ইলিশ মাছের আবাসস্থল রক্ষা জরুরি by কাজী শফিকুর রহমান

ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। আমিষজাতীয় খাদ্য সরবরাহ ও জাতীয় অর্থনীতিতে ইলিশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশে মোট মাছ উৎপাদনে ইলিশের পরিমাণ প্রায় ১১ শতাংশ। প্রতি বছর দেশে প্রায় ৩.৫১ লাখ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদিত হয়। কয়েক দশকে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে নদ-নদীর নাব্যতা হ্রাস, পরিবেশ বিপর্যয়, নির্বিচারে জাটকা ধরা এবং প্রচুর পরিমাণে ডিমওয়ালা ইলিশ ধরায় ইলিশের উৎপাদন দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। এই মাছের উৎপাদন ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া শুরু হয়েছে; যেমনÑ জাটকা সংরক্ষণ, সর্বোচ্চ প্রজনন মওসুমে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধকরণ আর অভয়াশ্রমগুলোকে রক্ষা।
ইলিশের প্রজনন সারা বছরই হয়, তবে সবচেয়ে বেশি হয় অক্টোবর মাসে; অর্থাৎ আশ্বিন-কার্তিক মাসে, বড় পূর্ণিমার সময়। তখন শতকরা ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ইলিশই সাধারণত পরিপক্ব এবং ডিম ছাড়ার উপযোগী থাকে। দুর্ভাগ্যবশত এ সময়েই সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ সারা বছর যত ইলিশ ধরা হয় তার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ ধরা পড়ে। তা ছাড়া সারা বছরই নির্বিচারে জাটকা ইলিশ ধরা হয়।
এই প্রতিকূল অবস্থায় ইলিশের প্রাকৃতিক প্রজনন এবং জাটকা ইলিশ বড় হওয়া ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়। ইলিশ ধরার কাজে চার থেকে পাঁচ লাখ জেলে এবং ২০ থেকে ২৫ লাখ লোক ইলিশের বিপণন ও অন্যান্য কাজে নিয়োজিত আছে। নানাবিধ কারণে দেশের বিভিন্ন জলাশয়ে ইলিশের উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। এর বড় কারণ, আমরা ইলিশের আবাসস্থল রক্ষা করতে পারিনি। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র এবং এদের প্রায় সব শাখা, প্রশাখা ও উপনদীতে আগে প্রচুর ইলিশ পাওয়া যেত। তা ছাড়া ফেনী, কর্ণফুলী, মাতামুহুরীÑ এসব নদ-নদীতেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ইলিশ পাওয়া যেত।
শতকরা ৯৫ থেকে প্রায় ৯৮ ভাগ ইলিশই দেশের অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে ধরা পড়ত। পঞ্চাশের দশকে এসব জলাশয়ে ইলিশের উৎপাদন ছিল প্রায় দেড় লাখ টন। গত ৪০-৪৫ বছরে দেশের ৩৫টি নদ-নদী থেকে ইলিশ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এসব নদ-নদীতে একসময় বছরে ১৫ হাজার থেকে ১৬ হাজার নৌকা দিয়ে ২১ হাজার থেকে ২৫ হাজার টন ইলিশ ধরা হতো। বন্যানিয়ন্ত্রণ ও সেচ প্রকল্পের বাঁধ এবং আড়াআড়িভাবে নদ-নদীতে বাঁধ তৈরির কারণে ইলিশের আবাসস্থল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ফারাক্কা বাঁধের জন্য পদ্মা নদীতে পানিপ্রবাহ অনেক কমে গেছে। পদ্মা ও এর সব শাখা-প্রশাখায় ইলিশ উৎপাদন অনেক হ্রাস পেয়েছে। হাতিয়া, সন্দ্বীপ, ভোলা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর অঞ্চলের প্রধান নদীগুলোর পাড় ভাঙার ফলে ওই সব অঞ্চলে নদীর গতিপথ ও তলদেশ ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে। অনেক চর ও ডুবোচর সৃষ্টি হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া ইলিশের আবাসস্থল ও পরিবেশ নষ্ট করছে।
তিন বছর গবেষণার পর ২০১৩ সালে মৎস্যবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, পুকুরে বাণিজ্যিকভাবে ইলিশের চাষ সম্ভব নয়। পুকুরে ইলিশকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলেও এর স্বাদ, বৃদ্ধি ও বংশবিস্তার নদী কিংবা সাগরের মতো হওয়া সম্ভব নয়। পুকুরে ইলিশ চাষ খুবই ব্যয়বহুল। ছোট একটি ইলিশের জন্য ব্যয় হবে তিন থেকে চার হাজার টাকা। পুকুরে ইলিশের ডিম এলেও তা পরিপক্ব হয় না।
ইলিশ সম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে জরুরিভিত্তিতে কতকগুলো ব্যবস্থা নেয়া অপরিহার্য; যেমনÑ ক. নদ-নদীতে বাঁধ নির্মাণের আগে ইলিশের ওপর এর সম্ভ^াব্য নেতিবাচক প্রভাবের আলোকে ব্যবস্থা নিতে হবে। খ. ইলিশ ও অন্যান্য মাছের বিচরণ ও নৌচলাচলের জন্য পদ্মা, ধলেশ্বরী, মধুমতি, গড়াইÑ এসব নদীর পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি এবং তলদেশ খনন করতে হবে। গ. ইলিশের আবাসস্থল সংরক্ষণ, পুনরুদ্ধার, নদীশাসন ও পানি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। ঘ. ইলিশের বিচরণস্থলে উপযুক্ত খাবার সরবরাহের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ আবশ্যক। ঙ. মাছের আবাসস্থল রক্ষার লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন এবং বিদ্যমান আইনগুলোকে সময়োপযোগী করতে হবে।
মাছের নিরাপদ ডিম ছাড়ার সুবিধার্থে এবং মা ইলিশ রক্ষার উদ্দেশ্যে এ বছরও সারা দেশে ইলিশ ধরা, বিক্রি, বাজারজাতকরণ ও পরিবহনের ওপর ৫ অক্টোবর থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত ১১ দিনের জন্য ১৪টি জেলার নদ-নদীতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতে, এই সময় আরো বেশি, কমপক্ষে ১৫দিন হওয়া আবশ্যক।
বছরের মোট দুই মাস ১১ দিন ইলিশ জেলেদের জীবিকা নির্বাহে সহায়তা দেয়া হয়। কারণ, এই সময় তারা ইলিশ আহরণ থেকে বিরত থাকে। ইলিশ জেলেদের পরিচয়পত্র সরবরাহের কাজ শুরু হয়েছে। সেটা সঠিকভাবে করতে পারলে তাদের জীবন-জীবিকার উন্নতি হবে। তাদের জন্য ব্যাংকে হিসাব খোলা এবং সঞ্চয়ের সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার।
লেখক : আইনজীবী

No comments

Powered by Blogger.