শুধু আয়কর আদায় করার উদ্দেশ্যে নয়, পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন স্কিম চালু করা উচিত।

No comments

Powered by Blogger.